চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

তাতার মুসলিম নির্যাতিত ও বঞ্চিত জাতি

মুহাম্মদ আবু নাসের

২৮ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বিশ ^ জুড়ে সংখ্যা লঘু মুস লিম জন গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন একুশ শতকের অন্যতম মানবাধিকার বিপর্যয়। চীনে উইঘুর মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে কঠিনভাবে দমন করছে দেশটির সরকার। উইঘুরদের একটি অংশকে জোরপূর্বক কথিত পুনঃশিক্ষা কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছে। আবার বার্মা বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা দেশটির সেনাবাহিনী দ্বারা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। মুসলিমদের এসব জাতিগোষ্ঠীর ওপর যে নির্যাতন চলমান তা বিশ^জুড়ে গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তবে এখনো এমন একটি জাতি রয়েছে যাদেরকে জাতিগতভাবে নিধন করা হচ্ছে। জাতিটি হচ্ছে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিম।

বিগত পাঁচ বছর পূর্বে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ক্রিমিয়ার প্রায় আড়াই লক্ষ তাতারের ওপর নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্যোগ। তাদেরকে কাজ, ভাষা ও সংবাদপত্রের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তবে এটাই ক্রিমিয়ার তাতারদের ওপর নির্যাতনের প্রথম ঘটনা হন। তাতার জাতি মূলত তুরস্ক থেকে এখানে এসেছে। গত এক শতাব্দী ধরে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জোরপূর্বক ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে রুশ শাসনে তাদেরকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
ক্রিমিয়া দ্বীপে তাতাররা প্রথমে বাস করতে শুরু করেন ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। তখন থেকেই বারবার তাতারদের ওপর বিভিন্ন গোষ্ঠী হামলা চালাতে থাকে। তবে এর পেছনে তাদের সংস্কৃতি বা ধর্ম কোন কারণ ছিল না। তাদের কাছে ব্যাপক পরিমাণ পানির উৎস থাকায় তাদেরকে টার্গেট করা হয়। ক্রিমিয়া পুরোপুরিভবে পানি দিয়ে ঘেরা। এর চারদিকে রয়েছে কৃষ্ণসাগর ও আজভ সাগর। তাই সমুদ্রে সরাসরি প্রবেশের ইচ্ছে থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ক্রিমিয়ার দিকে ক্ষুধার্ত চোখ ছিল রাশিয়ার।

১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ ইউক্রেনকে ক্রিমিয়া উপহার দেন। এরপর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তাতাররা ক্রিমিয়ায় ফিরতে শুরু করে। তবে ততদিনে ক্রিমিয়ার অধিকাংশ এলাকা রুশদের দ্বারা জনাকীর্ণ হয়ে গেছে। তারপরেও পুনরায় হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে তাতাররা মেজলিস নামে নিজেদের রাজনৈতিক দল গঠন করে।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ক্রিমিয়ায় হামলা চালায় রাশিয়া। ইউক্রেন থেকে উপদ্বীপটির আংশিক দখল নিয়ে নেয়। ওই বছরই মার্চ মাসে ক্রিমিয়ার ভাগ্য নির্ধারণে গণভোটের আয়োজন করে রুশ সরকার হয়ত ইউক্রেনের অংশ হয়ে থাকবে নতুবা রুশ ফেডারেশনের। তাতারা ওই গণভোটের বিরোধিতা করে। ফলে গ্রেপ্তার করা হয় বহু তাতার অধিকারকর্মী ও সাংবাদিককে। কেউ কেউ চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায় আর কেউ কেউ প্রাণ হারান। রুশ অধিগ্রহণের বছরগুলোতে তাতার পত্রিকা রেডিও ও টিভি স্টেশনগুলোয় ভাংচুর চালানো হয়।

এরপর থেকে অগণিত তাতারকে সন্ত্রাসবাদ সমর্থনের অভিযোগে বা মুসলিম দলের সদস্য থাকায় গ্রেপ্তার করেছে রুশরা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রিমিয়ায় মানবাধিকার দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। রুশ ফেডারেল সরকার চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লংগন করে ক্রিমিয়ার নাগরিকদের ওপর ক্রমাগতভাবে তাদের আইন চাপিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে ক্রিমিয়ায় তাতারদের সংখ্যা ফের ২ লক্ষ ৫০ হাজারে পৌঁছেছে। কিন্তু ১৮ শতকে যেখানে তারা ছিল উপদ্বীপটির মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ সেখানে আজ তারা কেবল ১২শতাংশ।

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো ও তুরস্ক ক্রিমিয়ায় রুশ অধিগ্রহণকে স্বীকৃতি দেয় নি। কিন্তু কেউ কোন কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি। রুশদের প্রত্যাহার তো দূরের কথা উপরন্তু রুশ কর্তৃক ক্রিমিয় তাতারদের সংস্কৃতি ও জাতিগত নিধনের ধীর প্রক্রিয়া রুখতেও কেউ কোন পদক্ষেপ নেয় নি।
উল্টো, পশ্চিমারা ও তাদের কথিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো নীরব ভূমিকাই পালন করেছে। পশ্চিমাদের নিস্ক্রিয়তা রুশদের দখলদারিত্বকে যেমন স্থায়ী করেছে তেমনি তাতাররা হয়ে পড়েছে যুগ-যুগান্তরের বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট