চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রবীণদের চাওয়া সুস্থতা আর স্বাধীনতা

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ৮:১৫ অপরাহ্ণ

চাকরি থেকে অবসর নিয়ে টরোন্টতে বসবাস শুরু করার পর থেকেই ব্যস্ততম জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্ত্রীর সাথে নিরিবিলি বসবাসে অভ্যস্ত হতে থাকি। নিজের মেয়ে এবং আপন ছোটভাইয়ের বাসা ছাড়া বাঙ্গালী কমিউনিটিতে তেমন চলাফেরা করি না। স্বল্প পরিসরে নিজের বলয়ে অবসর জীবন নিজের মতো করে কাটাতে ভালই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। টুকটাক ঘরের কাজ করে, টেলিভিশনে সব ধরনের খেলা দেখে ও খবর শুনে বেশিরভাগ সময় পার হয়ে যায়। এছাড়া প্রতিদিন হাঁটাচলা করা এবং ফেসবুক ও ইউটিউব অনেকটা সময় নিয়ে নেয়।

আজকাল দুপুরে খাবার পর কিছু সময় ঘুমোনো আমার নতুন বিলাসিতা। আমার মনে হয় কানাডার মতো জায়গায় চলাফেরার শক্তিসম্পন্ন বয়স্ক লোকদের মোটামুটি অসুবিধা হবার কথা নয়। তবে একাকিত্ব ও বিষন্নতা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার । বিভিন্ন কারণে এটা বয়স্ক লোকদের জীবনে আসতে পারে। নিজে এই দুটোর কোনটার সাথেই এখন অবধি মুখোমুখি না হলেও হঠাৎ এ বিষয়ে লিখছি কেন? এমন একটি প্রশ্ন অনেকের মাথায় আসতে পারে।

এখানে আমার একটা নাতি আছে। আমার মেয়ের ছেলে। ওরা টরেন্টোর ডাউন টাউনে থাকে। আমি থাকি স্কারবরোতে। দূরত্ব তিরিশ কিলোমিটার। নাতির বয়স পাঁচ বছরের কিছু বেশী। এ পর্যন্ত সে কখনো একা আমাদের বাসায় থাকেনি। এবার আমার মেয়ের শারিরীক অসুস্থতার জন্য হসপিটালে থাকার কারণে তাকে দুদিন আমাদের বাসায় রেখে যায়। নাতী দারুণ খুশি। করোনা ভাইরাসের কারণে ন্যানী আসে না । স্কুলেও যেতে পারে না। বাসায় আবদ্ধ থেকে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল । আমাদের সঙ্গ পেয়ে খুব খুশি। কিন্তু সে আমার সব রুটিন লণ্ডভণ্ড করে দিল। তার নিজের স্মার্ট ফোন ও ট্যাবলেট নিয়ে এসেছে। তবুও সে আমার আইপ্যাড দখল করে নিল। কারণ সে একটা মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট apps ডাউন লোড করতে চায়। এই apps তার android প্যাডে নেই৷ শুধুমাত্র iOS system এ আছে। আমার এই বয়স অবধি কম্পিউটার জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য iPhone, ipad ও ল্যাপটপ নিয়ে কোনো সমস্যা হলে বাংলাদেশে আমার পুরোনো সহকর্মী মেহেদি, সিরাজ, আমানুরকে সময় অসময়ে বিরক্ত করি। পৌনে ছয় বছরের ছেলে অর্থাৎ আমার নাতী অপারেটিং সিস্টেমের পার্থক্য জানে এবং App Store থেকে নিজে মিউজিক app ডাউন লোড করলো। শুধু আমাকে বাধ্য করলো আমার password দিতে । ভয় দেখালো না দিলে উল্টা পাল্টা password দিয়ে ipad লক করে দেবে।

তাকে সঙ্গ দেবার জন্য আমাকে টেলিভিশন দেখতে দিল না। আমার দৈনন্দিন রুটিন সব এলোমেলো হয়ে গেলো। ও চলে যাবার সময় বললাম তুমি চলে গেলে আমার মন খারাপ হবে। ও কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো, I know, old people are lonely and sad.
ওর কথাটা আমাকে হঠাৎ করে একটা ধাক্কা দিল। এতটুকু ছেলের মধ্যে এই উপলব্ধি এলো কি করে! সে আমাদের সব সময় আনন্দঘন পরিবেশে দেখেছে । আমাদের দুজনকে ছাড়া কাছ থেকে সে অন্য কোনো বয়স্ক লোককে খুব কম দেখেছে । এটা কি সে স্কুল থেকে জেনেছে? নাকি তার আত্মোপলব্ধি?

এদেশের বয়স্ক লোকেরা বেশ লোনলি । ওদের কাছে শুনেছি ওরা নাতি নাতনির সঙ্গ চায়। কিন্তু খুব কাছে পায় না। ওদের সমাজ ব্যবস্থায় পারিবারিক বন্ধন আমাদের দেশের মতো নয়। ছেলে মেয়েরা একটু বড় হলেই আলগা হতে থাকে। কিন্তু আমাদের অঞ্চলের লোকদের কথা আলাদা। আমরা এখানে যারা বাস করি তারা একটা মধ্যম অবস্থায় আছি । বেশিরভাগ লোক ছেলে-মেয়ে নাতি- নাতনি থেকে আলাদা থাকি। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়। আমার মনে হয় বৃদ্ধবয়সে ছেলে মেয়েদের থেকে আলাদা বসবাস করা শ্রেয়। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ে আলাদাভাবে বসবাস করলে অনেক অশান্তি থেকে দূরে থাকা যায়।
আজকাল এখানে ছোট ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা করার জন্য অনেকে দেশ থেকে বাবা মাকে নিয়ে আসেন। ভারতীয়দের মধ্যে এই প্রবণতা খুব বেশি। বাংলাদেশীরাও হয়তো এমনটি করে থাকেন।

আমি যেখানে বাস করি সেখানে অনেকগুলো হাইরাইজ বিল্ডিং এর মাঝে ছোট্ট একটা পার্ক রয়েছে। সেখানে ভারতীয় বয়স্ক লোকদের সাথে ওঠাবসা করার সুবাদে তাঁদের অনেক অসুবিধা ও মনোকষ্টের কথা জানতে পেরেছি। তাঁদের সাথে আলাপে বুঝতে পেরেছি, স্বল্প সময়ের জন্য নাতি- নাতনিদের নিয়ে আনন্দ করা আর বৃদ্ধ বয়সে দায়িত্ব নিয়ে নাতি- নাতনির দেখভাল করা এক কথা নয়। দেশের খোলামেলা পরিবেশ ছেড়ে এখানকার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে অনেক লোকের বসবাসে অনভ্যস্ত এঁরা নানা ধরনের অশান্তিতে ভোগেন। প্রতিনিয়ত দেশে ফেরার জন্য দিন গোনেন।
দেশেও আজকাল অনেক বয়স্ক লোকের নাতি- নাতনির দেখ-ভাল করতে হয়। তাঁদের মানসিক অবস্থার কথা আমার জানা নাই। তবে অনুমান করি তাঁদেরও অনেক অসুবিধা হবার কথা।

একসাথে বাস করার বড় অসুবিধা হলো বুড়ো মানুষের মন- মানসিকতার অমিল। জেনারেশনগ্যাপের কারণে এ পার্থক্য হতে বাধ্য। একসাথে বাস করলে এই সমস্যা প্রকট হতে পারে। বিশেষ করে অন্য পরিবার থেকে আসা ছেলের বউয়ের সাথে। আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে বাস করা আরো কঠিন।
সুস্থ শরীরে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে চলাতেই বয়স্কলোকদের শান্তি। অসুস্থ হয়ে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে বাস করা খুবই কঠিন।
অনেকের ভাবনা আমার থেকে ভিন্ন হতে পারে। অনেকে মনে করতে পারেন বুড়ো বয়সে নাতী-নাত্নী নিয়ে বসবাস করাই আনন্দ। মতামত ও উপলব্ধির ভিন্নতা থাকতেই পারে।

আমার মনে হয় বয়স্ক লোক সত্যিকারভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে যখন স্বামী অথবা স্ত্রীর বিয়োগ ঘটে।

 

লেখক: মো. আমিনুজ্জামান, সাবেক ব্যাংকার, টরেন্টো, কানাডা

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন