চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মরণোত্তর স্বর্ণপদক নয়

ফারজানা আজিম

১৫ জুলাই, ২০২০ | ১:২৫ অপরাহ্ণ

আমাদের সমাজে মরণোত্তর স্বর্ণ পদক প্রদানের রীতি চালু আছে অনেক দিন থেকেই, সেটা ছিল এক রকমের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু হাল ফ্যাশনে এই মরণোত্তর স্বর্ণ পদক প্রদানের রীতিটা ঢুকে পড়েছে আমাদের পারিবারিক জীবনেও।

মরণোত্তর স্বর্ণ পদক বলতে সাধারণভাবে আমরা এটাই বুঝে থাকি যে, একজন মানুষকে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বেঁচে থাকাকালীন সময়ের সব ভালো কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে তাঁর সেই সমস্ত ভালো কাজের স্বীকৃতি দেয়া, যা সে বেঁচে থাকতে পায় নি।

আমার কাছে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে হয়। জানিনা আপনাদের কী মনে হয়? যে মানুষটা সারা জীবন কষ্ট করে গেলো সে বেঁচে থাকতে আমরা তাঁকে কোন প্রকার স্বীকৃতি দিতে পারিনা, কোন মূল্যায়ন করিনা, তাঁকে বা তাঁর কাজকে।

মানুষটা হয়তো বেঁচে থাকতে চেয়েছিল কেউ মূল্যায়ন করুক তাঁকে বা তাঁর কাজকে, কিন্তু সুবিধা ভোগী এই আমরা আমাদের স্বার্থ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে, সারা জীবন বা সারাক্ষণ আমাদের সুবিধা দিতে তিনি নিজেকে এমনভাবে উজার করে দিয়েছে যে, নিজের দিকে ফিরে তাকানোর সময় বা সুযোগ কোনটাই তাঁর হয় নাই। আর আমরা তাঁর দেয়া সমস্ত সুবিধাসমূহ এমনভাবে ভোগ করছি , সুবিধার জোয়ারে এমনভাবে ভেসে গেছি যে, তাঁর দিকে ফিরে তাকানোর সময় বা তাঁর কথা ভাবার সময়ও পাই না। কিন্তু যেই সেই মানুষটা চলে গেল, বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত সুবিধা, ওমনি আমাদের টনক নড়লো, শুরু করলাম তাঁকে নিয়ে ভাবতে, বিলাপ করে কাঁদলাম, বড় করে শোকসভা করলাম, অনেক গরু দিয়ে হাজার হাজার মানুষ খাওয়ালাম, আসলে কী তাঁর জন্য? নাকি তাঁর কাজ থেকে পাওয়ার সমস্ত সুবিধা বন্ধ হলো বলে? যাই হোক এটা মোটেও কাম্য নয়।

কেন এমন হয়না, আমরা সময় মত মানুষকে মূল্যায়ন করিনা? আসলে তাঁর মৃত্যুর পর আমরা তাঁকে মনেও করি না, মূল্যায়নও করিনা। তাঁর নামে নিজেদেরকে হাজির করে তাঁকে আরো ছোট করে দিচ্ছি যা, সে বেঁচে থাকতে হর হামেসাই করতাম। ঠিক সেই তাজমহলের কাহিনীর মত। আপনার কি তাজমহলের আসল সত্যটা জানেন? বলুন তো তাজমহল কিসের প্রতীক? ভালোবাসা না অত্যাচারের? থাক সেই সত্য না হয় আরেক দিন বলব।
যেই মানুষটা দুনিয়াতেই নেই, তাঁকে স্বর্ণ পদকের মত পুরষ্কার বা খেতাব দিয়ে কি হবে? এই দাবি স্বর্ণ পদকের বদলে যদি সে বেঁচে থাকতে তাঁকে একটু স্বীকৃতি দিতাম, তবে সে কি খুশী হতোনা? সেকি উপভোগ করতে পারতো না, তার সেই স্বীকৃতি?

তাই বলি মানুষের মৃত্যুর পর তাকে স্বর্ণ পদক দিয়ে নয়, কাউকে হারিয়ে বুঝে নয়, বেঁচে থাকতে মানুষকে মূল্যায়ন করুণ, তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দিন, তাকে স্বীকৃতি দিন, সে খুশী হবে। একটা মানুষ জীবনে হয়তো এটাই চায়, কিন্তু আমাদের সমাজের ঠকবাজেরা এমন হয়েছে যে, মৃত্যুর আগেও পরে দুইভাবেই তাদের ব্যবহার করে।

মৃত্যুর আগেও তাকে ব্যবহার করেছে আর মৃত্যুর পর তার জন্য শোকসভা করে বা শোক প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে প্রচার করেছে, এটা কিছুতেই কাম্য নয়।
তাই সঠিক সময়ে আমাদের সঠিক কাজটা করা উচিত।

যে মানুষটা সারাজীবন একটু আদর, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতার কাঙ্গাল ছিল, পেয়েছে তার বদলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। মৃত্যুর পর তার জন্য কি প্রয়োজন বিলাপ আর শোকসভার? কি লাভ তা করে? এই নির্মম অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হলে চাই সুস্থ্ পারিবারিক ব্যবস্থা, সুস্থ্ পারিবারিক শিক্ষা। কারণ পরিবারই মানুষ তথা সমাজ গঠনের একমাত্র অন্যতম প্রতিষ্ঠান। যেখান থেকে বের হয় ‘‘মানুষ বা অমানুষ’’।

সময় থাকতে যদি আমরা আমাদের সম্পর্কগুলোর প্রতি একটু যত্নবান হই, তবেই যথেষ্ট, এর বেশী কিছুই নয়। তখন আমাদের আর মরণোত্তর স্বর্ণ পদক প্রদানের মত অপ্রয়োজনীয় কাজটা করতে হবে না। বেঁচে থেকেই আমরা উপভোগ করতে পারবো আমাদের স্বর্ণ পদকটাকে। সেটা কি ভালো হতো না, কি ভাবছেন স্বার্থপর পরিবারের সদস্যরা ও এই নির্মম সমাজ ব্যবস্থা?
– সাবেক ব্যাংকার

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট