চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

হারিয়ে যাচ্ছে নাইওর সংস্কৃতি
হারিয়ে যাচ্ছে নাইওর সংস্কৃতি

হারিয়ে যাচ্ছে নাইওর সংস্কৃতি

নূর আঙ্গেস

১১ মার্চ, ২০২০ | ১:৩৭ পূর্বাহ্ণ

“নাইওর” শব্দটির সাথে অদ্ভুত এক অনুভূতি মিশে আছে। এই প্রজন্ম যদিও এই শব্দের সাথে কতটুকু পরিচিত তা ভাববার বিষয়। কারণ এখন আর নাইওর যাওয়ার প্রচলন আর নেই। নাইওর মানে বিয়ের পর মেয়েরা বাপের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসাকে বলা হয়। এই নাইওর যাওয়ার আবার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম আছে। যেমন ভাদ্র কাটানি, জোড়া মাসের নাইওর, প্রথম সন্তান হওয়ার পর নাইওর এমন আরও অনেক নাইওরের নাম আছে।
“মাগো তুমি নিয়ো নাইওর এক হপ্তা পরে
ভাই-বোনেরে পাঠায় দিও আমার নতুন ঘরে”।
নাইওর নিয়ে এমন প্রচুর গান লেখা হয়েছে যা থেকে সে সময়ের সামাজিক জীবনের চিত্র ফুটে উঠে। সে সময় নারীদের জীবনে না ছিল শিক্ষা না মূল্য। পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে তাকে জীবন কাটাতে হয়েছে অনেকটা প্রতিবাদহীন জড় বস্তুর মতো। সমাজের অধিপতি যারা তাদের নির্দেশিত আদেশ মেনে চলতে হতো। একজন নারী বিয়ের পর সমস্ত অধিকার ছেড়ে স্বীয় বাড়িতে নিজের বাবা মায়ের কাছে আসতো অতিথির মতো। যখন তখন তার আসার ক্ষমতা ছিল না। বাপের বাড়িতে আসাকে বলতো নাইওর। এই নাইওর আসার জন্য তার থাকতো স্বপ্ন। বছরের পর বছরও চলে যেত শ্বশুর বা শাশুড়ির অনুমতির জন্য। চোখের জলে বাপের বাড়িতে চিঠি দিত লুকিয়ে একটু নাইওর নেওয়ার জন্য। এখন মেয়েরা ভাবতেই পারে না এই করুণ জীবনের কথা। যেহেতু মেয়েরা তাদের ইচ্ছানুযায়ী যখন তখন আসতে পারতো না তাই বোধহয় কিছু নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল যে সময়ে বলা হতো মেয়েদের এ সময়টাতে শ্বশুর বাড়িতে থাকতে নেই। বাপের বাড়িতে নাইওর যেতে হয়। এই নিয়ম যদি না থাকতো তবে যে নারীদের কি অবস্থা হতো তা ভাবলে চোখের জল ধরে রাখা দায়। সেই যে বালিকা বয়সে জুবুথুবু হয়ে স্বামীর ঘরে ঢুকে তারপর লাশ হয়ে ঘরের বাইরে আসতো। এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়। এ গেল দুঃখের কথা। এতকিছুর পরও নাইওর শব্দটির মধ্যে মধুর এক সুখের অনুভূতি যেন জাগে। বাপের বাড়ি যাবে বধূ। কতো আনন্দ, সুখের স্বপ্ন। ব্যাগ, স্যুটকেস গোছায় কতদিন থেকে। বাবা-মায়ের মুখ দেখেনি কতোদিন। ছোট ভাইটা না জানি তার জন্য কেঁদে কেঁদে দিন কাটাচ্ছে। আবার তার জীবনে
আসা নতুন মানুষটির জন্যও বুকের কোথাও একটু ব্যথা। নির্দিষ্ট দিন এসে গেলে নতুন শাড়ি পড়ে পাল্কি চড়ে বধূ চলছে তার বাপের বাড়ি। পথে যেতে যেতে পাল্কির পর্দা তুলে বার বার তাকায় আর কতদূর বাবার বাড়ি। এই যে সুখানুভূতি তার সাথে এখনকার মেয়েদের অনুভূতি আকাশ পাতাল ব্যবধান। কোনটা ভালো উত্তর দেওয়া শক্ত। সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, দেশ, রীতি, সমাজ সবকিছু বদলায়।
ঐ যে কিশোরী নববধূর সলাজ মুখ, স্বপ্ন বিভোর আকুলতা মনের কোথাও যেন না ঘা দেয়। তার সাথে এখনকার শার্ট প্যান্ট পরা নববধূর বাস্তব কঠিন চেহারা দাগ ফেলে না। কিন্তু এও একদিন ভাবনাকে আর দোলায়িত করবে না। একদিন আমাদের প্রজন্ম থাকবে না। নতুন প্রজন্ম যারা তারা তো নাইওর কি, কেন, কারা যায় এ তো অজানা। যদি কেউ জানতে চায় তবে ইতিহাসের পাতা থেকে জেনে নেবে তার কোন গবেষণার কাজে। কালচক্রের পরিক্রমায় সবই হারায় একে একে। আজ যা নতুন কাল তা পুরাতন, পরশু সে হয়ে যায় ইতিহাস।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট