চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

দিক-দিশাহীন আজকের লিবিয়া

৬ মে, ২০১৯ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

লিবিয়ার লৌহমানব আল গাদ্দাফি মৃত্যুবরণ করার পর বর্তমান লিবিয়া কোন পথে যাচ্ছে তা বলা মুশকিল। প্রকৃত পক্ষে তিউনিসিয়া ও মিশরে শুরু হওয়া ‘আরব বসন্তের ঢেউ লিবিয়াতেও এসে ধাক্কা দেয়। যার ফলে ২০১১ সালে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং হত্যাও করা হয়। গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়ায় যে ক্ষমতার শূন্যতা শুরু হয় তা পূরণের জন্য এখনো লিবিয়ায় টানাপোড়েন চলছে। ২০১২ সালে লিবিয়ার বেনগাজিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতসহ তিনজন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারি কর্মকর্তাকে এক আক্রমণে হত্যা করা হয়। পরের বছর ত্রিপোলিতে একটি গাড়িবোমা হামলা হয় ফরাসি দুতাবাসে। যার কারণে অধিকাংশ বিদেশি প্রতিনিধি লিবিয়া ত্যাগ করেন। ফলে, দেশের স্থিতিশীলতা আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। লিবিয়াকে একত্রিত করতে ন্যাটো বাহিনীর সমালোচিত প্রচেষ্টা চলমান থাকলেও অবকাঠামোর অভাব এবং বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের সংঘাতের দরুন ২০১৪ সালে লিবিয়া আরও জটিল আরেকটি গৃহযুদ্ধে পতিত হয়। চলমান সহিংসতা ও সংঘাতের কারণে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। তেল উৎপাদন ও উত্তোলন অবকাঠামোগুলোর উপর প্রতিনিয়ত আক্রমণ ঘটে। প্রায় ২ লক্ষ মানুষ বাসস্থানচ্যুত হয়। লিবিয়ার সাবেক উচ্চপদস্থ ও খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়ার ক্ষমতাপূরণের চেষ্টা শুরু করে। এদের অনেকেই মরুময় রাষ্ট্রটির বিভিন্ন এলাকার উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য ঘোষণা করে যেগুলোর কোনোরকম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি কেউ দেয়নি। এদের মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ী হলেন ৭৫ বছর বয়সী সাবেক সেনা কর্মকর্তা খলিফা হাফতাব ‘গাদ্দাফির অনুগত সেনাপ্রধান ছিলেন হাফতাব’ ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানে গাদ্দাফিকে সঙ্গ দেন তিনি। এই অভ্যুত্থানের ফলেই গাদ্দাফি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু ১৯৯০ সালে গাদ্দাফির সঙ্গে একটি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ায় হাফতাব যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান এবং প্রায় ২০ বছর সেখানে পলাতক অবস্থায় থাকেন। এ সময়ের মধ্যে হাফতাবের অনুপস্থিতিতেই লিবিয়ার আদালত তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। হাফতাব ন্যাটো বাহিনীর মাধ্যমে লিবিয়ায় ফিরে আসেন, যাতে একনায়ক গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গাদ্দাফি বিরোধীদের সহায়তা করতে পারেন। এ প্রচেষ্টা সফল হলেও হাফতাব ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনোরকম আলোচনায় ছিলেন না। ২০১৪ সালে তিনি একটি টিভি সাক্ষাৎকারে নির্বাচিত সংসদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে এগিয়ে আসতে লিবিয়াবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান। সে বছরের মে মাসে হাফতাব অপারেশন ডিগনিটির সূচনা করেন। এই অপারেশনের আওতায় হাফতাব তার নিজস্ব মিলিশিয়া নিয়ে চরমপন্থী ইসলামী স্টেট লিবিয়ার উপকূলীয় অনেক শহর দখল করেন। ঐ বছরের আগষ্ট মাসে, ২০১২ সালে নির্বাচিত জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস (জিএনসি) সরকার চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এমন অপবাদ তুলে লিবিয়ান হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভস। একই সঙ্গে জিএনসি সরকারের ক্ষমতা প্রত্যাখ্যান করে লিবিয়ান হাউজ নিজেকে লিবিয়ার বৈধ সরকার হিসেবে দাবি করে। এই লিবিয়ান হাউজ সরকার লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি প্রতিষ্ঠা করে হাফতাবকে সে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ করে। এই সেনাবাহিনীকে পূর্বাঞ্চলের তব্রুক শহরে নিজ ঘাঁটি গড়ে এবং রাশিয়া সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও প্রতিবেশি মিশরের সমর্থন অর্জন করে।
এমনকি ফ্রান্সও হাফতাবের সাথে কাজ করতে রাজি হয়। এর প্রতি উত্তরে ইসলামপন্থীদের ইসলামিস্টদের নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া ত্রিপোলিতে আগ্রাসন চালায় এবং জিএনসি সরকারের প্রতিনিধিদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় চলা এক বছরের সংলাপের পর ত্রিপোলি ও তব্রুকে অধিষ্টিত সরকারদ্বয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে জাতীয় সংহতি সরকার বা গর্ভনমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) স্থাপন করে কিন্তু হাফতাব এ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের লিবিয়ার প্রকৃত ক্ষমতাসীন সংগঠন হিসেবে দাবি করে চলেছে। হাফতাব সরকার লিবিয়ার দুই তৃতীয়াংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। বাকী জায়গায় জাতিসংঘ সমর্থিত জিএনএ রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো গাদ্দাফি সরকার ক্ষমতায় থাকতে লিবিয়ায় এতো গ্রুপ তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি এখন কেনো লিবিয়ার এমন অবস্থা হলো? তাহলে কী লিবিয়ায় নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি হয়েছে? তা না হলে, গাদ্দাফির মৃত্যুর পর লিবিয়া স্থিতিশীল হচ্ছে না কোনো?

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক মানবাধিকারকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট