চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

বিশ্ব ফ্যামিলি ডাক্তার দিবসের ভাবনা

(গতকালের পর)

আহমেদ শরীফ শুভ

২০ মে, ২০২০ | ২:০০ পূর্বাহ্ণ

অনেকেই ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা ফ্যামিলি ডাক্তারকে কোন নির্দিষ্ট পরিবার বা পরিবারগোষ্ঠির ডাক্তার মনে করেন। বিষয়টি পুরোপুরি তা নয়। একজন ফ্যামিলি ডাক্তার তার কাছে যে সব রোগী নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নেন তার সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন, সেই সাথে তিনি সাধারণত তার রোগীদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন এবং সেই সাথে বিশেষজ্ঞ সেবার সামগ্রিক সমন্বয় করেন। সে কারণেই তাকে ফ্যামিলি ডাক্তার বলা হয়।
বাংলাদেশে ফ্যামিলি মেডিসিনের প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা ব্যাপকভাবে প্রসার পায়নি বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই শাখাটি ক্যারিয়ার হিসেবে তেমন গড়ে উঠেনি। সে কারণেই পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়ে গেছে বিশেষজ্ঞনির্ভর। একজন বিশেষজ্ঞকে দিনে এত বেশি রোগী দেখতে হয় যে, তারা অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট সময় নিয়ে রোগী দেখার সুযোগ পান না। এবারে কোভিড-১৯ মহামারীতে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত পিপিই না থাকায় অনেক ডাক্তারই প্রথমদিকে তাদের চেম্বার বন্ধ রেখেছিলেন। তাতে রোগীদের যথেষ্ট অসুবিধা হয়েছে। অনেকেই আবার একাধিক রোগে ভুগছেন, তাদের একাধিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ দরকার। কিন্তু তারা কাউকেই দেখাতে পারছিলেন না। অনেকেরই হয়তো চিকিৎসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়োজন হয়েছে। প্রত্যেক রোগীর যদি ফ্যামিলি ডাক্তার থাকতেন তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি তার রোগীদের প্রাথমিকভাবে টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে এবং যাদের সামনাসামনি দেখা দরকার তাদের স্ক্রিনিং করে চেম্বারে দেখতে পারতেন। যেহেতু ফ্যামিলি ডাক্তার তার রোগীর সামগ্রিক চিকিৎসার জন্য দায়বদ্ধ, নিয়মিত রোগীকে উপেক্ষা করার সুযোগ তার নেই। এমনকি মহামারীর কালেও সেই রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তার। সুতরাং, রোগী সামনাসামনি বা টেলিফোনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারবেন। এমনকি করোনার উপসর্গ নিয়ে কোন রোগীকে হাসপাতালে যেতে হবে আর কোন রোগী বাসায় থেকে চিকৎসা নিতে পারবেন, এটাও একজন ফ্যামিলি ডাক্তার পার্থক্য করে দিতে পারবেন। ফলে হাসপাতালের উপর চাপ যেমন কমবে, রোগীদেরও এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে দৌড়ানোর ভোগান্তি কমে আসবে। ফ্যামিলি ডাক্তার যেহেতু একজন রোগী এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকেন, তার পক্ষে স্বাস্থ্যসমস্যাগুলো চিহ্নিত করা অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্যও বটে।
ফ্যামিলি ডাক্তার ব্যবস্থার সুফল পেতে হলে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। একদিকে যেমন রেফারেল প্রথা চালু করতে হবে, অন্যদিকে তেমন জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বীয় জ্ঞানকে হালনাগাদ করার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সরকার এবং বাংলাদেশে মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল স্বীকৃত উচ্চতর ডিগ্রি লাভের সুযোগ থাকলে ব্যাপকসংখ্যক ডাক্তার ফ্যামিলি মেডিসিনকে ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহী হবেন। এই ডিসিপ্লিনকে আকর্ষণীয় করতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আউটডোর সেবা সমন্বয় করার জন্য ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। সেই সাথে আইন করে রেফারেল প্রথা চালু করলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই শাখায় ডাক্তারদের অধিকসংখ্যায় উৎসাহী করা যাবে। তাতে রোগীরা যেমন উপকৃত হবেন বিশেষজ্ঞ সেবার উপরও চাপ তেমন কমবে।
আশার কথা এই যে, দেরিতে হলেও সরকার ও নীতিনির্ধারক মহলের এই নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের জেনারেল প্র্যাকটিস পুনর্বিন্যাস নিয়ে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সবাই ব্যস্ত থাকায় এই প্রক্রিয়াটি এখন থেমে আছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে তা আবার গতি পাবে বলে আশা করছি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে এবং বিশেষজ্ঞসেবার উপর চাপ কমাতে হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ফ্যামিলি ডাক্তারদের ভূমিকা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা ও মূল্যায়নের কোন বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ফ্যামিলি ডাক্তারদের যথাযোগ্য ভূমিকা নিশ্চিত করতে হলে তাদের প্রশিক্ষণ হালনাগাদ করা ও উচ্চতর ডিগ্রির সুযোগ করে দেয়ার বিষয়টির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশে বর্তমানে এই সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। কিছু কোর্স আবার বেশ দীর্ঘমেয়াদী। বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকদের আগ্রহী করে তুলতে তাদের ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে কিছু স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমরা জেনেছি কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় সহসাই এমন কিছু স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে, যা ফ্যামিলি ডাক্তার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা চিকিৎসকদের মানোন্নয়নে এবং রোগীসাধারণের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামনের সারির যোদ্ধা ফ্যমিলি ডাক্তাররা নানা রকম প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা নিজেদের সংগঠিত করে পেশার অবস্থান দৃঢ় করতে ও তার মানোন্নয়নে সচেষ্ট হবেন এবারের বিশ্ব ফ্যামিলি ডাক্তার দিবসে এই প্রত্যাশা রইলো।

আহমেদ শরীফ শুভ অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ও সমাজকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট