চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

ভাষার দূষণ রোধ ও ভাষার ভালোবাসা

মুহাম্মদ আবু নাসের

৫ মে, ২০১৯ | ১:১০ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষিত ও সচেতন জন, ভাষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা প্রায় একমত যে, ভাষা দূষণ ক্যান্সারের ন্যায় বিস্তার লাভ করছে। দেশে-বিদেশে, গোচরে-অগোচরে, ঘরে-বাইরে এর উদাহরণ রয়েছে সর্বত্র। কথা বলার সময় অহেতুক ভুলভাল ইংরেজি বাক্য শব্দ উচ্চারণ করা, সাইনবোর্ড বিলবোর্ড, প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে দেওয়া, ব্যাংক-বীমা-হাসপাতাল থেকে শুরু করে রেডিও-টিভির অধিকাংশ নাম ইংরেজিতে দেওয়া ও লেখা প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। টিভিতে ও এফএমরেডিওর ন্যায় ইংরেজি-বাংলা মিশ্র ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা ও পাশাপাশি অনেক অ নুষ্ঠানে ‘বাংলিশ’ ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা ও উপস্থাপনা কৃত্রিমভাবে এক জগাখিচুড়ি ভাষা চাপানোর নামান্তর। তবে, সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় হল বাংলাদেশে শতখানেক বিশ^বিদ্যালয়ের প্রায় সবগুলোর নাম ইংরেজিতে দেওয়া যেমন – ইস্টওয়েস্ট, নর্থ-সাউথ, ইউল্যাব, বিজিজি ট্রাস্ট, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ ইত্যাদি। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোর সোনালী, রূপালী, পূবালী, জনতা, অগ্রণী এরকম খাঁটি বাংলা নাম চালু ছিল। এ রকম আরো উদাহরণ দেওয়া যায়। এখন মনে হচ্ছে, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে কোন নিয়মনীতির বালাই নেই। যার যেভাবে খুশি বাক্য রচনা করবে, বানান করবে, উচ্চারণ করবে। এ ক্ষেত্রে যেন ‘আমরা সবাই রাজা’। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত জাতিগুলোর ভাষা চর্চার ইতিহাস ও ঐতিহ্য তা বলে না। বলাই বাহুল্য, ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান, চীনা, জাপানিসহ বর্তমান পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলো খুবই নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে চলে। কারণ, ভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব তারা সত্যিকার অর্থেই উপলব্ধি করে।
ভাষার দূষণ হল একটি জাতির অসুস্থতার লক্ষণ। কারণ, মানুষ তার সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও উন্নতি – যা কিছু অর্জন করেছে তার প্রধান বাহন হল তার মাতৃভাষা। উন্নয়নের একটি প্রধান শর্তই হল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল বা টেকনোলজি বা অর্জনের জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই।
শুধু টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত থাকলেই একটা সমাজ উন্নত হয় না। তাহলে বিশে^র দরবারে সৌদি আরব, কাতার কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোকে উন্নত দেশ বলা হত। মজার বিষয় হল, এই দেশগুলো জাতিসংঘের মানবউন্নয়ন সূচকের তালিকায় তুলনামূলকভাবে নিচের দিকে অবস্থান করছে। অথচ, অনেক স্বল্প বা মধ্যম আয়ের দেশ সূচকের তালিকায় ওপরের দিকে আছে। কারণ, উন্নত দেশ বলতে আমরা বুঝি যে দেশগুলোকে যারা ভাষা সাহিত্য, সংষ্কৃতি-শিক্ষা-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-এর সমাহারে উন্নত বা সমৃদ্ধ। ভাষা শুধুমাত্র ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি কিংবা অর্থোপার্জন এর জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় নয়। মাতৃভাষা মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য। গান, কবিতা, লেখনীর দ্বারা, সাহিত্যের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা, জ্ঞান ও মননের চর্চা করা, চিন্তার গভীরে প্রবেশ করার জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই। মাতৃভাষা আমাদের পরিচয়। তাই, ভাষাকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এর যথার্থ ব্যবহারে আমাদেরকেই মনোযোগী হতে হবে। শুধুমাত্র পুরস্কার, আত্মপ্রচার আর আনুষ্ঠানিকতার মোহে পড়ে জগাখিচুড়ি ভাষার কৃত্রিমতা আমাদের ভাষার দৈন্য তুলে ধরে। তাই, কবির ভাষায় বলা চলে, ‘মাতৃভাষা আগে, পরভাষা পরে’। ভাষার জন্য থাকা চাই অগাধ ভালোবাসা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট