বাংলাদেশের প্রাচীনতম মেলাগুলোর মধ্যে পটিয়া ঠেগরপুনি বুড়াগোসাঁইর মেলা অন্যতম। অনেকে মনে করেন ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ মেলার সূচনা। সূচনাকাল থেকে অদ্যাবধি প্রতি মাঘী পূর্ণিমার উদ্দেশ্যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধরা মনে করে, একাগ্রমনে বুড়া গোসাঁইর উদ্দেশ্যে মানত করে কোন প্রার্থনা করলে তা পূর্ণ হয়। এ মেলায় সমতল বৌদ্ধজনগোষ্ঠী ছাড়াও পাহাড়ি বৌদ্ধরা উপস্থিত হয়ে বুড়াগোসাঁইর পূজা ও বন্দনা করে। এ সময় সাধারণত প্রব্রজ্যাগ্রহণ, অন্নপ্রাশন, পায়রা ছেড়ে দেয়া (মুক্ত করা) সহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মীয় কার্যাদি বুড়াগোসাঁইর (বুদ্ধের) সামনে ভক্তপ্রাণ পুণ্যার্থীরা সম্পাদন করে থাকে। মাঘী পূর্ণিমা ছাড়াও বিভিন্ন পূর্ণিমা ও তিথিতে এখানে বহু ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধদের সমাগম ঘটে। পটিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩ কি.মি পশ্চিমে চাঁনখালী ও শ্রীমতি নদীর তীরে ঠেগরপুনি গ্রামে এ মেলা বা তীর্থের অবস্থান।
এই তীর্থ বা মেলাকে নিয়ে জনশ্রুতি আছে যে, খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে চকরিয়ার চন্দ্রজ্যোতিঃ মহাস্থবির বার্মার মৌলমেনে গমন করে বুদ্ধের ধর্ম-বিনয়ে শিক্ষা সমাপনান্তে ২০ বছর পর সেই দেশের দশজন ভিক্ষুসহ আগরতলায় উপনীত হন এবং এখানে লালমাই পাহাড়ে আশ্রম স্থাপন করেন। আগড়তলার রাজবংশীয় বলিভীম আদিত্য নামক জনৈক ধনাঢ্য ব্যক্তি তাদের জন্য বিহার নির্মাণ করেন এবং বিনয়ানুকূল ভিক্ষু-সীমা প্রস্তুত করেন। সেই ভিক্ষু-সীমায় পর্যায়ক্রমে ১০০ জন কুলপুত্রকে উপসস্পদা প্রদান করেন। চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবির সেখানে পাঁচ বছরকাল শিষ্যদিগকে ধর্ম-বিনয় শিক্ষা দিয়ে চট্টগ্রামে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে সীতাকু- পাহাড়ের উচ্চতম চূড়ায় একটি আশ্রম স্থাপন ও একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বার্মা থেকে আসার সময় তিনটি ত্রিভঙ্গ বুদ্ধমূর্তি এনেছিলেন। তার নির্মিত মন্দিরে একটি ত্রিভঙ্গ বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবির সশিষ্য চট্টগ্রামের পটিয়া থানার হাইদমজা গ্রামে (বর্তমান হাইদগাঁও বা চক্রশালা) উপস্থিত হন। এখানকার ধনাঢ্য ব্যক্তি হাইদমজা চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবির ও তার শিষ্যদের যথাযথ সম্মান ও চতুর্প্রত্যয়াদি দান করেন। হাইদমজা বা হাইদগাঁও এর অদূরবর্তী ঠেগরপুনি গ্রাম, সেখানে হাইদমজার বংশধরগণ বসতি স্থাপন করে বসবাস করত। এখানে বিহারে তখন অবস্থান করতেন চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবিরেরই পিতৃব্য রাজমঙ্গল মহাস্থবির। কথিত আছে তিনি বুদ্ধগয়া থেকে বোধিবৃক্ষের একটি চারা এনে রোপণ করেন, যেটি এখনো বিদ্যমান। তার উত্তরপাশে একটি কাঠের ঘর নির্মাণ করে বোধিম-প স্থাপন করেছিলেন। এই কাঠের নির্মিত ঘরে চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবির কর্তৃক আনীত তিনটি ত্রিভঙ্গ মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। একসময় সেই কাঠের ঘর ভেঙে গেলে ত্রিভঙ্গ মূর্তির অদৃশ্য হয়ে যায়। বহু বছর পর বাকখালি নিবাসী প্রয়াত শ্রীধন বড়ুয়ার স্ত্রী নীলাকুমারী বড়–য়া স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নিধিকুম্ভসহ বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার করেন এবং করল নিবাসী ভগ্নিপুত্র আরাধন মহাস্থবিরকে বুদ্ধমুর্তিটি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনুরোধ করেন। আরাধন মহাস্থবির বর্তমান স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করে বুদ্ধমূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে স্থাপিত মূর্তিটি ত্রিভঙ্গ ছিল, অর্থাৎ তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল; উপরাংশ, মধ্যাংশ ও নি¤œাংশ। দ্বিতীয়বার প্রতিষ্ঠার সময় মধ্যাংশ পাওয়া যায়নি। বর্তমান মূর্তিটি উপরাংশ ও নি¤œাংশের সংযোগমাত্র। এই মূর্তিটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে।
ঠেগরপুনিতে পূর্বের জনবসতি ছিল না। হাইদমজার পূর্বপুরুষ ছাদপ্রু নামে একব্যক্তি উক্ত এলাকায় গিয়ে একটি বাঘ শিকার করেন এবং সেখানে আবাদ করে বসতি স্থাপন করেন। সে থেকে এলাকায় এখনো তাদের বাঘমারার গোষ্ঠী হিসাবে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রায় ২ যুগ আগেও এ মেলা প্রায় সপ্তাহ-দশদিন ব্যাপী চলত। দূর-দূরান্ত থেকে চাঁনখালী খাল হয়ে নৌকা যোগে হাজার হাজার পূণ্যার্থীর সমাগম হতো। বর্তমানে চাঁনখালী খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় নৌকা যোগে আর যাতায়াত আর হয় না। তখন দূরবর্তী পূণ্যার্থীরা এখানে রাত্রিযাপন করতো। পাশে ধর্মশালা আাজও তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ছাড়াও হিন্দু-মুসলিমের সমাগমে অসাম্প্রদায়িক এক মিলন মেলা হিসাবে পরিণত ছিল। তখন মেলা নানান লোকজ পণ্যের পসরার সমাহার ঘটত। সেসময় যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচসহ নানাবিধ লোকসংস্কৃতির আয়োজন দেখা যেতো। আধুনিক নগরজীবনে এ মেলার পরিসর ও সৌন্দর্য অনেকটাই কমে গেছে। বর্তমানে এ মেলা ৪-৫ দিন ধরে চলে।