চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

চিকিৎসকদের পেশা পরিবর্তন : কারণ ও প্রতিকার

ডা. হাসান শহীদুল আলম

১৪ অক্টোবর, ২০২০ | ১:৪৩ অপরাহ্ণ

একাদশ পর্ব। চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ। ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। পটিয়ায় চেম্বার। পর্যালোচনা লিখছিলাম চিকিৎসকদের পেশা পরিবর্তনের কারণসমূহের। ব) নবীন চিকিৎসকদের অসহায়ত্ব : ১. এমবিবিএস পাশ করেও অভিভাবকের কাছে টাকা চাইতে হয় : ইন্টার্নশীপ সমাপ্ত হবার সাথে সাথে এমবিবিএস চিকিৎসক বেকার হয়ে যান। তখন বাসা থেকে টাকা চাইতে হয় খরচ চালানো জন্য। সামর্থ্যে কুলোলে অভিভাবক হয়তো কিছু টাকা দেন। সে টাকায় খরচ সংকুলান হয় না বিধায় একটা চাকুরীর জন্য ক্লিনিক হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হয়। ২. ক্লিনিক বা হাসপাতাল মালিকের অযাচিত চাপ সহ্য করতে হয় : হয়তো কোন ক্লিনিকে মেডিকেল অফিসারের ডিউটি করার সুযোগ পাওয়া গেলো, কিন্তু তারপরেও যাতনা কমে না। তাকে থাকতে দেয়া হয় হাসপাতালের স্টোররুমে।

বেতন কখনও সরকারী চিকিৎসকদের প্রাপ্ত বেতনের সমান হয় না। অতএব শুরু হয় একাধিক ক্লিনিকে বিশ্রামহীন চাকুরী করা। মালিকপক্ষের দুর্ব্যবহার মাঝে মধ্যে চরম আকার ধারণ করে। চাকুরী টেকানোর জন্যে অনেক সময় একটানা ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে বাধ্য হয় সে। ৩. ধার করে ছোটদের ও মুরব্বিদের মুখে হাসি ফোটাতে হয় : আদরের ভাইবোন, মুরুব্বীদের ঈদ কোরবানীতে ঈদ উপহার হিসেবে ভাল কিছু দিতে গিয়ে তাকে বন্ধুবান্ধব থেকে হাত পেতে টাকা ধার করতে হয়। ৪. ইন্টার্নশীপের কষ্টার্জিত টাকা পোস্ট গ্রেজুয়েট পরীক্ষার জন্য খরচ করতে হয় : ছয় বছরের এমবিবিএস পাশ করার পর তাকে আবার চার-পাঁচ বছরের কোর্সে ঢোকার জন্য মাসের পর মাস প্রস্তুতি নিতে হয়। আবার কোচিং-এ ভর্তি, আবার বই কেনা। নিজের ইন্টার্নশীপের কষ্টার্জিত জমানো টাকা কোচিং এ দিতে হয়। বিসিএস নাকি পোস্ট গ্রেজুয়েশন কোনটার প্রস্তুতি নেবে সেটা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিসিএস দিয়ে সরকারী চিকিৎসক না হলে সমাজে সম্মান নেই। বেসরকারীতে মালিকপক্ষ দু’আনার সম্মান দিতে চায় না। ৫. উপজেলায় চাকুরী করতে গিয়ে মার খেতে হয় : অতঃপর অসম্ভব কাঠখড় পুরিয়ে সরকারী চাকুরী হিসেবে গ্রামে পোস্টিং হলে গ্রামের পাতিনেতাদের অযাচিত চাপ সহ্য করতে হয়। তাদের অযাচিত চাওয়া পূরণ করতে না পারলে মার খেতে হয়। ৬. পোস্ট গ্রেজুয়েট পরীক্ষায় ক্রমাগত ফেল করে কোর্স আউট হয়ে যেতে হয় : একবার এফসিপিএস পরীক্ষা দিতে লাগে ১১ হাজার টাকা। রেসিডেন্সি বা ডিপ্লোমা দিতে লাগে ৫ হাজার টাকা। একজন নবীন চিকিৎসকের জন্য শুধু একটি পরীক্ষা বাবদ ১১ হাজার টাকা দিয়ে ফর্ম ফিল আপ করার আর্থিক চাপ কিরূপ ভয়াবহ সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। তাও সে পরীক্ষা ১০০ জনে দিলে পাশ করে ২/৩/৪ জন। তাও সে পরীক্ষা কোয়ালিফাই করতে অর্থ আয়ের সব চিন্তা মাটি চাপা দিয়ে একটানা লাইব্রেরীতে বসে থাকতে হয়। এভাবে কতোবার পরীক্ষা দিতে থাকার পর খুব সৌভাগ্যবান হলে একটা ডিগ্রী জোটে। সেখানে ফেল করে বা কোর্স আউট হয়ে কত নবীন চিকিৎসক মানসিক স্থিরতা হারিয়ে পরবর্তী জীবনে নির্জীব হয়ে পড়ে তা দেখার কেউ থাকে না। ৭. সরকারের পরিকল্পনাহীনতার কারণে নবীন চিকিৎসকগণ জনগণের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছে না : বর্তমানের নবীন চিকিৎসকগণ আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের আমাদের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি। আমরা যে রকম এমবিবিএস পাশ করার পর পরই ইন সার্ভিস ট্রেইনী নামে একটি সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেছিলাম পঞ্চম গ্রেডের বেতনে। অতঃপর ইন্টার্নশীপ শেষ হওয়ার পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপজেলা মেডিকেল অফিসারের পদে চাকুরী পেয়ে যাই। তারপর নিজেরা নিজেদের কেরিয়ার গড়ি। তবে বর্তমানে মতো প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ পাবার ব্যবস্থা তখন ছিলো না। কিন্তু আমরা কখনও বেকার ছিলাম না। বর্তমান অবস্থাটা সেরকম নয়। যথাযথভাবে প্রণীত স্বাস্থ্যনীতি ও স্বাস্থ্যজননীতি না থাকাতে প্রতিবছর আট থেকে দশ হাজার চিকিৎসক বের হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এরা চিকিৎসক হিসেবে সঠিকভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছে না। সরকার এদের চাকুরী দিতে না পারায় এরা আংশিক বা পূর্ণ চিকিৎসক বেকার হিসেবে সমাজে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ৮. বিদেশে চিকিৎসক হিসেবে চাকুরী করার তেমন সুযোগ নেই : বাংলাদেশের চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রিসমূহের গ্রহণযোগ্যতা পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দুই একটি দেশ বাদে অন্যকোথাও নেই। সে হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশী ডাক্তারদের বাজার বহির্বিশ্বের কোথাও তেমন নেই। নবীন চিকিৎসকরা যে দেশে বসে ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়ান অথবা ব্রিটিশ কোয়ালিফাইং টেস্ট দিয়ে দেশের বাইরে যাবেন সে সুযোগও তাদের নেই। ৯. বাংলাদেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পর্যাপ্ত নয় : প্রাইমারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতে হলে আমেরিকা এবং ইউরোপ উভয় অঞ্চলে পাঁচ বছর চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে সফল হতে হয়। হাসপাতালে অর্থাৎ সেকেন্ডারী ও টারশিয়ারী স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত হতে হলে আমেরিকায় ৭ থেকে ১৪ বছর এবং ইউরোপে দশ থেকে বার বছর সফলভাবে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করতে হয়। এভাবে ‘প্রশিক্ষণ সমাপ্তির সনদপত্র’ প্রাপ্তির পরই শুধু স্বাধীনভাবে চিকিৎসা প্রদানের অধিকার অর্জন করা যায়। দেখা যাচ্ছে উন্নত দেশে স্বাধীনভাবে চিকিৎসা চর্চা করতে শুধু স্নাতক উপাধি পর্যাপ্ত নয়। চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক উপাধি এমবিবিএস সনদ অর্জনের পর অবকাঠামোভিত্তিক সুস্পষ্ট পাঠ্যক্রমযুক্ত যোগ্যতামূলক ন্যূনতম পক্ষে ১০ থেকে ১২ বছর শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ সমাপনের পর বিশেষজ্ঞ হিসেবে সনদ প্রাপ্তির মাধ্যমেই হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ হাসপাতাল স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে উচ্চপর্যায়ে উন্নীত করার পূর্বশর্ত। কিন্তু এফসিপিএস এমডি ইত্যাদি সনদ অর্জনের সম্ভাবনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, চাহিদা অনুযায়ী আসন সংখ্যার অনুপাতের মারাত্মক অসামঞ্জস্যতা বিরাজ করছে। বর্তমানে চিকিৎসা প্রদানে নিয়োজিত ৯০ শতাংশেরও বেশী চিকিৎসক এমবিবিএস পাশ করার পর কোন স্নাতকোত্তর সনদ অর্জনে সক্ষম হননি। বর্তমানে দেশে সর্বসাকুল্যে মাত্র দুই হাজার স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমের আসন সংখ্যা রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৭০ হাজারের উপরে চিকিৎসকের স্নাতকোত্তর শিক্ষার কোন সুযোগই নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারাদেশে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজারের মতো স্নাতকোত্তর চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে হাসপাতালে স্নাতকোত্তর শিক্ষিত চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র তিন হাজারের মতো। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, হাসপাতাল স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যোগ্য চিকিৎসকের অভাবে বাংলাদেশে একটি ভয়ংকর এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

উপসংহার : এ পর্যন্ত এগারটি পর্বে যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসেবে উপসংহারে বলতে চাই যে, ১) জাতীয়ভাবে স্বাস্থ্যনীতি ও স্বাস্থ্যজননীতি না থাকা, ২) স্বাস্থ্যখাতে অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, ৩) সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল পরিচালনার কার্যকর নীতিমালার অভাব, ৪) চিকিৎসক সুরক্ষা আইন কার্যকর না থাকা, ৫) চিকিৎসকদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুঠা এবং ৬) মিডিয়া কর্তৃক অপপ্রচার এই ছয়টি কারণ মূলতঃ দায়ী চিকিৎসকদের পেশা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। আগে সামাজিক ক্ষেত্রে মানুষ মেধাকে মূল্যায়ন করতো, সম্মান করতো। আর আজকাল মানুষ মানুষকে মেধার মানদণ্ডে নয়, বরং পেশীশক্তি ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে মানদণ্ডে মূল্যায়ন করে, সে অর্থ যেভাবেই অর্জিত হোক না কেন।

চিকিৎসকদের মেধা ছাড়া আর কিছু নেই। সে যখন দেখে তার মেধা, পরিশ্রম সমাজে মূল্যায়ন হীন হয়ে পড়েছে তবে সে হতাশ হয়ে অন্য পেশায় চলে যায়। এ প্রসংগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট-এর অধ্যাপক মুহাম্মদ কায়কোবাদ এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার পেশাকে এ দেশে আরও আকর্ষণীয়ভাবে গড়ে তোলা উচিৎ ছিলো। আমরা অবশ্য তা করতে পারি নাই, কারণ আমরা সভ্য নই।” হাজারো বঞ্চনার মাঝে হাসিমুখে সেবা আশা করা যায় না। সেবাদাতার মনে হাজারো কষ্ট দিয়ে গায়ে হাত তুলে সেবা আশা করা যায় না। আগে সেবাদানকারী চিকিৎসকদের বঞ্চনা, অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা, চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জনবলের আচরণ ও অনিয়ম এবং হাসপাতালের অর্গানোগ্রামের অসংলগ্নতাগুলো দূর করতে হবে। তাহলে চিকিৎসকদের মানবিক আচরণ পাওয়া যাবে এবং চিকিৎসকরা পেশা পরিবর্তনের চিন্তা করবেন না। পরবর্তী লেখায় থাকছে চিকিৎসকরা যেন পেশা পরিবর্তনের পথে পা না বাড়ায় সেজন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে সেগুলোর পর্যালোচনা।

লেখক: ডা. হাসান শহীদুল আলম, ডায়াবেটিস ও চর্মযৌন রোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট