অযতœ, অবহেলায় ধ্বংসের শেষ সীমানায় পতিত হয়েছে চট্টগ্রামের পটিয়ার খরনার চা বাগান। বৃটিশ আমলে উপজেলার কচুয়াই ও চন্দনাইশের কাঞ্চননগর এলাকায় প্রায় ৫ হাজার একর বনভুমিতে বিপুল পরিমাণ চা চাষ হতো। ওইসময় ‘পটিয়া টি এস্টেট’ নামে একটি চা বাগানও সৃষ্ট হয়। উক্ত চা বাগান বৃটেন ও কানাডীয় দু’টি সংস্থা পরিচালনা করতো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সরকারি নজরদারির অভাবে এখন তা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি চা গাছ রয়েছে। পটিয়া ও চন্দনাইশের পাহাড়ে চা চাষের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অভিজ্ঞমহল মনে করেন, ওই টি এস্টেট সরকারি হস্তক্ষেপে সংস্কার ও নতুন করে চা চাষ করা গেলে সরকারের কোটি টাকার রাজস্ব আয়সহ সহ¯্রাধিক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।বর্তমানে চা বাগান এলাকাসহ পাহাড়ি এলাকা নিয়ে শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে রপ্তানি জোন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, ১৯৩০ সালে পটিয়ার কচুয়াই এবং চন্দনাইশের কাঞ্চননগর এলাকায় প্রায় ৫ হাজার একর বনভূমিতে ‘পটিয়া টি এস্টেট’ নামে একটি চা বাগান সৃষ্টি হয়। ওইসময় প্রায় ৩’শ শ্রমিক টি এস্টেটে কাজ করতো। উৎপাদিত চায়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ৫ থেকে ৭ টনে দাঁড়াতো। বৃটিশ সরকার পতনের পর পাকিস্তান সরকারের পতন হলে প্রযুক্তির কাছে ঐতিহ্য হারিয়ে টি এস্টেটটি। দেশ স্বাধীনের পর ভূমিদস্যুদল ধীরে ধীরে তা জবরদখলে নিলে এ পর্যন্ত এসে টি এস্টেট সাইনবোর্ড সর্বস্ব হয়ে পড়ে। স্থানীয় কিছু সুবিধাবাদী লোক ও সন্ত্রাসী চক্র চা বাগানের ছায়াবৃক্ষসহ বাগানে রক্ষিত নানা মূল্যবান গাছ সাবাড় করছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি কোন অনুমতি ছাড়াই ভূমিদুস্যরা টি এস্টেটের দুই তৃতীয়াংশ জায়গা বেদখল করে ফেলে। সরকারিভাবে আবারও এখানে টি এস্টেট গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে।
সুবিধাবঞ্চিত লোকজন:
চা বাগান এলাকায় বর্তমানে বসবাস করছে অর্ধশতাধিক পরিবার। যারা একসময়ের টি এস্টেটের কর্মচারি ছিলেন। বর্তমানে সেখানে বিদ্যুৎ লাইন গেলেও, সুপেয় পানি ও চিকিৎসা সেবা সুযোগ নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তাদের জন্মস্থান হলেও বর্তমানে তারা সবাই পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরে তারা এখানে বসবাস করলেও তাদের প্রতি কোন সরকারই দৃষ্টি দেননি। অন্যদিকে, চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার কারণে চা বাগান এলাকার পরিবারগুলো দিন দিন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
পাহাড়ে শিক্ষার আলো: ২০০৪ সালে ‘জীবন জয়ের পথে’ স্লোগান নিয়ে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন একটি বিদ্যা নিকেতন। যার নামকরণ করা হয়েছে ‘স্বপ্ননগর বিদ্যা নিকেতন’। সরকারি কিংবা বিত্তশালীদের কোন সহযোগিতা না পেলেও সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে মহৎ এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন চন্দনাইশের মোহাম্মদ রফিক ও ওয়াসিম। শুরুতে বেড়ার তৈরি একটি জরাজীর্ণ ঘরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তীতে দ্রুব জ্যোতি হোর, সুজা আল মামুন, মেজবাহ, নিলয়, শান্তা, মাহফুজা জাহান, নাছিমা সিরাজি ও অনিকেত চৌধুরী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় হাত বাড়িয়ে দেন। পড়ালেখার পাশাপাশি এখানে ছড়া, কবিতা, গান ও নাচের চর্চা চলে।
নানা কারণে বৃটিশ আমলে চা উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়লে কয়েকশ শ্রমিক বেকায়দায় পড়ে। যাদের বাড়ি ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তৎকালীন পাহাড়ি এলাকায় (চা বাগান) শিক্ষার কোন পরিবেশ না থাকায় শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। ওইসময় কিছু কিছু শিশু শিক্ষার আগ্রহ দেখালেও স্থানীয়দের বাধার কারণে তা হয়নি। এমনকি পার্শ্ববর্তী চন্দনাইশ উপজেলার কয়েকটি স্কুলে এখানকার শিশুরা পড়তে গেলে তাদেরকে মারধরসহ স্কুল থেকে বের করে দিত। এইচএসসি পরীক্ষা শেষে রফিক ও ওয়াসিম চা বাগান এলাকা ঘুরতে গিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত শিক্ষার পরিবেশ দেখতে পাই। অর্ধশতাধিকেরও বেশি পরিবারের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত দেখে নিজ উদ্যোগে তারা শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করেন। বর্তমানে সেখানে শিশু শ্রেণি, ক্লাস ওয়ান, ক্লাস টু, ক্লাস থ্রি, ক্লাস ফোরে ১০৫ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ওয়াসিম বলেন, আমরা কয়েকজনে মিলে বিদ্যালয়টি দাঁড় করালেও বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত। পানি, শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক সংকট, আসবাবপত্র ও শিক্ষা উপকরণ সমস্যা সবচেয়ে বেশি। বছরে ২ থেকে ৩ বার বন্যহাতির উপদ্রবের কারণে শিশুরা প্রায়ই আতঙ্কিত। যার কারণে পড়ালেখায় তারা মনোযোগী হচ্ছে না। সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে এ শিক্ষাকে আরো ছড়িয়ে দিতে সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুজা আল মামুন জানান, হাতির উপদ্রব, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা ছাড়াও সেখানে চিকিৎসা সেবার কোন ব্যবস্থা নেই। যার কারণে এখানকার শিশুসহ নারী-পুরুষ বিভিন্ন রোগভোগে ভুগছে। সরকারিভাবে অন্তত মাসে দু’বার হলেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে খুবই ভাল হবে। সরকারিভাবে স্কুলের ভবণ নির্মাণসহ রাস্তা ঘাটের মেরামত করা হলে ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
চলছে দখল-বেদখল: টি এস্টেট (চা বাগান) এর বিশাল সম্পদ এখন বিভিন্নভাবে ভুমিদুস্যরা অবৈভাবে দখল করে নিচ্ছে। চা বাগানের এসব সম্পদ সরকারিভাবে কোন রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় যে যা পারে তা দখল করে নিচ্ছে। অবৈধ দখলকারীদের বসবাসরত লোকজন বাধা দিলে তাদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি ধমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখানে তারা পেয়ারা বাগানসহ বিভিন্ন খামার গড়ে তোলে।
পর্যটনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা: কর্ণফূলী নদী পার হলেই ‘পটিয়া উপজেলা’। ২২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে পটিয়া একটি বড় উপজেলা। গত ২ বছরপূর্বে পশ্চিম পটিয়ার ৫ ইউনিয়ন নিয়ে কর্ণফুলি উপজেলা গঠিত হয়। সাবেক মহকুমা ও পটিয়া বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, পুঁতি গবেষক মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদসহ দেশের খ্যাতনামা বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক গুণীজন ব্যক্তিত্বের জন্মভূমি। এছাড়া দেশের নামিদামী প্রায় অর্ধশতাধিক শিল্পপতি রয়েছে এ পটিয়ায়। পূর্বে পাহাড়, মধ্যখানে সমতল ভূমি, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর সব মিলিয়ে পটিয়া একটি সৌন্দর্য বেষ্টিত এক উন্নয়নশীল এলাকা। পটিয়ার পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ে উৎপাদিত হয় দেশের বিখ্যাত কাগজী লেবু ও উৎকৃষ্ট মানের পেয়ারা। পটিয়া সদর থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ (চন্দনাইশ সীমান্তে) দিকে রয়েছে ‘টি এস্টেট’। টি এস্টেটকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য সরকারি খাসভূমি। প্রায়সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন এখানে ভ্রমণে আসে টি এস্টেট ও প্রকৃতির দৃশ্যগুলো উপভোগ করার জন্য। তবে এখানে এখনো গড়ে উঠেনি কোন পর্যটন কেন্দ্র। স্থানীয়রা মনে করেন, টি এস্টেটের সম্পদগুলো কাজে লাগিয়ে পুনরায় টি এস্টেট চালুর পাশাপাশি এখানে একটি পর্যটন স্পট গড়ে তুললে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে। পটিয়া উপজেলা সহকারী ভূমি নির্বাহী কর্মকর্তা সাব্বীর রহমান সানি জানান, পটিয়া খরনার চা বাগান টি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে ২০১৫ সালে সুপেয় পানির জন্য ১টি গভীর নলকূপ বসানো হলে ও বর্তমানে অকেজো রয়েছে। এটি চালু করা হলে হাজারো লোকের চাকরি সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকারের লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আয় হবে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এখানে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রপ্তানি জোন করার পরিকল্পনা করছে।
এ ব্যাপারে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপি জানান, এই পটিয়া খরনার পরিত্যক্ত চা বাগান এলাকাসহ আশেপাশের পাহাড়ি এলাকা নিয়ে বিভিন্ন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্প জোন গড়ে তোলা হবে। একটি পর্যটন এলাকা করা হবে যাতে এলাকার লোকজন বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে এখানে বেড়াতে আসতে পারে। তাছাড়া হাইদগাঁও এলাকায় হাইড্রোলিক এলিবেটল রাবার ডেম ও আধুনিক কৃষি এগ্রো সেন্টার করা হবে। এগুলো স্থাপন হলে পাহাড়ি এলাকার আমূল পরিবর্তন হবে।