চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

আসামে আরেকটি আরাকানের পদধ্বনি!

কাজী আশফিক রাসেল

৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ভার তের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যর প্রকৃত নাগরিক তালিকা (এনআরসি) নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা গুঞ্জন চলছিল। শেষ পর্যন্ত রাজ্যসরকার চূড়ান্ত যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে প্রায় ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষের নাম বাদ পড়েছে। ফলে ‘রাষ্ট্রহীন’ এ বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন দিশাহারা। এতে বাংলাদেশেরও উদ্বিগ্ন হওয়ার ব্যাপার রয়েছে। কারণ বাদপড়াদের সিংহভাগই বাংলাভাষী এবং বিভিন্ন সময়ে তাদের বাংলাদেশি বলে দাবি করা হয়েছে, যা অযৌক্তিক। তথাকথিত বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা বিতাড়নের কারণে বাংলাদেশের ঘাড়ে যে শরণার্থী সমস্যা চেপে বসেছে, সেই একই ধরনের আরেক সমস্যা দেশটির ওপর এসে পড়বে কি না, সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এনআরসি প্রকাশের মধ্য দিয়ে আসামে আসলে আরেকটি রোহিঙ্গা সংকটের পদধ্বনি হয়েছে। মিয়ানমারও একইভাবে ১৯৮২ সালের সংবিধানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, তাদের নাগরিকত্বের কোনো ‘প্রমাণ’ নেই। শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর রোহিঙ্গারাও মূলত কৃষিকাজ ও মাছধরায় নিয়োজিত ছিল। বংশ পরম্পরায় বসবাসের প্রমাণ রাখারও দরকার বোধ করেনি। আসামের চিত্রটাও একইরকম। মিয়ানমারে যেভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধধর্মীয় গোষ্ঠী অত্যাচার চালিয়ে তাদের বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছে, ঠিক তেমনিভাবে আসামের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার শুরু হওয়ার যথেষ্ট আশংকা রয়েছে। কারণ ভারতে হিন্দুত্ববাদ ও চরম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ধারা নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে শুরু করেছিলেন, আসামে বিপুলসংখ্যক মানুষের নাগরিকত্ব বাতিল সেই ধরাবাহিকতার একটি অংশ মাত্র। বিজেপির এই হিন্দু জাতীয়তাবাদ এজেন্ডার বাস্তবায়ন আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার মধ্যদিয়ে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১৬ সালের আসাম বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই বিজেপি অভিযোগ করে আসছে- আসামে মুসলিম ‘অনুপ্রবেশকারী’ বাড়ছে। তারা বলে আসছে যে, তারা ক্ষমতায় গেলে এনআরসি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কথিত অনুপ্রবেশ ঠেকাবে। আবার একই সঙ্গে কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই বলেছে, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের তারা নাগরিকত্ব দেবে।

আসামে ‘সদ্য রাষ্ট্রহীন’ মানুষের কত ভাগ হিন্দু আর কত ভাগ মুসলমান তা এখন খতিয়ে দেখার বিষয়। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বলছে, বাদ পড়া ১৯ লাখের মধ্যে ১০ লাখ মুসলিম আর ৯ লাখ হিন্দু। এক্ষেত্রে হিন্দু জনগোষ্ঠী যদি ৯ লাখও হয়, তাদের খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ, ভারতের লোকসভায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল বিল পাস হয়েছে, যা এখন রাজ্যসভায় পাসের জন্য অপেক্ষমান। ওই বিল পাস হলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবে।

ভারত সরকার বলছে, তালিকার বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। সেখানেও প্রতিকার না পেলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হতে পারবেন। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকারের মুসলিমবিরোধী অবস্থান বেশ স্পষ্ট, সেখানে আসামে অনগ্রসর মুসলিম নাগরিকরা এই দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ায় কতখানি সহযোগিতা পাবে? শেষ পর্যন্ত যাঁরা নাগরিকত্ব হারাবেন, তাঁদের কী হবে?

ধরা যাক, এনআরসি থেকে বাদ পড়া দশ লাখ মুসলিমের মধ্যে বড়জোর এক লাখই ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে টিকে গেল। বাকিদের কী হবে? এর মধ্যে কয়েক লাখকেও যদি বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় রোহিঙ্গাদের মতো, তাহলে আমরা বড় সংকটে পড়ব। এই বাস্তবতায় ভারতের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে আমাদের নিরুদ্বেগ থাকার সুযোগ নেই। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের তরফে সক্রিয় ও কার্যকর কূটনীতি কাম্য। অন্যদিকে ভারতের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের উচিত তিস্তার পানিবন্টন, সীমান্তে হত্যা কিংবা নাগরিক তালিকা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। অন্তত বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বে ফাটল ধরতে পারে, এমন কিছু নিশ্চয়ই বাংলাদেশ আশা করে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট