চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অন্য আর এক মুর্তজা বশীরের কথা বলছি

আবদুল মান্নান

২৫ আগস্ট, ২০২০ | ২:২৭ অপরাহ্ণ

গত মার্চ হতে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের করোনাকাল। তিন হাজার ছয় শতের উপর মানুষকে ইতোমধ্যে এই ঘাতক ব্যাধি আমাদের কাছ হতে চিরদিনের জন্য ছিনিয়ে নিয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজন কেউ বাদ যায় নি। এই সময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন এই দেশের বেশ ক’জন কৃতি মানুষ, যারা ছিলেন দেশের প্রদীপ। চলে গেছেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানী আর সর্বশেষ গত ১৫ আগস্ট বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। এঁরা সকলে পরিণত বয়সে আমাদের ছেড়ে গেছেন ঠিক কিন্তু যখন একজন আপনজন আমাদের ছেড়ে চলে যান, তাঁর বয়স যতই হোক না কেন মনে হয় আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে হতো না! আর দু’দিন বেঁচে থাকলে মুর্তজা বশীরের বয়স হতো ৮৮ বছর। মুর্তজা বশীর, যিনি আমার কাছে বশীর ভাই, চলে যাওয়াতে নিজের উপর কেন জানি আস্তা হারিয়ে ফেলেছি। শিল্পী মুর্তজা বশীরকে নিয়ে অনেকে লিখবেন, লিখেছে বা বলবেন। এই বিষয়ে লেখার কোন যোগ্যতা আমার নেই। আমি অন্য আর এক মুর্তজা বশীরকে নিয়ে লিখছি, যা হয়তো বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে অজানা।
১৯৭৩ সালে আমি আর মুর্তজা বশীর একই সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। তিনি চারুকলা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আর আমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়জোর হাজার পাঁচেক শিক্ষার্থী ছিল। উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আবুল ফজল। আবুল ফজলের বড়গুণ ছিল তিনি সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উঁচু মানের শিক্ষক খুঁজতেন। সেই সময় চারুকলা বিভাগ খুবই সমৃদ্ধ ছিল যা আর কখনো দেখা যায়নি। এই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন শিল্পী রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তি, মিজানুর রহিম, ভাস্কর আবদুল্লাহ খালেদ, নাট্যকার জিয়া হায়দার, শিল্পি আবুল মনসুর, মৃৎশিল্পি অলক রায় সহ আরো ক’জন দেশের প্রতিথযশা শিল্পী। তাদের হাত ধরেই পরবর্তিকালে এই বিভাগ হতে পাশ করে বের হয়েছিল, শিল্পী মনসুরুল করিম, হাসি চক্রবর্তি, খাজা কাইউম, চন্দ্রশেখর দে, নাজলি মনসুর প্রমূখরা।

মুর্তজা বশীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার শুরুর দিকে কিছুদিন চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় থাকতেন। পরে আমার পাড়ায় উঠে এলেন সেনাকল্যাণ সংস্থার বিল্ডিং এনেসেল ভবনে। তখন ঢাকা হতে নিয়ে এলেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের। ভাবি, দুই মেয়ে আর এক ছেলে জামিকে। তাঁর সাথে পরিচয় হতে খুব বেশী সময় লাগেনি। দু’জনই একই বাসস্ট্যান্ড হতে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় বাসে উঠি বসি পাশাপাশি। প্রথম দিন শুরু হয়েছিল ‘আপনি’ সম্বোধন দিয়ে। আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি নেমে এলেন ‘তুমিতে’। খুব দ্রুত বশীর ভাই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। সর্বশেষ তাঁর সাথে দেখা হয় ২০১৯ সালে ওসমানি মিলনায়তনে যেদিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর হাত হতে স্বাধীনতা পুরষ্কার নিতে গিয়েছিলেন। নাম ঘোষণা করলে তাঁকে হুইল চেয়ারে মঞ্চে আনা হয়।

পড়নে একটা সিল্কের লুঙ্গি, অফহোইট কালারের সিল্কের পাঞ্জাবি আর মাথায় একটা নকশা করা টুপি। সাথে ছোট একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারও আছে। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নানা রোগে ভুগছিলেন। ঢাকার একটি তারকা খচিত হাসপাতালের দায়িত্বহীনতার কারণে তাঁকে আরো কাবু করে ফেলেছিল। সম্ভবত ২০১৭ সালে ভাবি গুরুতর অসুস্থ হয়ে সেই হাসপাতালে ভর্তি হন। বশীর ভাই আর ছেলে জামি নিয়মিত হাসপাতালে যান ভাবিকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। একদিন বাপ ছেলে দু’জনই আটকা পরলেন হাসপতালের লিফ্টের ভিতর। অবাক কান্ড হচ্ছে এমন ঘটনা ঘটলে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে লোক ডাকতে হয় তিন কিলোমিটার দূর হতে। দেড় ঘণ্টা পর বশীর ভাই ও ছেলেকে যখন আটকে পরা লিফট হতে উদ্ধার করা হলো তখন তাঁর অবস্থা বেশ গুরুতর। এমনিতে তিনি শ্বাসজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। এই ঘটনা তাঁর অসুস্থতা আরো বাড়িয়ে দেয়। পদক প্রধান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নিজের আসন ছেড়ে বশীর ভাইয়ের গলায় পদকটি পরিয়ে দিয়ে তাঁর সাথে বেশ খানিক সময় আলাপ করলেন। অনুষ্ঠান শেষে পদক প্রাপ্তদের সাথে প্রধানমন্ত্রী চা খাবেন। সেখানে আমারও যাওয়ার সুযোগ ছিল। গিয়ে প্রথমে বশীর ভাইকে অভিনন্দন জানালাম। তিনি বেশ অভিমানের সুরে বললেন ‘তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তুমি একবারও ফোন করো নি’। তাঁকে বলি ফোন করিনি ঠিক কিন্তু আমি সমবেদনা জানিয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়েছি।

এতে বশীর ভাই সন্তুষ্ট না। তাঁর কাছে ক্ষমা চাই। তিনি বলেন ‘কেন তুমি আমাকে ফোন করলে না’। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী এসে পরলেন। আমাদের দু’জনের বাক্য বিনিময় তিনি কিছুটা শুনেছেন। জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি নিয়ে কথা বলেন?’ নেত্রীকে বলি ‘না কিছু না, বশীর ভাই আমার উপর একটু অভিমান করেছেন।’ প্রধানমন্ত্রী হেসে গিয়ে নিজের আসনে বসলেন। বশীর ভাইকে বলি ‘বাসায় আসবো’। তিনি বলেন ‘এসো’। দুর্ভাগ্য আমার বশীর ভাইয়ের বাসায় আর যাওয়া হয় নি। ক্ষমা করবেন বশীর ভাই।

মুর্তজা বশীরের মতো একজন বহুমাত্রিক প্রতিভার মানুষ আমি কম দেখেছি। যৌবনে বাম ঘরাণার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিয়েছেন। আমাকে বলেছিলেন ভাষাশহীদ রফিকের মৃত্যু তাঁর হাতে হয়েছে। সারা গায়ে রক্ত নিয়ে যখন বাসায় যান কাপড় বদলাতে তখন তাঁর পিতা জ্ঞানতাপস ভাষাবিদ ড. শহীদউল্লাহ বশীর ভাইকে দিয়ে তাঁর নিজের কালো শেরোওয়ানী কেটে ব্যাজ বানিয়ে নিজে পরেছিলেন ও একটি বশীর ভাইয়ের জামায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলন করার দায়ে বশীর ভাই জেলে গেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে ‘রক্তাত্ত একুশ’ শিরোনামে প্রথম ছবিটি আঁকেন মর্তুজা বশীর। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলেন বশির ভাইয়ের একটি লিনো কাট স্থান পায়। বশীর ভাইকে কখনো শুনিনি পিতার পরিচয় দিয়ে নিজেকে পরিচিত করতে। তিনি সবসময় নিজের কর্ম দ্বারা নিজেকে পরিচিত করতে পছন্দ করতেন।

বেশীর ভাগ মানুষ বশীর ভাইয়ের শিল্পী পরিচয়টা জানেন। কিন্তু তাঁর এর বাইরেও অনেক পরিচয় আছে যা অনেকে জানেন না। ১৯৬৫ সালে তাঁর বন্ধু সাদেক খান বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন কবিরের কাহিনী নিয়ে বানিয়েছিলেন চলচ্চিত্র ‘নদী ও নারী’। সেই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন মুর্তজা বশীর। একই সাথে শিল্প নির্দেশক ও সহকারি পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। সুযোগ পেলেই তিনি এই ছবি নির্মাণের গল্প করতেন আমার কাছে। ১৯৬৫ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘কায়সে কাহু’তে তিনি শিল্প নিদের্শক। বশীর ভাইয়ের বিচিত্র সব হবির মধ্যে একটি ছিল দিয়াশলাইয়ের বাক্স যোগাড় করা। আমি কখনো বিদেশে গেলে তিনি বলে দিতেন যেন তাঁর জন্য দিয়েশলাইয়ের বাক্স নিয়ে আসি। তাঁর সংগ্রহে ছিল হাজারের উপর বিভিন্ন দেশের দুর্লব ডাক টিকেট আর ভারতবর্ষের বিভিন্ন আমলের মুদ্রা। মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর শুধু নেশাই ছিল না তাঁর উপর গবেষণা করে তিনি একজন প্রতিথযশা গবেষক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণালব্দ গ্রন্থ ‘মুদ্রা শিল্পের আলোকে বাংলার হাবসি সুলতান ও তৎকালিন সমাজ’। এই কাজের জন্য তাঁকে সহায়তা করে ভারতের আইসিসিআর। তিনি দিল্লী কোলকাতা ও বেনারসের বিভিন্ন যাদুঘর ও পশ্চিম বাংলার নয়টি জেলায় তিনহাজার গ্রাম ঘুরে বেড়ান গবেষণার কাজে। তাঁর গবেষণালব্দ একাধিক প্রবন্ধ ভারতের ‘Numismatic Society of India’র জার্নালে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অবসর নেয়ার আগে সমুদ্রের বালিতে পাওয়া নুড়ি পাথরের উপরে প্রাকৃতিক নকশার আদলে তেল রং এর ছবি আঁকতে শুরু করেন। একইসাথে অসাধারণ সব ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি।
বশীর ভাই খুবই রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁকে আমরা প্রগতিশীল দল হতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সিনেট সদস্য নির্বাচিত করি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয় শিক্ষক ও ছাত্ররা খুবই শক্তিশালি ভূমিকা পালন করে। ১৯৮৭ সালের ২৮ নভেম্বর এরশাদ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন দমাতে দেশে জরুরী আইন জারি করে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি মুর্তজা বশিরের নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত নেয় তারা এই আদেশ মানেন না।
এরশাদ তার মন্ত্রীসভায় বলে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কি রাষ্ট্রের ভিতর রাষ্ট্র’? ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসক জিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিলে তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ঐক্য জোটের প্রার্থী জেনারেল ওসমানি প্রতিদ্বন্ধিতা করেন এবং সেই নির্বাচনে বশীর ভাই জেনারেল ওসমানির পক্ষে চট্টগ্রামের গ্রামে-গঞ্জে নির্বাচনি প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। বলাবাহুল্য জিয়া ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করছিলেন। প্রশাসন ছিল তার সাজানো। সেই নির্বাচনে বিজয় লাভ করা অসম্ভব ছিল। তারপরও জেনারেল ওসমানি ২১.৭ শতাংশ ভোট পান। মুর্তজা বশীরের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সকলে জানেন। তিনি স্বাধীনতা পুরষ্কার সহ বাংলাদেশে যতগুলো সম্মাননা পুরষ্কার আছে সবকিছু অর্জন করেছেন। এই বহুমাত্রিক মানুষটি করোনাকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। যেদিন এই লেখা লিখছি সেদিন বশীর ভাইয়ের ৮৮তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন বশীর ভাই। যেখানে থাকুন শান্তিতে থাকুন। আমাদের স্মৃতিতে আপনি চির জাগরুক।

লেখক: প্রফেসর আবদুল মান্নান

সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট