চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

৪ শতাধিক পরিবারের মানবেতর দিনযাপন

একই ঘরে গবাদিপশু আর মানুষের বসবাস

নিজস্ব সংবাদদাতাহ দীঘিনালা

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

খাগড়াছড়ির দিঘিনালায় একই ঘরে গবাদিপশুর সাথে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে মানুষ। উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বাবুছড়া গুচ্ছগ্রামে গেলেই চোখে পড়বে অমানবিক এই চিত্র। গুচ্ছগ্রাম নামক এই বন্দিশালায় নেই নাগরিক কোনো সুযোগ সুবিধা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এ গুচ্ছগ্রামে বাড়ছে জনসংখ্যা। কিন্তু জনসংখ্যা বাড়লেও এ গুচ্ছগ্রামের আশেপাশে কোথাও নেই নতুন করে বসতি স্থাপনের কোনো জায়গা জমি। তাই জায়গা সংকুলান না হওয়ায় নিরূপায় হয়ে একই ঘরে গবাদিপশুর সাথে অত্যন্ত মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন বাবুছড়া গুচ্ছগ্রামের চার শতাধিক পরিবার। প্রায় দুই সহ¯্রাধিক জনসংখ্যার এই গুচ্ছগ্রামে নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানীয়জলের কোনো সু-ব্যবস্থা। পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য নির্মিত ড্রেনগুলোও ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের কোনো বালাই নেই গুচ্ছগ্রামের কোথাও। গ্রামের বসতিগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যেনো গোয়ালঘর। নামে গুচ্ছগ্রাম হলেও এই গুচ্ছগ্রামের বেশিরভাগ মানুষেরই নেই সরকারি রেশনিং ব্যবস্থা।

তাই নানাবিধ সমস্যা আর অভাব অনটনের মাঝেই কাটছে গুচ্ছগ্রাম নামক এই বন্দিশায় বসবাসরত মানুষের কষ্টের জীবন।
সরেজমিন ঘুরে গুচ্ছগ্রামে বসবারত লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে রিবাজমান অশান্ত পরিস্থিতির কারনে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকে এই গুচ্ছগ্রামে নিয়ে আসা হয়। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও অদ্যাবধি পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। আদৌ পুনর্বাসন করা হবে কিনা তাও জানেনা সহায় সম্বলহীন এ গুচ্ছগ্রামের কোন মানুষ। স্থানীয় কিংবা জাতীয় যেকোন নির্বাচনে মেম্বার চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক দলের নেতারা নানা প্রকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট আদায় করে নেয়ার পর কেউ আর খবর রাখে না এমন অভিযোগ গুচ্ছগ্রামবাসী সকলের।

চার শতাধিক পরিবারের এই গুচ্ছগ্রামে ১২৩ পরিবারের নামে সরকারি রেশন কার্ড থাকলেও বাকিদের নেই বাঁচার মত কোনো অবলম্বন। তাই জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিদিনই তাদের ছুটতে হয় কাজের সন্ধানে। এদিকে গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত বেশ কিছু পরিবারের নামে নাড়াইছড়ি, সোনামিয়া টিলা ও পুরাতন বাঙালি পাড়ায় জায়গা জমি থাকার পরও নিরাপত্তাজনিত কারনে তারা ফিরতে পারছেন না তাদের বসতভিটায়। এমতাবস্থায় নিরুপায় হয়ে গুচ্ছগ্রামেই কাটাতে হচ্ছে তাদের। আবুল লিডার নামে গুচ্ছগ্রামের সাবেক এক দলনেতা জানান, গুচ্ছগ্রামের বেশিরভাগ পরিবারই ভূমিহীন এবং ছিন্নমূল। দিনমজুরি ছাড়া তাদের পরিবার চলে না। প্রতিবছরই বাড়ছে গুচ্ছগ্রামের জনসংখ্যা। তবে জনসংখ্যা বাড়লেও নতুন করে বসতি স্থাপনের কোন জায়গা নেই গুচ্ছগ্রামের কোথাও। তাই একইঘরে গবাদিপশুর সাথেই পরিবারের লোকজন নিয়ে কাটাতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি ভিত্তিতে পুনর্বাসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। স্থানীয় বাঙালি নেতা হিসাবে পরিচিত আব্দুল মালেক জানান, মানবিক বিপর্যয়ের মাঝে বাবুছড়া গুচ্ছগ্রামের লোকজন বসবাস করছে। কোন মানুষ এভাবে বসবাস করতে পারে না।
সাবেক ইউপি সদস্য মুজিবুর রহমান জানান, বাবুছড়া গুচ্ছগ্রামে বসবাস করার মত কোনো পরিবেশ নেই। তারপরেও পুনর্বাসনের আশায় সীমাহীন কস্টের মাঝে ৩৪টি বছর পার করেছে এ গুচ্ছগ্রামের সহায় সম্বলহীন মানুষগুলো। যে পরিবেশে এ গুচ্ছগ্রামে মানুষ বসবাস করছে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। যতই সমস্যা থাকুক না কেন একই ঘরে গবাদিপশুর সাথে বসবাস করতে পারে না কোন মানুষ। তাই পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত গুচ্ছগ্রামের রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও পয়ঃনিষ্কাশনসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পানীয়জলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি বলে জানান তিনি। বাবুছড়া গুচ্ছগ্রামের সাবেক প্রকল্প চেয়ারম্যান তপন বিশ্বাস জানান, নামেই এটি গুচ্ছগ্রাম। কাজের বেলায় এখানে গুচ্ছগ্রামের কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। গুচ্ছগ্রামের প্রতিটি পরিবারের সরকারি রেশন কার্ড থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ১২৩ পরিবারের। বাকি পরিবারগুলোর রেশন কার্ড না থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর দিন কাটাচ্ছে।
তাই গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত সকল পরিবারের রেশনিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পাশাপাশি পুনর্বাস না করা পর্যন্ত গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত লোকজনের নাগরিক সুযোগ সুবিধাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। উপজেলা চেয়ারম্যান মো. কাশেম জানান, পুনর্বাসনের বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকারি সিদ্ধান্ত পেলে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া গুচ্ছগ্রামবাসীর রাস্তাঘাট উন্নয়ন, পয়ঃনিষ্কাশন ও প্রয়োজনীয় পানীয়জলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট