চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মানবতার ফেরিওয়ালা ইউএনও আছিয়া খাতুন

 মো. ফারুক ইসলাম

১০ এপ্রিল, ২০২০ | ১০:১৭ অপরাহ্ণ

দৈনিক পূর্বকোণের রমনীয় পাতায় “ সুঁই সুতোয় স্বপ্ন বুনন- অতঃপর সংগ্রামী আছিয়া খাতুনের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প” শিরোনামে একটি ফিচার প্রকাশিত হয়। ফিচারটি প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। একজন সাধারণ মানুষ জীবনের প্রতিক‚লতার সাথে লড়াই করে কিভাবে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারেন এমন গল্প পড়ে অনেকেই সেদিন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

সেদিন আমার ফেসবুক মেসেঞ্জারের ইনবক্সটা ভরে গিয়েছিল শুভাকাক্সক্ষীদের শুভেচ্ছায়। কারণ এমন বাস্তব ও জীবনমুখী কাহিনী সেদিন অনেকের চোখে জল ঝরিয়েছিল। আর প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নির্দ্বিধায় জীবন সংগ্রামের গল্পটা পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারেন সেটা দেখে সেদিন অনেকেই হতবাক হয়েছিলেন। এমনকি অনেকের কাছে ছিল অতি অনুপ্রেরণার গল্প।

হ্যাঁ, আবারো সেই সংগ্রামী মানুষ বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আছিয়া খাতুনকে নিয়ে দু’কলম লিখতে বসলাম। না, ওনাকে খুশি করতে এই লেখা নয়। দেশের এক চরম ক্রান্তিকালে মানবতার এই ফেরিওয়ালার আরেক সংগ্রামের গল্প লিখছি। বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদান করেছেন তিন বছর হয়েছে। এই তিন বছরের মধ্যে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে ছিলেন ৬ মাস। ছুটি থেকে ফিরে পুরোপুরি নিজের কর্মে মনোনিবেশ করলেন।

স্বনামধন্য শিক্ষকের মেয়ে হওয়ার কারণে হয়তো জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে তিনি মানবসেবাটাকে পরম ধর্ম হিসেবে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সে সাথে জীবনের সাথে লড়াই করে এই পর্যায়ে আসা এবং বর্তমান কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখাটার অনুপ্রেরণাটা তিনি হয়তো অতীতের সেই সংগ্রামী জীবন থেকে পেয়েছেন।

সারাবিশ্বে এখন এক আতঙ্কেও নাম করোনাভাইরাস! যে ভাইরাসের কারণে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সেসাথে স্তব্দ হয়ে গেছে পৃথিবীর মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে হানা দেয় প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাস। সরকার এই ভাইরাসের সংক্রমণরোধে তখন থেকেই তৎপর। জনসচেতনতায় শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রম। সারাদেশের মতো বোয়ালখালী উপজেলা প্রশাসনও মাঠে নেমে পড়ে প্রাণঘাতী এই মহামারী থেকে মানুষকে রক্ষার কাজে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্য তখন থেকেই বোয়ালখালীর প্রতিটি ইউনিয়ন চষে বেড়াচ্ছেন ইউএনও আছিয়া খাতুন।

সরকার যেখানে মানুষকে ঘরে থাকতে বলছেন, সেখানে প্রশাসনের লোক হওয়ার দরুণ তিনি নিজের জীবনের সুরক্ষার কথা না ভেবে নিজ কর্মস্থলের মানুষের জীবনের সুরক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জনসচেতনতায় লিফলেট বিতরণ থেকে শুরু করে সরকারি ত্রাণ সঠিকভাবে বিতরণ, বাজার মনিটরিং, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বিদেশ ফেরত মানুষের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা সহ বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষ যেখানে নিজের জীবনের কথা ভেবে ঘরে বসে থাকার চিন্তায় ব্যস্ত, সেখানে প্রশাসনের একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর এই সুযোগ নেই।

বাসায় রয়েছে ছোট দুই সন্তান। ছোট শিশুটিকে বাসায় রেখে বোয়ালখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে যাচ্ছেন তিনি। তবে এই ছুটে চলার মধ্যে নেই কোন ক্লান্তি। নেই কোন অবসর। অথচ পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যাচ্ছে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। একজন মানুষ আক্রান্ত হওয়া মানে তাঁর পুরো পরিবার ঝুঁকির মধ্যে পড়া। কিন্তু এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন । জাতির এই দুর্যোগ মুহূর্তে ইউএনও আছিয়া খাতুনের এই কর্মতৎপরতা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এই গেলো করোনা পরিস্থিতির বিষয়।

এবার আসি বোয়ালখালীর শিক্ষার মানোন্নয়নে ইউএনও আছিয়া খাতুনের কিছু অবদান নিয়ে। মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ করে কর্মস্থলে যোগদান করে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে তিনি বোয়ালখালীর প্রতিটি ইউনিয়নের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করতে শুরু করেন। যেসব বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে সেগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে উপজেলা প্রশাসন থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। কোথাও বেঞ্চের সমস্যা হলে সেখানে নিজ উদ্যোগে বেঞ্চের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধনে প্রত্যেক বিদ্যালয়ের সামনে ফুলের বাগান করার জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিটি বিদ্যালয়ে শতভাগ মিড ডে মিল চালু রাখা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার নিশ্চিত করেছেন। উপজেলার স্কাউটিংয়ে এনেছেন গতিশীলতা। ইতিমধ্যে কাব স্কাউটের ওরিয়েন্টেশন, বেসিক কোর্স, কাব হলি ডে, স্কাউট সমাবেশসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। সে সাথে নিজেও নিয়েছেন স্কাউটিংয়ের উপর প্রশিক্ষণ।

শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিয়েছেন হারমোনিয়াম। চালু করেছেন নৈতিকতা শিক্ষার ডায়েরি ও সৃজনশীল মেধা অনেষণ প্রতিযোগিতা। প্রাথমিক শিক্ষকদের মাসিক সমন্বয় সভায় উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার কথা কাছ থেকে শুনছেন এবং তা সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে যারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন তাদের দিচ্ছেন সম্মাননা। শুধু প্রাথমিক নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নেও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি উপজেলা চত্বরকে সাজিয়েছেন নতুন আঙ্গিকে। ফুলের বাগানে ভরিয়ে তুলেছেন উপজেলার চারপাশ। ইতিমধ্যে এই সংগ্রামী কর্মকর্তার নানা উদ্যোগের কারণে তিনি বোয়ালখালীর মানুষের মনে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর প্রতিটি মহৎ কাজের জন্য বোয়ালখালীবাসী তাঁকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসাচ্ছেন। হয়তো কোন একদিন পদোন্নতি পেয়ে তিনি বোয়ালখালী থেকে অন্যত্র চলে যাবেন। কিন্তু তাঁর কর্মই তাঁকে বোয়ালখালীবাসীর কাছে অমর করে রাখবে।

লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক

 

 

 

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট