চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

পবিত্র ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য ও গুরুত্ব

ড. আ. ম. কাজী মুহাম্মদ হারুন উর রশীদ

২৩ মে, ২০২০ | ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ

সারাবিশ্বের মুসলিমদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর অনাবিল আনন্দ ও উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। এ ঈদুল ফিতর মুমলিমদের জীবনে অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। একমাস রোজা পালনের পর এক ফালি উদিত চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদের আগমনী বার্তা। বছরে মুসলমানদের দু’টি প্রধান উৎসব রয়েছে। একটি হচ্ছে ১ শাওয়াল তারিখে ঈদুল ফিতর এবং অপরটি হচ্ছে ১০ জিলহজ দিবসে ঈদুল আজহা। মুসলিমমিল্লাতের কাছে এ উৎসব প্রতিবছর আনন্দের দিন হিসেবে আসে। রোজা পালনের মাধ্যমে রোজাদার যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সৌন্দর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, ইসলামের যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, ক্ষমা ও মহানুভবতা মনুষ্যত্বের গুণাবলী বিকশিত হয় এবং গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণœ রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর আমাদের কাছে আসে।
‘ঈদ’ আরবি শব্দ। এর অর্থ খুশি। আর ‘ফিতর’ মানে ভঙ্গ করা। দীর্ঘ একটি মাস কঠোর সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহতায়ালার বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ যে আনন্দ উৎসব পালন করে সেটিই ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর ইসলামের রীতি-নীতি অনুযায়ী ধর্মীয় দায়িত্বসমূহ পালন করার মধ্যেই প্রকৃত শান্তি নিহিত রয়েছে। ঈদুল ফিতর মুসলিমদেরকে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য এবং ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা দেয়। এভাবে ঈদুল ফিতরের উৎসব ইসলামি জীবন পদ্ধতির ভিত্তিতে একটি বিশ^জনীন নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। এ আনন্দের দিনে প্রতিটি মুসলিম তার সামাজিক অবস্থান ভুলে যায় এবং ভ্রাতৃত্ববোধের পর তৃপ্তিতে একে অপরকে আলিঙ্গন করে। ঈদগাহে ময়দানে সারিবদ্ধভাবে জামাতের সঙ্গে ঈদুুল ফিতরের দ’ুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষেই সাম্যের অতুলনীয় বাস্তব দৃশ্যের চিত্র ফুঠে ওঠে। এ উৎসবের দিন মুসলিম সমাজে সার্বজনীন সালাত ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এ নামাজ ওয়াজিব। এতে শুধু দু’রাকাত সালাতের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অন্যান্য নামাজ থেকে এ নামাজের আদায় পদ্ধতি ভিন্ন ও পৃথক। এ নামাজের প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমার পর সুবহানাকা পাঠ করে তিনটি অতিরিক্ত তাকবির দিতে হয়। তারপর সুরা ও কিরাত পাঠ করে রুকু ও সিজদা আদায় করে দ্বিতীয় রাকাতে দাঁড়াতে হয়। এ দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ও কিরাত পাঠ করে অতিরিক্ত তিনটি তাকবির দিতে হয় এবং এর পরই তাকবির বলে রুকুতে যেতে হয়। তারপর সিজদা শেষে নামাজ যথারীতি শেষ করতে হয়। উল্লেখ্য যে, ঈদের নামাজে এ অতিরিক্ত ছয় তাকবিরে হাত ছেড়ে দিতে হয় এবং প্রথম রাকাতে সর্বশেষ তাকবিরের পর যথারীতি হাত বাঁধতে হয়। আর দ্বিতীয় রাকাতে অতিরিক্ত তিন তাকবির আদায় করার পর হাত না বেঁধে রুকুতে তাকবির বলে যেতে হয়। এ নামাজের পর ইমাম সাহেব দু’টি খুৎবা দেন। সালাতুল ঈদের আগে কোনো আজান বা ইকামত নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকলে উন্মুক্ত স্থানে ঈদগাহে এ নামাজ পড়া উত্তম। সূর্যোদয় ও সূর্য মধ্যগগণে হওয়ার মধ্যবর্তীকালীন এ নামাজের সময়।
হানাফি মাজহাব মতে সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। ইমাম শাফেয়ির মাজহাব মতে ফরজ। ঈদের দিনের আগেই ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় না করলে ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগেই ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় করতে হয়। এ সাদাকা দুঃস্থগণকে ঈদ উৎসবে যোগদানের সুযোগ দেয় এবং তা সিয়ামকে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে পবিত্র করে। সাদাকাতুল ফিতরকে সাধারণত ‘ফিতরা’ বলা হয়। এটা প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসেরই নির্ধারিত সাদাকা। রমজান মাস শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন উপলক্ষে মাথাপিছু যে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সাহায্য গবির-মিসকিনকে সাদাকা করা হয় তাকে সাদাকাতুল ফিতর বলে। রমজানে পুরো একটি মাস মুমিনগণ রোজা পালন করেন এবং ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। দায়িত্বগুলো পালনের ক্ষেত্রে নিজের অজান্তে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা এ ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণের জন্যে শরিয়তে রমজানের শেষে সাদাকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। সাদাকাতুল ফিতর দ্বারা রোজার মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হবে এবং গরিব-মিসকিন মুসলিমগণ খাওয়া-পরার জিনিসপত্র সংগ্রহ করে অন্যান্য মুসলিমদের সঙ্গে ঈদের জামায়াতে শরিক হতে পারবে। এর মাধ্যমে ধনী-গরিবদের ব্যবধান কমে আসে এবং সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে তা আদায় করবে তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পরে তা আদায় করবে তা তার জন্য একটি সাধারণ দান হিসেবে গণ্য হবে। যে ব্যক্তির কাছে ঈদের দিন সুবহি সাদিকের সময় জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ছাড়া সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সমমূল্যের সম্পদ থাকে তাঁর ওপর সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। এ সব সম্পদ বা অর্থ যদি কারও হাতে ঈদের দিন সুবহি সাদিকের সময়ও আসে তাঁকেও ফিতরা দিতে হয়। ছোটো-বড়ো, স্ত্রী-পুরুষ প্রত্যেকের পক্ষে এ সাদাকা আদায় করা ওয়াজিব। নিজের ও নাবালেগ সন্তানাদির পক্ষ থেকেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। গৃহকর্তা এবং তার পোষ্যদের সংখ্যাকে হিসাব করে প্রতিজনের বিপরীতে নির্ধারিত মূল্য সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। সাদাকাতুল ফিতর যা দিয়ে আদায় করা যাবে তা হচ্ছে- গম, আটা, ময়দা, যব, কিসমিস, খেজুর ও পনির ইত্যাদি পণ্যগুলো দিয়ে। এবার জাতীয় ফিতরা নির্ধারণ কমিটির মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফিতরা নির্ধারণ করেছেন জনপ্রতি সর্বনি¤œ ৭০ (সত্তর) টাকা এবং সর্বোচ্চ ২২০০ (দুই হাজার দু’শ) টাকা। ঈদের দিনে কিছু কাজ করা মুস্তাহাব। সেগুলো হচ্ছে- ১. গোসল করা। ২. উত্তম ও পরিষ্কার জামা-কাপড় পরা। ৩. ঈদুল ফিতরের দিন বের হওয়ার আগে মিষ্টান্ন খাবার খাওয়া। ৪. বাড়ি থেকে বের হয়ে জোরে তাকবির পাঠরত অবস্থায় ঈদগাহে যাওয়া। ৫. পদব্রজে ঈদগাহে যাওয়া। ৬. ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে আসা। ৭. দান-খায়রাত করা। ৮. সুগন্ধী (আতর) ব্যবহার করা। ৯. লোকজনের সাথে মোসাফাহা করা। ১০. মিসওয়াক করা। ১১. উন্মুক্ত আকাশের নিচে খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করা। ১২. ঈদগাহে মহিলাদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা রাখা এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে ইদগাহে যাওয়া
ঈদুল ফিতরের ফজিলত স¤পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, ঈদুল ফিতরের দিন ফিরিশতাগণ রাস্তার মুখে মুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন- হে মুসলিম জাতি! ভালোকাজের ক্ষমতাদাতা ও সাওয়াবের আধিক্যদাতা আল্লাহর কাছে অতি শিগ্গিরই চলো। তোমাদের রাতে ইবাদত করার হুকুম করা হয়েছিলো, তোমরা তা পালন করেছো। তোমরা তোমাদের রবকে খাওয়ায়েছো (অর্থাৎ গরিব-মিসকিনকে খাবার দিয়েছো) আজ তার পুরস্কার গ্রহণ করো। অতঃপর মুসলিমগণ যখন ঈদের নামাজ পড়ে তখন একজন ফিরিশতা উচ্চস্বরে বলতে থাকেন- ‘তোমাদেরকে তোমাদের রব ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখন তোমরা তোমাদের পুণ্যময় দেহ-মন নিয়ে নিজ ঘরে ফিরো।’ (আল-মুজামুল কাবির, হাদিস নং ৬১৮)।
এবারের ঈদে আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, করোনামুক্ত হোক পৃথিবী। সকল বিপদ দূরীভূত হয়ে পৃথিবীতে নেমে আসুক সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। আগামি দিনগুলো সত্য, সুন্দর ও সৌন্দর্যম-িত হোক। হাসি-খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক।

ড. আ. ম. কাজী মুহাম্মদ হারুন উর রশীদ কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট