চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আল বিদা মাহে রামাদান

ডা. মো. ওমর ফারুক

২৩ মে, ২০২০ | ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

জীবন থেকে চলে যাচ্ছে এবারের রমজান, কি পেলাম আর কি হারালাম সেটি বিবেচনার সময় এসেছে এখন। আগামী বছরের রমজান মাসটি আমাদের ভাগ্যে জুটবে কিনা সেটি জানেন একমাত্র মহান রাব্বুল আ’লামিন। এই মোবারক মাসটি চলে গেল আমাদের জীবন থেকে-তা টেরই পেলাম না। জীবনের পদে পদে রমজান মাসের গুরুত্ব গেঁথে দিয়েছি কিনা, সেটির পরিচর্যা ও পর্যালোচনার সময় এসেছে এখন। যে ব্যক্তি এ মহান মাসটি হাতের কাছে পেয়েও তা সঠিকভাবে জীবনের সর্বত্র প্রয়োগ করতে পারেননি তার মতো হতভাগা আর কে হতে পারে? এ মাস আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নেয়ামত, নেয়ামতের শোকরগুজার না করলে আল্লাহ্ তা কেড়ে নেন। রমজান মাসের নেয়ামত পেয়েও যারা কদর করেননি রমজান মাস তার উপর লানত দেয়। যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ গুনাহ মাফ করাতে পারলনা সে তো চরম হতভাগা। এ মাসের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব হচ্ছে মাবুদের কাছে গুনাহ মাফ চাওয়া। এ মাসের শেষ দশকের এক মর্যাদাপূর্ণ বেজোড় রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাযিল হয়েছে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা) এর উপর। সেজন্যেই এ মাসের মর্যাদা এতো বেশি।
আল্লাহতায়ালা বলছেন, তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর অন্বেষণ কর। হযরত মা আয়েশা রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল (সা) এই মর্যাদাপূর্ণ শবে কদরের রাতে আমি আল্লাহর কাছে কি চাইব? জবাবে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, এ রাতে শুধু গুনাহ মাফ চাইবে। সিয়াম-কিয়াম, ইফতারের পূর্বে সব জায়গায় রয়েছে গুনাহ মাফের অপূর্ব সুযোগ। রাসূল (সা) এর সামনে-পেছনের সব গুনাহ আল্লাহতায়ালা মাফ করে দিয়েছেন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা), আপনার তো জিন্দেগীর সব গুনাহ মাফ তবুও কেন এতক্ষণ নামাজে দাঁড়িয়ে থাকেন? তিনি বলেন, আমি কি আল্লাহর শোকরগুজার বান্দা হব না? বিশ্বনবীকে জিজ্ঞেস করা হল : দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দামি অংশ কোনটি? আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, রাতের শেষ অংশ-রাত যখন তিন ভাগের এক অংশ বাকী থাকে তখন আল্লাহতায়ালা গুনাহ মাফের জন্য বান্দাদের ডাকতে থাকেন। প্রত্যেক রাতের শেষ অংশে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালা সপ্তম আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, আমার কাছে দোয়া কবুলের কেউ আছো নাকি ? আমি আল্লাহতায়ালা দোয়া কবুলের জন্য হাজির হয়েছি-সুবহানাল্লাহ্। কারো কি চাওয়ার কেউ আছো? সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ ইত্যাদি। হযরত কাতাদাহ (রা) হযরত আবদুল্লা ইবনে ওমর (রা) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমাদের আব্বাদের রাত কিভাবে যেতো? ওমর (রা) বলেন, রাত যখন শেষের দিকে তখন আমাদের আব্বাদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যেত। ইবনে হিব্বান ও ইমাম তাবারানী রেওয়ায়েত করেন, মিম্বরের দ্বিতীয় সারিতে যখন রাসূল (সা) পা দিলেন তখন হযরত জিবরীল আমিন (আ) লানত দিলেন-তাদেরকে ধ্বংস করে দাও, যাদের সামনে রাসূল (সা) এর নাম উচ্চারণ করা হয় অথচ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলা হয় না। জবাবে রাসূল (সা) আমিন বললেন। মিম্বরের তৃতীয় সারিতে যখন পা দিলেন, তখন জিবরীল আমিন (আ) লানত দিলেন তাদের ওপর যারা আব্বা-আম্মা দু’জনকে পেয়েও জান্নাতি হতে পারল না কারণ জান্নাত তো তার মা-বাবার পায়ের নীচে। রাসূল (সা) বলেন, জান্নাত তো তার মা বাবার সন্তুষ্টির ভেতর রয়েছে। জনৈক সাহাবি জিজ্ঞস করলেন, পিতা-মাতার উপর আমার কি হক? রাসূল (সা) বলেন, হে প্রশ্নকারী-জান্নাত জাহান্নাম তো তোমার মা বাবার সাথে। হযরত আকলামা (রা) কে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্যে বললেন রাসূল (সা), কারণ তিনি কলেমা পড়তে পারছিলেন না। খবর দেয়া হল তার মাকে এবং জিজ্ঞেস করা হল : আপনার পুত্র সন্তানের উপর কোন ক্ষোভ-দুঃখ আছে কিনা? মা বললেন, সে আমার কলিজার ভেতর আঘাত দিয়েছে-আমি তাকে মাফ করতে পারব না। রাসূল (সা) লাকড়ি আনতে বললেন এবং জীবন্ত অবস্থায় তাকে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছিল এবং কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে-তখন তার মা চিৎকার করে বললেন, হে রাসূল (সা) আমার সন্তানকে জ্বালাবেন না-আমি তাকে মাফ করে দিলাম। তখন হযরত আকলামা (রা) কলেমা পড়লেন এবং সাথে সাথে ইহলোক ত্যাগ করলেন। মহান রাব্বুল আলামিন এত কঠিনভাবে কারো হক বর্ণনা করেননি মা-বাবার হক ছাড়া। মা-বাবার সাথে শক্ত আওয়াজে কথা বলা যাবে না। তাঁদের সাথে কথা বলতে হবে ন¤্র ভাষায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা তোমাদের আনুগত্যের ডানা বিছিয়ে দাও মা-বাবার কদমের নীচে। এত মর্যাদা মা-বাবার অথচ সে মা-বাবার সাথেই আমরা বিভিন্ন সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে ব্যবহার করি এবং তাদের মনে কষ্ট পাওয়ার মত কাজ করে থাকি, যেটা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং কবিরা গুনাহ। এ ধরনের কোন আচরণ করা যাবে না যাতে করে মা-বাবা ওহ্, আহ্ শব্দ করেন। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা তিন তিনবার কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন পবিত্র কুরআনুল করিমে-যেটা আমাদের জন্য ফরয। এ রমজান মাসের দাম হলো আল্-কোরআনের কারণে। যেমনি লাখো হরিণের মাঝে একটিমাত্র হরিণে মৃগনাভী রয়েছে- যেখানে থাকে সুগন্ধীযুক্ত কস্তুরী। তেমনিভাবে বার মাসের শ্রেষ্ঠ মাস এ রমজান আর কোরআন নাযিলের কারণে এ মাসের মর্যাদা অতি সুউচ্চ, অতি সুমহান। এ বিশাল আকাশে গ্যালাক্সি রয়েছে চল্লিশ হাজার কোটির উপরে। গ্যালাক্সির ভেতর লুকিয়ে থাকে লক্ষ কোটি তারকা, যেগুলোর আকার সূর্যের চাইতে লক্ষগুণ বড় আর সূর্য পৃথিবীর চাইতে ১৩ লক্ষ গুণ বড়। এ বিশাল তারকারাজির কসম খেয়ে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরানুল করিমের বিশালতাকে বুঝিয়েছেন। যেটার প্রতিটি বর্ণ এসেছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে-যেখানে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আল্লাহতায়ালা সূরা ইউনুছ-এ বলেন, তামাম জিন্দেগীর দিনগুলোকে যদি ঈদ বানানো হয় তবুও কোরআন পাওয়ার ঈদ শেষ হবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, পৃথিবীর সমস্ত সোনা-রুপা-হীরা এক করলেও পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের সমানও হবে না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাইবেল বিশেষজ্ঞ ড. ক্যাম্পবেলকে উদ্দেশ্য করে বিখ্যাত পারস্পরিক ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ডা. জাকির নায়েক বলেন, তোমার কিতাবের ঊনচল্লিশ পয়েন্টের মধ্যে এক একটি পয়েন্টের ভুল সংশোধনের জন্য সারা জিন্দেগীর হায়াত শেষ হয়ে যাবে তবুও ভুল সংশোধন করতে পারবে না। তুমি আল্-কুরআনুল করিমের আঠারটি পয়েন্টের ভুল ধরেছ আর আমি সাথে সাথে তার জবাব দিয়েছি। হেদায়াত আল্লাহতায়ালার কাছে। আর কোরআন হেদায়াতের কিতাব। ব্রিটিশ পন্ডিত ড. নিকলসন বলেন, পবিত্র কোরআনে এক হাজারের উপর বিজ্ঞানের আয়াত রয়েছে এবং এর জের, জবরের মধ্যেও ব্যাকরণ রয়েছে। তিনি বলেন, আল্ কোরআন শব্দের এক ভয়ংকর অভিধান আর এতে রয়েছে উন্নতমানের সাহিত্যের পান্ডিত্য। আমার পান্ডিত্য মধ্যাহ্ন সূর্যের কাছে জোনাকির আলো। এটি হলো আইন ও প্রশাসনের বিশ্বকোষ। আফ্সোস এ মোশরেক ব্যক্তির কাছে আমরা মুসলমানরা পরাজিত কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন কোরআনের বিশালতা আর আমরা অভাগারা বুঝতে পারিনি এখনো কোরআনের শান, কোরআনের মর্যাদা আর কোরআনের বিশালতা। আল্লাহতায়ালা বলেন, এটি একটি যা’লিকাল কিতাব-যেটির কথা বলেছিলেন সোয়া লক্ষ পয়গম্বর। সে কিতাবের আওয়াজ কেউ সইতে পারবে না শুধুমাত্র সায়্যিদিনা মুরসালিন, খাতেমুন নাবিয়্যিন রাসূলুল্লাহ (সা) ছাড়া। এটি যদি পাহাড়ের উপর নাযিল হত তবে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেত। এ কিতাব একটি মুসাদ্দেকান অর্থাৎ সত্যায়নকারী। সোয়া লক্ষ পয়গাম্বরের কথা সত্যায়নকারী।
কোরআন এসেছে দুটি ম্যাসেজ নিয়ে। আর তা হল : জালেমদের জন্য দুঃসংবাদ আর নেক্কারদের জন্য সুসংবাদ। কোরআনের দাবী হল : ১) পুরো কোরআন পাঠ ২) কোরআন জানা-বুঝা আর এটি ফরজ ৩) এটির প্রত্যেক বর্ণের উপর ঈমান আনা ৪) এ কিতাব যেটা হারাম করেছে সেটা মানা এবং জিন্দেগীর প্রতিটি পদে পদে এটির অনুসরণ-অনুকরণ করা। এ কিতাবের দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে সমগ্র পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, প্রতিটি অণু-পরমাণুতে আর প্রতিটি মানুষের হৃদয়পটে।

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক সভাপতি, রাউজান ক্লাব; সিনিয়র কনসালটেন্ট, ইএনটি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট