চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিখ জাতির ইতিহাস অন্বেষা

পূর্বকোণ ডেস্ক

২২ আগস্ট, ২০২০ | ১:৩০ অপরাহ্ণ

করমজিৎ কাউর মালহোত্রা পাঞ্জাবের অতীত-ঐতিহ্য-ইতিহাস সম্পর্কে এবং শিখ জাতির হৃতগৌরব বিষয়ে নতুন করে প্ররোচিত করেছেন অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘The Eighteenth Century in Sikh History:Political Resurgence, Religious and Social life, and Cultural Articulation’ গ্রন্থের মাধ্যমে। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পাতিয়ালার মেয়ে এবং পাতিয়ালার পাঞ্জাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঞ্জাব হিস্টোরিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের তরুণ অধ্যাপক করমজিৎ তাঁর বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সময় সময় আমাকে অবহিত করেছেন এবং অনলাইনে এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার সংলাপও হয়েছে। শিখ জাতির ইতিহাস অন্বেষায় তরুণপ্রজন্মের নেতৃস্থানীয় লেখক-একাডেমিশিয়ান রূপে তিনি যে নিজেকে ক্রমেই অগ্রসর করছেন, এই গ্রন্থ তারই প্রমাণবহ।
ব্যাপকার্থে পাঞ্জাব, শিখ, দেশভাগ, সাহিত্য নিয়ে উল্লেখযোগ্য লেখকের অভাব নেই, যার মধ্যে উজ্জ্বলতর ও অগ্রগণ্য কয়েকজন নারী। অমৃতা (কাউর) প্রীতম, কমলা ভাসিন, উর্বশী বুটালিয়া প্রমুখের যে সৃষ্টিশীল পরম্পরা, তাতে করমজিৎ সাম্প্রতিক ও সর্বশেষ সংযোজন। শিখ ইতিহাসেও বীরোচিত নারীর অভাব নেই, যারা যুদ্ধে, রাজনীতিতে, শিল্পে, সাহিত্যে প্রভূত অবদান রেখেছেন। করমজিৎ সেই উত্তরাধিকারের অনন্য দৃষ্টান্ত। জীবনে কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। বৃত্তি, ডিসটিংশন পেয়েছেন সব সময়ই। আঠারো দশকের অবিভক্ত পাঞ্জাবের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করেছেন। চারটি আন্তর্জাতিক মানের গ্রন্থ রচনা করেছেন। গবেষণা প্রবন্ধ আছে দুই ডজন, যেগুলোর সবই পাঞ্জাব ও শিখ সম্প্রদায়কে ঘিরে, তাদের আর্থ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে। সামগ্রিকভাবে শিখ সমীক্ষা ও চর্চায় নিবেদিতপ্রাণ করমজিৎ।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের সুপ্রাচীন জনপদগুলোর অন্যতম পাঞ্জাব শুধু পঞ্চনদীর দেশই নয়, মহাভারতের ঘটনাবলীর স্বাক্ষী এবং সিন্ধু সভ্যতার লীলাভূমিও। বাংলার মতো পাঞ্জাবের ললাটেও রয়েছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ক্ষত। বাংলায় রাজনৈতিক ও সশস্ত্রভাবে হিন্দু ও মুসলমানগণ মুখোমুখি হলেও পাঞ্জাবে তা ছিল ত্রিমুখী: হিন্দু, শিখ, মুসলমানদের মধ্যে আবর্তিত। এক পর্যায়ে হিন্দু-শিখ জোট বনাম মুসলিমদের সেই ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংঘাত ১৯৪৭ সালের দিনগুলোকে লাশ, রক্ত, আগুনের বিভীষিকায় দগ্ধ করেছিল। খুশবন্ত সিং, সাদাত হাসান মান্টো, কৃষাণ চন্দর প্রমুখ সেসবের অনবদ্য সাহিত্যিক ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন।
পরের ঘটনা সবার জানা। আশি দশকে স্বাধীন খালিস্থান আন্দোলন চরমভাবে দমন করা হয় শিখদের ধর্মস্থান ‘স্বর্ণ মন্দির’-এ ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামক নির্মম সামরিক অভিযান চালিয়ে। তখন মুখোমুখি হয় একদার মিত্র শিখ ও হিন্দুরা। সংঘাত ও পাল্টা-সংঘাতময় ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ায় নিহত হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি এবং এরই ধারাবাহিকতায় হাজার হাজার শিখ মারা যান। বিশ্বে তিন কোটির বেশি জনগোষ্ঠীর শিখ সম্প্রদায়ের অনেকেই দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যান। যদিও এখনো পাঞ্জাবই ভারতের একমাত্র শিখ-প্রধান প্রদেশ, তথাপি বৃহত্তর পাঞ্জাবের বড় অংশ ভাগাভাগির সময় পড়েছে পাকিস্তানে। এমনকি, যে লাহোরকে রাজধানী করে বিশাল শিখ সাম্রাজ্যরা বিস্তৃত হয়েছিল পেশোয়ার পর্যন্ত, তা-ও এখন পাকিস্তানভুক্ত। অথচ এই শিখ ধর্ম ও সম্প্রদান অত্যন্ত নবীন। মাত্র পঞ্চদশ শতকে গুরু নানক কর্তৃত প্রবর্তিত, যাতে হিন্দু ভক্তিবাদ ও মুসলিম সুফিবাদের মিশেল আছে।

রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত শক, দল, হুন, মুঘল, পাঠান ইত্যাদি যে ভারতে একদেহে লীন হয়েছে, সেখানে পাঞ্জাবি জাতিসত্তা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যাদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ ধর্মের লোক রয়েছে। দেশভাগের পর মুসলিম পাঞ্জাবিরা পাকিস্তানের পাঞ্জাব অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পাকিস্তানের রাজনীতি, সামরিক বাহিনী ও অর্থনীতিতে প্রবলভাবে বিরাজমান। আর ভারতের পাঞ্জাব মূলত শিখ প্রধান। পাঞ্জাবি হিন্দুরা পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি ইত্যাদি স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করেন। নতুন ধর্ম সম্প্রদায় হলেও উনবিংশ শতকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে শিখ সামাজ্য প্রবলভাবে বিস্তার লাভ করে রনজিৎ সিং-এর নেতৃত্বে সামরিক, যা পশ্চিমে আফগানিস্তানের কাছাকাছি পেশোয়ার পেরিয়ে খায়বার পাস এবং কাশ্মীর পেরিয়ে চীন-তিব্বত সংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত চলে যায়। তিনি গুজরানওয়ালা থেকে রাজধানী সরিয়ে লাহোরে স্থানান্তরিত করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মূলত যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে, আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এবং ব্রিটিশ আক্রমণের মুখে ১৮৪৯ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিখ সাম্রাজ্য পুরোপুরি ভেঙে যায়। তথাপি পাঞ্জাবি ও শিখরা ইংরেজদের সঙ্গেই সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নেতৃত্বের আসন লাভ করে।

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন বাবর যখন ভারতে আসেন, তখন গুরু নানক শিখ ধর্ম প্রচার শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে বাবরের সদ্ভাব ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে শিখরা বার বার দিল্লির মুঘল রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে এবং ১৭০৭ সালে শক্তিশালী মুঘল নৃপতি আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর শিখ সম্প্রদায় সংঘটিত হয়ে উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। শিখদের একাধিক আক্রমণকেও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়। নবাগত ধর্ম ও নবীন সম্প্রদায় হয়েও দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশ জুড়ে শিখগণ যে রাজনৈতিক প্রভাব, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক-প্রত্নতাত্ত্বিক ছাপ রেখেছেন, করমজিৎ কাউর মালহোত্রা সেসবই তার গবেষণায় সন্নিবেশিত করেছেন। শিখদের নিয়ে বহু গ্রন্থ আছে। খুশবন্ত সিং-এর মতো প্রভাবশালী লেখকরাও গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু করমজিৎ যে সিস্টেমেটিক রিসার্স কাঠামোয় পুরো বিষয়গুলোকে সন্নিবেশিত ও বিশ্লেষণ করেছেন, তা দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। তাঁর গবেষণা শুধু শিখ বা পাঞ্জাব নয়, ব্যাপকভাবে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক ও সামাজিক স্রোতকে একটি সমুদ্র-সমান তথ্যভাণ্ডারে একাকার করেছেন।
পাঞ্জাবি-শিখ নারী করমজিৎ কাউর মালহোত্রা পিতার চাকরির সুবাদে ও শিক্ষার প্রয়োজনে ঘুরেছেন ভারতের ও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা।
বিশ্বায়নের দুনিয়ায় তিনি বসবাস করেন তথ্যগত প্রযুক্তির যাবতীয় উৎকর্ষতা ও সুযোগের মধ্যে আন্তর্জাতিক নাগরিক রূপে। কিন্তু মননে ও সত্ত্বায় পাঞ্জাব অবস্থান করে তাঁর অন্তর্মূলে। পাঞ্জাব ও শিখ বিষয়ক গবেষণা ও চর্চাই তার জীবনব্রত। বর্তমানে করমজিৎ কাজ করছেন শিখ সাহিত্য নিয়ে। গদ্য ও পদ্যে শিখ লেখকরা কালে কালে যেসব বিষয়বস্তু, চিন্তা, দর্শন, জীবনবোধ নিয়ে চর্চা করেছেন, সেগুলোর অভিমুখ ধরার প্রচেষ্টা নিয়েছেন তিনি, যার মধ্য দিয়ে শিখ জাতিসত্ত্বার আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পাটাতনের একটি পূর্ণ অবয়বের সন্ধান করছেন স্বজাতি, স্বসম্প্রদায় ও স্বদেশ অন্বেষী এই ইতিহাসবিদ।

সন্দেহ নেই, পোস্ট-মর্ডান-বিশ্ব চরম উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে বহু জাতিসত্ত্বাকে গ্রাস করেছে। বিশ্বায়নের তথ্যের ভাণ্ডারে ভাসিয়ে দিয়েছে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও স্বাধীনতাকামীদের। এই তালিকায় মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দি, ইউরোপের বসনিয়ান, দক্ষিণ এশিয়ার তামিল, আরাকানি, শিখ, মনিপুরি, নাগা ও মিজোদের মতো বহু জাতিসত্ত্বার দেখা পাওয়া যায়। হয়ত তারা একদা উন্নত ও স্বকীয় শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। হয়ত লড়াই করেছে কিন্তু জয়ী হতে পারেনি। হয়ত অবদমনের মধ্যেও বুকে লালন করছে জাগৃতির তপ্ত বাসনা। করমজিৎ সম্ভবত তাঁর প্রজন্ম ও পরম্পরার জন্য সেইসবের ধারাভাষ্য লিপিবদ্ধ করে রাখছেন।

ড. মাহফুজ পারভেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট