চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পরচর্চা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পরচর্চা

পূর্বকোণ ডেস্ক

২২ আগস্ট, ২০২০ | ১:৫৪ অপরাহ্ণ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন খুবই শক্তিশালী। এর সুবাদে কম খরচে দ্রুত সময়ে বেশি মানুষের সাথে যোগাযোগ করা এবং দেশ-বিদেশের খবরাখবর নেয়া সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে যেকোন সুসংবাদ বা দুঃসংবাদ হাজার হাজার মানুষের নিকট পৌঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অন্যের কথার উত্তর বা প্রতিউত্তর দেয়াও সহজ হয়েছে। জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞানচর্চাতেও এ মাধ্যম ব্যবহার হচ্ছে সমানতালে।

মিডিয়ার এমন উন্নয়ন মানুষের প্রাত্যহিক কাজকর্মকে দ্রুত ও সহজ করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় মিডিয়ার বহুমুখী সুফল ভোগ করছে বর্তমান বিশ্ববাসী। বিশেষত বর্তমান প্রজন্ম। ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, যাকে সংক্ষেপে ফেবু বলা হয়। ফেবুহীন সময় কাটে না অনেকের। ফেবু নতুন প্রজন্মের বিনোদন, ভাববিনিময়, মত প্রকাশ, সুখ-দুঃখ শেয়ার করার প্রধান পাথেয়। নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ, সাহিত্যচর্চা, বিভিন্ন উপলক্ষে শুভেচ্ছা বিনিময়, ভালো কাজে উৎসাহ দান, মন্দ কাজের প্রতিবাদ করা ইত্যাদি চলছে এর মাধ্যমে। সংবাদমাধ্যম ও ডাক বিভাগের কাজগুলোও অতি সহজে, কম খরচে ও দ্রত সেরে যাচ্ছে। কারো নিকট নিজের জন্মদিনের কথা স্মরণ না থাকলেও ফেবু কিন্তু স্মরণ করিয়ে দেয়। আর এরপর আসতে থাকে শুভেচ্ছাবার্তা।

মানুষভেদে এগুলোর সংখ্যা কমবেশি হয়। এতে সময়ও দিতে হয় প্রচুর। এভাবে বিবাহবার্ষিকীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণ ও শুভেচ্ছা বিনিময় হচ্ছে। এসবের দিকে তরুণ-তরুণীদের আকর্ষণ এত বেশি যে, এন্ড্রয়েড মোবাইল ও ফেবুহীন জীবন যেন অচল। এমনকি দুই বন্ধু বা স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি অবস্থান করেও কথা বলার ফুরসত পাচ্ছে না ফেবুকে সময় দিতে দিয়ে। কাগজি পত্র আদান-প্রদানের রসম উঠে গেছে বললে অত্যক্তি হবে না। ভর্তি, চাকুরী ইত্যাদির আবেদনও এখন অনলাইনে। তার মানে ডাক বিভাগের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসছে দিন দিন। সুতরাং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বহুবিদ সুফল ও প্রয়োজনীতা অস্বীকার করার জো নেই। তবে আধুনিক এ মিডিয়া ও যন্ত্রের অপব্যবহারও কম নয়। কুফলও ঢের। দীর্ঘক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকার স্বাস্থ্যগত ক্ষতি তো আছে। আবার বাচ্চাদের হাতে মোবাইল মানে গেম আর গেম। অনেকেই শিশুকে খাওয়ানোর মাধ্যম হিসেবে মোবাইল গেমকে কাজে লাগাচ্ছেন। এভাবে বেড়ে উঠা কচিকাঁচাদের কেউ কেউ অকালপক্ক হলেও মোটের ওপর এর ক্ষতির দিক বেশি মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। চশমা ব্যবহাকারীর ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গেম খেলতে খেলতে দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হচ্ছে প্রায় ফেবুকারদের। এতে ব্রেইনেরও ক্ষতি হচ্ছে বলে চিকিৎসকদের অভিমত আছে। মুখস্থকরণের অভ্যাস হ্রাস পাচ্ছে। ফলে স্মৃতিশক্তির যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না এবং মুখস্থ করা ও রাখার অভ্যাস কমে যাচ্ছে।

ফেবুতে চলছে ধর্মযুদ্ধ। একেক জনের মন্তব্য দেখলে মনে হয় তিনি সবজান্তা ও একেবারে নির্ভুল। তার মতের বাইরে আর কোন মত থাকতে পারে না। দুই-চার হাজার টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করে একটি এন্ড্রয়েড মোবাইল কিনতে পারলে যেন তিনি সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিত, ধর্মবিশেষজ্ঞ। অনেকের মন্তব্য পড়লে তার লেখাপড়ার দৈন্যতা বুঝা যায়। কিন্তু তিনি এমন বিষয়ে লিখছেন বা সমাধান দিচ্ছেন, যা প্রচুর লেখাপড়া করেও দেয়া কঠিন। অপরদিকে ভাষা ও বানানের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ফেবু লেখকের কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। যখন যা ইচ্ছা তা লিখতে পারেন। শিক্ষিতরাও ফেবুতে লিখতে নিজের বিষয়ের বাইরে চলে যান। ফলে ভুল তথ্য উপস্থাপিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব কিছুর বিবেচনায় লাভজনক ও অর্থপূর্ণ লেখালেখির চেয়ে অনর্থক, অকল্যাণকর ও রুচিহীন লেখালেখির চর্চা চলছে বেশি। এতে বহুমুখী ক্ষতির সম্মুখীন আমাদের বর্তমান প্রজন্ম। তাদের মধ্যে গড়ে উঠছে নানান কুঅভ্যাস। যেমন পরচর্চা, পরনিন্দা, অনর্থক বিতর্ক, কথার পিঠে কথা বলে সময় নষ্ট করা, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ইত্যাদি। অপছন্দের ব্যক্তিকে নিয়ে কটুক্তি ও রুচিহীন বক্তব্য হরদম চলছে। অনেকেই নিজেকে জাহির করা, নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই, অন্যের প্রশংসা কুড়ানোর মাধ্যম হিসেবেও ফেবুকে বেঁচে নেয়। একটা মন্তব্য বা ছবি দিয়ে কয়টা লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার হলো তা দেখতে থাকে। তরুণ-তরুণীদের একটি বিরাট অংশ এগুলো নিয়ে ব্যস্ত। কাউকে ঘায়েল করা, হেয় প্রতিপন্ন করা, জেদ-খেদ মিটানোর মাধ্যম হিসেবে এ মিডিয়া অহরহ ব্যবহার হচ্ছে।

অথচ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসবই পাপের কাজ। অসত্য ও অপ্রমাণিত তথ্য উপস্থাপন করাও মারাত্মক গুনাহ। মিথ্যাকে বলা হয়েছে, সব পাপের উৎস। পরচর্চাকে ব্যভিচারের চেয়ে মারাত্মক আখ্যায়িত করা হয়েছে। আরেকজনের অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করাকে মরা ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার সমান বলা হয়েছে। ধারণানির্ভর কথা বলাও অপরাধ- পবিত্র কুরআনের ভাষায়। গুজব ফিতনার অন্যতম উৎস। ফিতনাকে হত্যাকাণ্ডের চেয়ে মারাত্মক বলা হয়েছে। বর্তমানে মোবাইল ও ফেবুর মাধ্যমে পরচর্চা চলছে হরদম, যার অধিকাংশ গীবতের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। গীবত হলো, কারো অনুপস্থিতিতে তার এমন আলোচনা, যা তিনি শুনলে মনে কষ্ট পাবেন। সরাসরি, ইঙ্গিতে বা কারো উদ্ধৃতিতে আরেকজনের দোষ বর্ণনা করাও গীবতের সংজ্ঞায় পড়ে। তার মধ্যে যদি চর্চিত দোষটি পাওয়া যায় তাহলেও সিটি গীবতের অন্তর্ভুক্ত, আর যদি পাওয়া না যায় অর্থাৎ তার সম্পর্কে মিথ্যাচর্চা হয় তাহলে সেটিকে বুহতান বলা হয়। এটি গীবতের চেয়েও বড় পাপ। তাওবা ছাড়া অন্য কোন নেক আমল এর বিনিময় হতে পারে না। পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, পাঁচটি পাপের কাফ্ফারা (প্রতিকার) নেই। আল্লাহ সাথে শরিক করা, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা, বিশ্ববাসীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ, যুদ্ধ ময়দান থেকে পলায়ন এবং মিথ্যা শপথ করে অন্যকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা।’ (মুসনাদে আহমদ, ১৪/৩৫০)।
ইতোপূর্বে গীবত চলতো অন্যজনের সামনে, যেখানে কিছুটা হলেও বাধার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। এখন গীবত করার জন্য নিজের হাতের বাকহীন যন্ত্রটি যথেষ্ট। অথচ এতে লিখিত তথ্যমুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হচ্ছে। এভাবে ডিজিটাল গিবত চলছে। কারো সম্পর্কে প্রদত্ত মন্তব্যটা সঠিক না বেঠিক, এতে আমার মন্তব্য প্রাসঙ্গিক কিনা ইত্যাদি চিন্তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না অনেকেই। খারাপ কিছু প্রকাশ হলে শুরু হয়ে যায় কুমন্তব্য, গালিগালাজ, জাত-বংশ ও ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে লেখালেখি। কেউ কেউ বিশ্রী ও কুরুচিপূর্ণ ছবি দিয়ে সহমত প্রকাশ করে। এগুলো শিষ্টাচার বহির্ভূত তো বটে, গীবত ও অশ্লীলতার সংজ্ঞায়ও পড়ে। মৌখিক গীবতের চেয়ে লিখিত গীবত বেশি মারাত্মক। যারাই এসব দেখছে তারা সাক্ষী হয়ে যাচ্ছে উক্ত মন্দকর্মের। অপরাধ করে সাক্ষী রাখা আরো মারাত্মক, যাতে ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। নিজে তো এসব করছে, আবার শেয়ার করে বন্ধুদেরকে উদ্বুদ্ধ বা জড়িত করছে। তার মানে গীবতের ছড়াছড়ি এবং পাপের বোঝা ভারি হচ্ছে অতি সহজে। ফেবুতে অপ্রয়োজনীয় ছবিচর্চাও হয় বেশি। এতে সৌন্দর্য্য প্রদর্শনের প্রতিযোগিতাও চলছে। সেলফি তুলতে সদা ব্যস্ত নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ। ভাইরাল জ্বরে ভুগছে অনেকেই। এতে সময় ও টাকার অপচয় হচ্ছে। পবিত্র কুরআনে অপচয়কারীকে শয়তাদের ভাই বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অপ্রয়োজনে ছবি তোলাও নিষিদ্ধ। অনেকেই নিজের মতবাদ ও পছন্দের ব্যক্তিকে তুলে ধরার কাজে ব্যস্ত। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন হয়। কার সম্পর্কে কোন্ শব্দ ব্যবহার করবে তার বালাই নেই। সাধারণের পাশাপাশি ধর্মীয় ব্যক্তিরাও এগুলোতে কম অগ্রসর নন। অনেক ক্ষেত্রে বেশি। পান থেকে চুন কসলেই মেরে দেন ফতোয়া। চর্চা শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে। সৃষ্টি হয় দল-উপদল। আসল ঘটনা কী, এতে আমার সংশ্লিষ্ট হওয়া উচিৎ কিনা, এতে পার্থিব বা পরকালীন কোন উপকার আছে কিনা ইত্যাদি বিবেচিত হয় না। অথচ কারো সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে বা কোন বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদানের পূর্বে তা ভালভাবে যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। অন্যথায় কৃতমর্মের জন্য লজ্জায় পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের নিকট যদি কোন সংবাদ আসে তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও যেন তোমরা না জেনে কোন সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে বস, যার ফলে কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে লজ্জিত হতে হবে।’ (সূরা হুজুরাত: ৬)।
অনর্থক কথা বা কাজ করাও ভালো মানুষের চরিত্র হতে পারে না। পবিত্র হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তির ইসলামচর্চার উত্তমপন্থা হলো অনর্থক যে কোন কিছু এড়িয়ে যাওয়া’। ইমাম আবু হানিফার সমালোচক ছিল অনেক। কিন্তু তিনি কারো সম্পর্কে কোন মন্তব্য বা প্রতিউত্তর করতেন না। ইমাম বুখারি (র) বলেছেন, ‘আমি যেদিন থেকে জেনেছি যে, পরচর্চা পাপ সেদিন থেকে কারো গীবত করিনি।
তাই আল্লাহতায়ালা আমাকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না’। পবিত্র কুরআনে কুধারণা ও গীবত সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্ববাসীগণ, তোমরা সাধারণভাবে অন্যের ব্যাপারে আন্দাজ-অনুমান করা থেকে বিরত থেকো। আন্দাজ-অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুনাহের কাজ। অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করো না। তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমরা কি মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে চাও? (গীবত করা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমান)। না, তোমরা তো তা ঘৃণা করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবা কবুলকারী (সূরা হুজুরাত: ১২)। পবিত্র হাদিসে আরও বলা হয়েছে, ‘তোমরা ধারণা করা থেকে বেঁচে থেকো। কেননা, ধারণা বড় মিথ্যা। অন্যের দোষ তালাশ করো না। নিজেদের মধ্যে গোয়েন্দাগিরি করো না। পরস্পর হিংসা করো না। ক্রয়-বিক্রয়ে ধোকাবাজি করো না। পরষ্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না। আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (ছহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬০৬৪)।

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট