আমরা মেয়েরা প্রায়ই বলি, আহ্ ! ছেলেদের জীবন কত্ত ভালো, ইচ্ছেমত ঘুরতে পারে আড্ডা দিতে পারে, রাতে বাইরে বেরুনো কোন ব্যাপার না, স্বাধীনভাবে যা ইচ্ছা তা করতে পারে কোন বাধা নিষেধ নেই। আর আমাদের মেয়েদের বেলায় যতো বাধা নিষেধ আর নিয়ম কানুন!
আজ আমার কিছু ভাবনা শেয়ার করি ছেলেদের জীবন নিয়ে। পড়ে হয়তো অনেক মেয়ের মেজাজ খারাপ হতে পারে আর কারো ধারণা ছেলেদের জীবন সম্পর্কে কিছুটা পাল্টাতে পারে। স্বাধীনতা, আড্ডা, ঘুরাঘুরি এগুলো কিন্তু সব ছেলের জীবন নয়, যেমন সব মেয়ের জীবন মানেই দুর্দশা নয়। বেশীর ভাগ মেয়ের জীবন যেমন অন্যের জন্য বাঁচা তেমন বেশীর ভাগ ছেলেদের জীবন মানে একটা সংগ্রাম, একটা গল্প, অনেক ত্যাগ ও অনেক কম্প্রোমাইজ।
জন্মের পর থেকে ছেলেদের মাথায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বীজ ঢুকিয়ে দেয়া হয়, প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে সমাজে মর্যাদা থাকবে না, ভালো চাকরী পাওয়া যাবেনা, কোন বাবা তার মেয়েকে বিয়ে দিবেনা। যা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সত্য।
ছেলেরা পরীক্ষার ফেল করলে তার অবস্থা সহজেই বোধগম্য , অনেক ছেলেকে ফেল করার অপরাধে পড়া ছাড়তে হয় বা সংসারের হাল ধরতে হয়। আর আমরা মেয়েরা কোন মতে পাশ করলেও সমস্যা নাই কারণ চাকুরী তো বাধ্যতামূলক নয়। আরো সহজ সমাধান ফেল করলে আর সুন্দরী হলে বিয়ে দেয়া। মেয়েরা সুন্দরী হলেই তার জন্য রয়েছে প্রতিষ্ঠিত বিসিএস ক্যাডার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। আর সেই পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করা সুন্দরী মেয়েটি স্বামীর পদবী স্টাটাস বা টাকার জোরে সমাজে পাচ্ছে মর্যাদা , ঘুরছে দেশ বিদেশ।
আর ছেলেদের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য্য হল তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, তার চাকুরীর অবস্থান, তার পারিবারিক পরিচয় ও সর্বোপরি টাকা। এসব থাকলে তার জন্য রয়েছে হাজারো রাজকন্যা , সুন্দরী ও চটকদার পাত্রী।
আজকাল টাকা ছাড়া ছেলেরা প্রেম টাও ভালো ভাবে করতে পারেনা। ভাগ্য ভালো হলে একজন দুজনের প্রেম রয়ে যায় বা সফল হয় । টাকা না থাকলে সুইট #বাবু কে ধরে রাখবার কষ্টটা অনেক সুইট গার্ল করেনা আজকাল। সব কিছুর জন্য দরকার টাকা, টাকার জন্য দরকার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, আর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ছেলেদের করতে হয় অনেক অনেক সংগ্রাম।
আমাদের সমাজে মনে করা হয় ছেলেরা হল আজকালকার এটিএম মেশিন, কার্ড ঢুকিয়ে দিলাম আর বের হবে রাশি রাশি টাকা। ছেলেদের সম্মান হল টাকা, ভালোবাসার প্রকাশ হল টাকা। টাকা নাই তো দাম নাই। একটি ছেলেকে জন্মের পর থেকেই ত্যাগ করতে হয়। কি ত্যাগ করতে হয় ? অধিকাংশ ছেলেকে মাকে ভালোবাসবার যে প্রকাশ ভঙ্গী তা বদলাতে হয় বিয়ের পর কারণ তা না হলে অনেক বউ খুশী থাকেনা। আমার দেখা এক বিবাহিত ছেলে বিধবা মাকে একা ছেড়ে নিজের বাড়ীতে চলে যাওয়ায় জেগে রাত কাটিয়েছে মায়ের চিন্তায়, অপরাধ বোধে। অনেক ছেলে বৌকে খুশী করবার জন্য ত্যাগ করে মাকে বাবাকে, অনেক ছেলে মাকে খুশী করবার জন্য ত্যাগ করে বউকে, অনেকে দুই এর টানা পোড়নে হয় দিশেহারা। অনেকে ছাড়ে বন্ধু বান্ধব, নিজের শখ, নিজের মতো করে কিছু সময় কাটানোর ইচ্ছা । অনেক সময় তার কিছু অনুভূতি, সুপ্ত আনন্দ আর স্বপ্ন গুলোকে সে বিসর্জন দেয়। সারাজীবন পড়াশুনা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করে ছেলেরা। আর তার সুফল ভোগ করে মা, বোন, বউ বা অন্য কেউ। বেশীর ভাগ ছেলে খোঁজ নিয়ে দেখবেন সবচেয়ে কম বাজেট রাখে নিজের জন্য যে কোন আনন্দ উৎসবে।
ছোটবেলা থেকে ছেলেদের কাঁদতে মানা করা হয়, কারণ ছেলেদের চোখের জল মানে সে দুর্বল চরিত্রের মানুষ । জন্মের পর থেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার তাড়নায় সে পার করে তার জীবন। তারপর পরিবার, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কখনো ছোট ভাই, বোন বা কখনো ভালোবাসার মানুষ, কখনো জীবন সঙ্গিনীর জন্য জীবনের সবটুকু দেয়ার চেষ্টা করে ছেলেরা। তাদের থাকতে নেই কোন অনুভূতি, থাকতে হবে শুধুই দ্বায়িত্ববোধ । অনেক ছেলেকে দেখেছি প্রতি মুহুর্তে স্ত্রীর সন্দেহের তীরের নীচে চাপা পরে থাকতে। আমরা মেয়েরা স্বাধীনতা চাই, সে স্বাধীনতা তাদের ও চাই সেটা আমরা ভুলে যাই। ।
হ্যা, আমি স্বীকার করছি ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশী প্রিভিলেজড অনেক ক্ষেত্রে । কিন্তু তাকে যে কর্মক্ষেত্রে , সংসারে যে মানসিক চাপের ভিতর দিয়ে জীবন পার করতে হয় তা আমরা ভাবিনা!
এক জীবনে বাবা মায়ের দুটো রোল প্লে করতে যেয়ে দেখেছি কর্মক্ষেত্রে কি বিশাল মানসিক চাপ নিতে হয় একজন ছেলেকে যা আমাকেও নিতে হয়েছে । কারন অনেক মেয়ের মতো চাকুরীটা আমার অপশনাল ছিলো না । চাকুরীটা ধরে রেখে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়েছে টিকে থাকবার জন্য কারণ চাকুরীটা দিয়ে আমি বাবার রোল প্লে করেছি । ছেলেদের পড়াশোনা ও অনান্য দায়িত্ব পালন করেছি । ঐ বাবা নামক ছেলেটাও তাই করে।
পরিবার আর বউ বাচ্চাদের কথা ভেবেই পাড়ি দেয় বিদেশে একা! আহা কি কষ্ট করে তারা বলবার মতো নয়। নিজে দেখেছি ১৪৯০ স্কয়ার ফিট বাড়িতে আমি একা থাকি আর কারো ছেলে, কারো ভাই কারো বাবা, কারো স্বামী নামক ছেলেটি ১০০০ স্কয়ার ফিট ফ্লাটে ৮ জনে শেয়ার করে বিদেশে। কারন বাবা মা, পরিবার, সন্তানের স্কুল কলেজের চিন্তা মাথায় ঘোরে তাদের । অনেকের পরিবার থেকে চাকরিস্থলে অনেক দূরে থাকে, কাজের বুয়ার রান্না, একাকী বিষণ্ণতা আর কোনো জেলা/উপজেলায় জার্নি করতে করতে কখন কোন অসুখ বাঁধে খেয়ালও থাকে না।
বাবা মার মুখ উজ্জ্বল করতে যে ছেলেটার ছোটবেলায় যে সংগ্রাম শুরু সেই সংগ্রাম যৌবনকাল আর শেষ বয়সে এসেও সন্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে যেন আর শেষ হয় না। তবুও এই সমাজ আর আমরা মেয়েরা বলি আহা ! ছেলেরা কত স্বাধীন।
তবে সময় পাল্টেছে, মেয়েদের মতো ছেলেরাও এখন অনেক স্বাধীন বিশেষ করে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা। সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে, বেড়েছে ভুল বোঝাবুঝি ।
লেখাটি হয়তো সব ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য নয় । তবে আমার দেখা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অনেক ছেলের জীবন এমন । সুস্থ হোক সমাজ সুস্থ্ হোক মানসিকতা ছেলে মেয়ে উভয় পক্ষের, ভালো থাকুক ছেলেরা আর মেয়েরা ।
লেখক: হাফিজারীনা
পূর্বকোণ/এএ