চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাবা: যেকথা হয়নি বলা-

অনলাইন ডেস্ক

২১ জুন, ২০২০ | ৩:০৭ অপরাহ্ণ

আজ বিশ্ব বাবা দিবস। প্রতিবছরের জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বজুড়ে বাবা দিবস পালিত হয়। ১৯১০ সালে আমেরিকার সেনারা লুইস সর্বপ্রথম বাবা দিবসের সূচনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্হায়ীভাবে বাবা দিবসের স্বীকৃতি দেন। সেই থেকে সারা বিশ্বে বাবা দিবস বলা চলে স্বপ্রণোদিত হয়ে চলে আসছে। 

বাবা দিবস উপলক্ষে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রিয় বাবার উদ্দেশ্যে অনুক্ত কিছু কথা তুলে ধরেছেন। পূর্বকোণ পাঠকদের জন্য নির্বাচিত কয়েকটি লেখা উপস্থাপন করা হল।

 

আমার আব্বা, আমার সুপার হিরো

ফরিদা ইয়াসমিন সুমি

 

আমার সবসময় মনে হয়, আমি বোধহয় ছোটবেলা থেকেই আব্বার প্রশ্রয় এবং প্রশংসা একটু বেশিই পেয়েছিলাম। আর তাতে করে কিছুটা আহলাদি, আরামপ্রিয়, ন্যাকা, ফাঁকিবাজ আর অহংকারী হয়ে উঠেছিলাম (পরে অবশ্য কঠিন বাস্তবতায় সব ধুয়েমুছে গিয়েছিল)।
সবচে’ বড় যে শিক্ষাটা পেয়েছি তা হলো, ছেলে, মেয়ে নয়, যোগ্যতার মাপকাঠিতে মানুষকে বিবেচনা করা।
আব্বাকে কখনও কটুকথা বলতে বা গালি দিতে শুনি নি, চালাকি করতে দেখি নি।
আব্বার সুবাদে ১৪/১৫ বছর বয়সের মধ্যেই দেখা হয়ে গিয়েছিল অসাধারণ সব মুভি!

ছুটির দিনে ঘুম থেকে তুলতে আব্বা জোরে জোরে বলতেন, ‘আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ, মেইকস আ ম্যান হেলদি, ওয়েলদি এন্ড ওয়াইজ’।
কবিতা বলতেন, ‘বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লীমায়ের কোল’…
আমিও আব্বার সাথে তাল মিলাতাম। কবিতার প্রতি দুর্বলতা ছিল ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু সকাল সকাল ঘুম থেকে তুলে দেবার জন্য অনেকসময় খুব বিরক্ত হতাম। আহা! এখন, মিস করি সেসব দিন।

জীবনে যেটুকু এসেছি তার পেছনে আব্বার প্রশ্রয়, প্রশংসা আর শিক্ষা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে আমার বিশ্বাস।

কয়েকটা ”প্রশ্রয়” শেয়ার করছি-

১) ‘এই মেয়েটা দায়িত্ব নিতে চায় না ঠিকই কিন্তু দায়িত্ব দেয়া হলে তা সুচারুভাবে সম্পন্ন করে।’

২) ‘অন্যদের চেয়ে তুমি অনেকটাই আলাদা।’

৩) বয়োসন্ধিকালে যখন একটু একটু রূপচর্চা শুরু করছিলাম, আব্বা বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘ মা, রে, তোর কী আরও সুন্দর হওয়া দরকার?’ বলাবাহুল্য, এরপর থেকে আয়নায় নিজেকে খুব সুন্দর দেখতাম।

৪) আমার মেয়ের জেদ দেখো, ৭ম থেকে ৮ম শ্রেণিতে ওঠার সময় গণিতে ১০০ তে ০৮ পেয়েছিল, এসএসসিতে তাই লেটার পেয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সত্যিই জেদটা ছিল সবসময়।

৫) বাসায় যদি কারো পোস্টার টাঙাতাম, আব্বা বলতেন, ‘নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো, যাতে মানুষেরা তোমার ছবি টাঙায়’।

৬) ‘মা, তোর জন্ম হওয়া দরকার ছিল বনানী, গুলশানের মতো অভিজাত জায়গায়। আমার মতো গরীব মানুষের ঘরে নয়।’

৭) ‘আমার মেয়ে অনেক ভালো করবে, অনেক দূর যাবে।’

অনেক দূর যেতে চাই না আব্বা, আপনি শুধু বেঁচে থাকুন। জীবনের চড়াই-উৎরাই আমাকে আবেগশূন্য করেছে অনেকখানি, অনেককিছুই মুখে বলতে পারি না।

 

বাবার অভাব পূরণ হওয়ার নয়

তানভীর

 

বাবার মাধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু। বাবার ঋণ সন্তান কখনো পরিমাপ করতেও পারেনা। পরিবারের মহীরুহ হয়ে দায়িত্ব পালনে, সন্তান-সংসার পরিচালনায় ব্রতী যিনি। শাসনে কঠোর, ভালোবাসায় কোমল, স্নেহে উদার, ত্যাগে অগ্রগামী বাবা, যিনি জন্মদাতা। বাবার প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শনে একদিন কিছু নয়। তবুও শুধুই তার জন্য একটি দিন, একটু আলাদা করে উদযাপন করতেই `বাবা দিবস`।
বাবা হলেন অদ্বিতীয় আলো, যার আলোয় আলোকিত হয়েই আমাদের সারাজীবনের পথচলা। তবু সন্তানরা বড় হয়ে কর্মব্যস্ততায়, লেখাপড়া ও নানা কাজের চাপে বাবা-মাকে সময় দিতে পারে না। কেউবা প্রবাসে, কেউবা বাবাকে গ্রামে রেখে শহরে পাড়ি জমাই। অনেক সময় ভুলতে বসি বাবাকে। আর তাই বাবার জন্য বিশেষ একটা দিনমাত্র।
বাবারা যেকোন ধরনের দুঃখ-কষ্ট একাই সহ্য করেন। সব সময় চেষ্টা করেন দুঃখ-কষ্ট যেন সন্তানদের স্পর্শ না করে। সন্তানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
যাদের বাবা নেই, তাদের বাবারাও সন্তানের শুভকামনা করেন। বাবারা সবসময় আমাদের মাঝেই আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। যদিও বাবার অনুপস্থিতি কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হবার নয়।

 

প্রিয় বাবা

হেলাল উদ্দিন খোকন

 

ধীরে ধীরে আমি ‘তুমি’ হয়ে যাচ্ছি। তোমার সাথে খুব ঝাড়ি দিয়ে কথা বলতাম,নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবতাম। এখন তোমার নাতিরাও তেমন করে আমার সাথে। তোমার রিটায়ারমেন্টের পর কিভাবে কিভাবে একদম ঘরবন্দী হয়ে গিয়েছিলে আমার মনে পড়ে। করোনার ক্রান্তিকাল পার করতে আমার ও এই আর্লি রিটায়ারমেন্ট একদম গৃহবন্দী করে আমাকে বিষাদে মুড়ে দিয়েছে। অনেকে বলবে এই দুঃসময়ে ভাত কাপড় আছে তা নিয়ে শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। দারিদ্রতাকে আমি বরাবর বড্ড ভয় পেয়েছি, ছোটবেলার অনেক অনেক স্মৃতি আমাকে দারিদ্রতাকে ভয় পেতে শিখিয়েছে। তাই ঊর্ধ্বশ্বাসে নিজেকে সর্বোচ্চ হত্যা করে আমি স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে চেয়েছি যতদিন কাজ করেছি ততোদিন।

নিজের তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা যেন ক্ষুণ্ণ না হয় সেজন্য আমি যত অপ্রিয় অসহ্য হোক সব পরিস্থিতি মেনে চলা শিখেছি, যেমন তুমিও শিখেছিলে।
জীবনের এ পর্যায়ে এসে মনে হয় সব বিভ্রম। এসব আত্মত্যাগ নিজের বলি চড়ানো খুব বড় কোন অর্থ কারও কাছেই বহন করে না।
নানা সম্পর্কে সম্পর্কিত মানুষরা আসলে টাইম পাস। খুব দু’একজনের কাছে ব্যক্তি আমার হয়তো প্রয়োজনীয়তা আছে। এই যে থাকা না থাকা বিষয়টা ও একধরনের চক্র।

বিষাদে, অবহেলায়, অনাদরে, একাকীত্বে, নিঃসঙ্গতায় তুমি যেমন তোমার রুমের হাতল ছাড়া সোফাটায় বসে থাকতে,আমিও সেভাবে বসে থাকি।
মানুষের মন যোগাতে তোমার আয়ু কেটে গেছে, আমিও আজকে প্রায় দেড় যুগের উপরে কর্মক্ষেত্র,ব্যক্তিজীবন,অন্যান্য টানাপোড়েন নিয়ে একধরনের উইথড্রয়াল সিনড্রোমে ভুগি।

অনেক ভেবেও নিজের কোন প্রিয় খাবার, প্রিয় রঙ, প্রিয় মানুষ কিছুই বলতে পারি না। মনে হয় এই ৯০০ স্কয়ার ফিটের এক জেলে সশ্রম কারাদণ্ডে আছি বাবা। যেখানে কোথাও আমার জন্য এক ফোঁটা মমতা নেই, অথচ আমাকে কর্তব্যের খাতিরে দায়িত্বপূর্ণ সম্পর্কের খাতিরে সব পালন করে যেতে হবে।
ঘুরে দাঁড়াতে পারি,কিন্তু এক মহাজাগতিক ক্লান্তি ও বিতৃষ্ণা আমাকে যুগপৎ আঁকড়ে আছে। তোমার চোখগুলো আমার হয়ে যাচ্ছে, বাবা আমি ধীরে ধীরে ‘তুমি’ হয়ে যাচ্ছি!!

‘বাবা’ নামের বটবৃক্ষটার ছায়া যেদিন থেকে হারিয়েছি সেদিন থেকে বুঝতে পারছি রোদের তাপ কতটা প্রখর হতে পারে!!

‘বাবা দিবসে’ পৃথিবীর সকল সংগ্রামী বাবাকে লাল সালাম আর টুপি খোলা স্যালুট। পৃথিবীর সকল বাবারা ভালো থাকুক আপন আপন আঙিনায়।

 

আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বাবা

আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী

 

আমার বাবা ছিলেন আমার আর্দশ ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। ১৯২৬ সালের ১ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানার হাইলধর ইউনিয়নের তেকোটা গ্রামে আমার বাবার জন্ম।

সকালের সূর্য উদীয়মান থেকে যেমন অনুমান করা যায় দিনটি কেমন যাবে তেমনই আমার দাদা শৈশবেই ধরে নিয়েছিলেন বাবার মাঝে সোনালী সম্ভাবনা বিরাজমান এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ পাকের দয়াই দাদার সেই অনুমান শতভাগ সত্য হয়।
আনোয়ারা হাই স্কুল থেকে ১৯৪৩ সালে মেট্রিক পাশ করে বাবা কলকাতায় চলে যান। উচ্চ শিক্ষার জন্য সাহস করে কলকাতায় গমন করলেও পৌঁছার পর সেখানে অসহায়ত্ব বোধ করতে লাগলেন। কাকতালীয়ভাবে বাবার সাথে তখন পরিচয় হয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিদ ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে।উনি বাবাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন এবং উনার সাথে একই বাসায় থাকার সুযোগ করে দেন।
কলকাতা সিটি কলেজ থেকে ১৯৪৫ সালে ইন্টার পাশ করেই দেশে ফিরে না এসে কলকাতায় তৎকালীন সিভিল সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে চাকরিতে যোগদান করেন। সেখানে তিন বছর চাকরি করার পর ১৯৪৮ সালে আনসার প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সহকারী এডজুটেন্ট পদে যোগ দেন।
দীর্ঘ চাকরি জীবনে অল্প অল্প সঞ্চিত অর্থ দিয়ে দাদার নামে জমি ক্রয় করে যেমন বাবা দাদাকে সম্মানিত করেছেন ঠিক তেমনি বাবাই আবার সেই সম্পদগুলো চাচা ও ফুফীদের মাঝে ইসলামী শরীয়ত সম্মত ভাবে বণ্টন করে নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। যা বর্তমান যুগে খুঁজে পাওয়া খুবই বিরল। পরবর্তীতে সন্তানদের সুখে রাখার নিমিত্তে যেমন করেছেন ত্বিতল বাড়ি তেমনি কিনেছেন প্রচুর সম্পদ।
অন্যদিকে সন্তানদের সু-শিক্ষা দিয়ে আল্লাহ পাকের রহমতে যেমন মানুষ করেছেন তেমনি উনার নাতি নাতনিও আল্লাহ পাকের অসীম দয়ায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, ডাক্তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চ পদে কর্মরত রয়েছে।
১অক্টোবর ১৯৮২ সালে রাঙামাটির জেলা থেকে অবসরে আসার আগমূহূর্ত পর্যন্ত ঐ জেলার জেলা কমান্ড্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন বাবা।
বাবার কনিষ্ঠ পুত্র হওয়ার সুবাদে ওনার তেজোদীপ্ত ভরা যৌবন কাল দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। শেষ বয়সে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে যা দেখেছি এবং মা বড়ো ভাই বোন ও প্রতিবেশীদের থেকে যা শুনেছি তাতেই আমার বাবা আমার কাছে সুপারম্যান ।
তিনি একাধারে যেমনি ছিলেন ধার্মিক, সাহসী, সৌখিন, স্মার্ট, স্বাস্হ্য সচেতন, পরোপকারী সমাজ সংস্কারক ,বন্ধুভাবাপন্ন ঠিক তেমনি ছিলেন আদর্শ  ব্যক্তি, আদর্শ স্বামী, আদর্শ বাবা এবং পরিবারের জন্য আদর্শ অভিভাবক ও বটে।
বাবার জীবদ্দশায় সবসময়ই তিনটি উপদেশ আমাদের দিতেন।
১. কারো কাছে থেকে কোন কিছু আশা না করা।
২. মনের ব্যথা ,দুঃখ বা অভাবের কথা কারো কাছে প্রকাশ না করা যাতে সে দুর্বলতার সুযোগ নিতে না পারে।
৩. সার্মথ্য অনুযায়ী দান ছদকা করা।
উল্লেখিত তিনটি উপদেশ যথাযত পালন করার চেষ্টা করি এবং এটাও উপলব্ধি করছি বাবার দেয়া উপদেশ অত্যন্ত সময়োপযোগী ও দূরদর্শিতা পূর্ণ ছিলো।
প্রতিটা সন্তানেরই মা বাবার জন্য দোয়া করা উচিত এবং উনাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্যে খেদমতের মধ্য দিয়ে উনাদের থেকেও দোয়া অর্জন করা সন্তানদের দায়িত্ব বলে মনে করছি। আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমি পরিপূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করি বুলেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে মা বাবার দোয়া কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার নয়। যেটা আমার জীবনের পরতে পরতে আমি উপভোগ করে চলেছি।
২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর রোজ সোমবার দুপুর দেড়টায় আমার বাবা আল্লাহ পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে জান্নাতের মেহমান বনে যান।
বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন আর আমিও পৃথিবীর যে সব বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও জীবিত সকল বাবাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু জীবন কামনা করছি।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট