চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

করোনার করুণা নয়, চাই কার্যকর মূল্যায়ন

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

১২ মে, ২০২০ | ২:৩৮ পূর্বাহ্ণ

এটি অনস্বীকার্য যে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং প্রাণসংহারের বাস্তবতায় বিশ্ব আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে উদ্ভূত হয়েছে প্রচ- উৎকণ্ঠা। ভয়াবহতার ক্ষিপ্রমাণতা কিছুটা সংকুচিত হলেও এর ক্রমবর্ধমান বিস্তার ও সুদূরপ্রসারী সামগ্রিক প্রভাব বিশ্ববাসীকে করেছে অজানা আশংকায় অতিশয় দিগ্ভ্রান্ত। মহামন্দা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং সর্বোপরি বিশ্বব্যবস্থায় সম্ভাব্য পরিবর্তন নতুন এক দীপ্তিশূন্য ধারণায় নিষ্পিষ্ট। নানা মাত্রিকতায় দক্ষিণ এশিয়া বিপর্যস্ত হওয়ার সাম্প্রতিক ইঙ্গিত প্রচিত হলেও আমাদের জনবহুল এই ক্ষুদ্র জাতি-রাষ্ট্র, এর প্রাবল্য উত্তরণে কতটুকু প্রস্তুত তা বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ইতোমধ্যে করোনাযুদ্ধ জয়ে মহান সেনাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সফলতার নিষেবণ তৈরি করতে জাতি অনেকটা সক্ষম হয়েছে। অকুতোভয় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যসেবী, গণমাধ্যমকর্মী, সেনা ও আইনশৃংখলাবাহিনীর দৃশ্যমান প্রয়াস নিরন্তর সমাদৃত।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সম্মুখসমর যোদ্ধাদের আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণের পরিসংখ্যান কোনভাবেই তাদের যথার্থ সুরক্ষা প্রদানে ও ত্যাগ-কর্মের মূলায়ণে জাতি প্রশংসন পর্যায়ে নয়। দেশব্যাপী স্বাস্থ্য সুরক্ষার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং সেবাদানের পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়ন, পরিমেয় জনসমাগম, পরীক্ষণ সুব্যবস্থাসহ হাসপাতালসমূহে প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা সংক্রমণ সম্ভাবনাকে বাচনিক প্রলিপ্তবলয়ে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে কিনা; তা খতিয়ে দেখা জরুরি। যে অসীম প্রাণস্পন্দন, নির্ভীকতা, সাহসীকতা, দক্ষতা এবং সেবাদানের মহিমান্বিত আবেগ ও আগ্রহ এই মহামারি প্রতিরোধ ও জয়ে সেবা চরিষ্ণুদের মার্গশীর্ষ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপনে অণুপ্রাণিত করতে, এর ভজ্যমান বিনিময় বা মূল্যায়ন তাদের অবশ্যই প্রাপ্য।
শুধু মাত্র অর্থ প্রনোদনা নয়, বিরচন প্ররোহের সম্মাননা ঘোষণায় নিঃসন্দেহে তারা অধিকতর প্রমুদিত কৃদন্ত হবে। বঙ্গবন্ধু যেমন মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ডাক্তারদের নামফলক পিজি হাসপাতালের দেয়ালে খোদাই করে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষ থেকে করোনাযুদ্ধেও শহীদ ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সকলের স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের ঘোষণা অবশ্যই পরাবর্ত বক্ষমাণ অধ্যায়ে তাদের স্মৃতিকে অম্লান করবে- এটিই দৃঢ়ভাবে বলা যায়। এতে একদিকে যেমন তারা তৌর্যত্রিক শক্তিতে প্রাণিত হবে, তেমনি দেশবাসীও অধিকতর জ্ঞাপয়িতা মর্যাদার প্রতিকৃতি হবে। সম্পূরক ও পরিপূরক মনস্তাত্ত্বিক প্রকীর্তি নির্মাণে জাতি হবে ইতিহাস সমৃদ্ধ।
বিশ্বখ্যাত জ্ঞানমানস দর্শন ও মানবতার কৌমুদী বর্তি নোবেল বিজয়ী বারট্রান্ড রাসেল আত্মজীবনী গ্রন্থের ভূমিকায় জীবনপ্রবাহের নির্যাস উম্মোচনে মানবপ্রেম, জ্ঞানের অসীম অনুসন্ধান এবং আর্তমানবতার অবর্ণনীয় ব্যথা-বেদনার সর্বাঙ্গীন অনুভূতিকেই সর্বোচ্চ আরাত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন। অভীপ্সিত আবেগ ও বিজ্ঞানতপস্যার সমন্বিত অর্জনই হচ্ছে আধুনিক মানবসভ্যতার মৌলিক সৃষ্টিসূত্র। এরই ভিত্তিতে মানবতার ক্রমবিকাশ নানা মাত্রিকতায় ধরিত্রীর বর্তমান অবস্থানকে আলো-আধারে পরিমার্জিত ও পরিশীলিত করেছে। এখনো মানবসমাজে অনেকাংশে মনুষ্যত্বের নিরীক্ষমান নান্দীপাঠ মহৎ গুণ এবং পরহিংসক নির্গুণ বলয়ে প্রচ- বিভাজিত। বারট্রান্ড রাসেলের ধারণায় ‘বিশ্লেষণের সমস্যাই হচ্ছে দর্শন’। করোনাকালের অসহায় অভিজ্ঞতা উল্লেখ্য বিশ্লেষণ-দর্শনের ভিত্তিতে করোনা গবেষণা লোকোত্তর অর্জন-অভিধায় অবশ্যই সঞ্জীবনী হবে এবং পৃথিবী নামক এই গ্রহের ভবিষ্যৎকে মহামারি জয়ী-বান্ধব করে তুলবে। সমাজের সকল শাসন-শোষণ-নিপীড়ন-নিবর্তন পরিহারে বিশ্ববাসী নতুন চিন্তা-চেতনায় প্রচীয়মান হবে। মনুষ্যত্ব ও মানবতার নবতর অনুসন্ধান মানবসভ্যতাকে ব্যতিক্রম পদপ্রদর্শনে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। ভোগবাদি সাম্প্রতিক বিশ্বায়ন আধুনিক মানবিক সমাজ সভ্যতার প্রাগ্রসরতার মূলে যে কুঠারাঘাত হেনেছে, বিরোধ-বিচ্ছেদ-বিভাজন-বৈষম্যের দেয়াল নির্মাণ করে মানবিকতাকে হত্যা করেছে, আক্রান্ত করোনাবিশ্বের উপলব্ধিতে এর নিধনকল্পে বিশ্ববাসী সত্যাপন্য মূল্যবোধ আবিষ্কারে অধিকতর সতৃষ্ণ হবে- এটিই প্রত্যাশিত।
করোনা মহামারির বিস্তার প্রতিরোধে শুধু সাম্প্রতিক সময়ের জন্য নয়, ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি থেকে উত্তরণে স্থায়ী প্রতিষেধক টিকা বা মন্দা, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য পরিত্রাণে বিকল্প ব্যবস্থার প্রায়োগিক জ্ঞান-প্রসারণ, প্রগতি-প্রবোধ ধৈর্য-ত্যাগ-সংযম ইত্যাদির আচরণগত মূল্যবোধ-কৃষ্টি ও আদর্শিক অনুষঙ্গগুলো জাগরুক করা যদি না যায়, তাহলে করোনা মহামারির এই যুদ্ধে পরিপূর্ণ জয় সুদূরপরাহত। মনুষ্যত্ব বা জীবন-জীবিকার সম্ভাব্য পন্থা নির্ধারণে এই ধরণের মহামারি শুধু ব্যাবর্তন প্রতিবন্ধক হিসেবে নয়, ধর্ম-বর্ণ-দেশ-জাতি-ভৌগোলিক অঞ্চল নির্বিশেষে মনুষ্যত্ব-মানবতার বিশ্বজনীন সংস্কৃতির নবজাগৃতির সম্ভাবনাকে অধিকতর অত্যুজ্জ্বল করবে- নিঃসন্দেহে তা বলা যায়।
সম্মিলিতভাবে শুরুটি করতে হবে প্রজন্মের শিশুদের মাধ্যমে, যারা আজ এই মহামারিকালে ঘরবন্দি অবস্থায় গভীর মানসিক নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। নানাবিধ অপরাধপ্রবণতা চারিদিকে গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। এর প্রতিকার-পরিত্রাণ প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ, সৃজনশীলতা, মানুষের প্রতি মমত্ব-ভালোবাসা-শ্রদ্ধাবোধ বিনিময়ের অবারিত অনুশীলণে উপযুক্ত ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দীপ্যমান দ্যোতনা-নির্যাস নির্ণয়ে অপরিমেয় তেজস্বী ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখ করতে চাই; বাল্যকালকে গভীর রেখাপাতে উজ্জ্বীবিত করার অভূতপূর্ব ত্রৈবিদ্য কবি কুসুমকুমারী দাশের ‘মনুষ্যত্ব’ কবিতাখানি। ‘একদিন লিখেছিনু আদর্শ যে হবে/“কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে”/আজ লিখিতেছি বড় দুঃখ লয়ে প্রাণে/তোমরা মানুষ হবে কাহার কল্যাণে?/মানুষ গড়িয়া ওঠে কোন্ উপাদানে;/বাঙালি বোঝেনি তাহা এখনো জীবনে-/পুথিঁ হাতে পাঠ শেখা-দু-চারটে পাশ/আজিকার দিনে তাহে মিলে না আশ্বাস,/চাই শৌর্য, চাই বীর্য, তেজে ভরা মন-।’
কী অসাধারণ উপমায় জ্ঞাপিত উল্লেখ্য কবিতার উপস্থাপন, ‘…“মানুষ হইতে হবে” হবে এই পণ-/বিপদ আসিলে কাছে হবে আগুয়ান/দুই খানি বাহু বিশ্বে সবারি সমান-/দাতার যে দান তাহা সকলেই পায়/কেউ ছোট কেউ বড় কেন হয়ে যায়!/কেন তবে পদতলে পড়ি বারবার?/“মনুষ্যত্ব” জাগাইলে পাইব উদ্ধার-।/যত অপমান, যত লাঞ্ছনা পীড়ন/একতার বলে সব হইবে দমন!/তেজীয়ান, বলীয়ান সেই ছেলে চাই/সোনার বাংলা আজি হারায়েছে তাই।/আবার গড়িতে হবে বীর শিশুদল,/বাংলার রূপ যাহে হবে সমুজ্জ্বলÑ’। করোনাকালে জ্ঞানাঙ্কুর এই কবিতার মর্মার্থ কী অনবদ্যভাবে বর্তমান দেশের পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছে- তা বর্ণনাতীত।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গরীব-দুঃখী, দারিদ্র্যপীড়িত দিনমজুর, কৃষক-শ্রমিক আপামর জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ ত্রাণ বিতরণে যখন দেখি ক্ষমতা-নৈরাজ্য-সমন্বয়হীনতা ইত্যাদির প্রচ- অব্যবস্থা, কতিপয় ঘৃণ্য জনপ্রতিনিধীদের ত্রাণ চুরি, নানান গণহয়রানী, স্বাস্থ্য-বাণিজ্য-কৃষি-ধর্মসহ নানা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীন কর্মযজ্ঞ কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। শুধুমাত্র গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য নয়; বস্তুতপক্ষে জনগণের সত্যিকার কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সহায়তা প্রদানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের অংশগ্রহণের ব্যাপ্তি চৈতন স্থাপনের পর্যায়ে পৌছেছে বলে মনে হয় না।
মানবজীবন দর্শনকে যথাযথভাবে পরিচর্যার মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানবীয় বিকাশ একান্ত প্রয়োজন। মনুষ্যত্বের পাঠক্রম জীবন যাপনের উৎকৃষ্ট প্রবাহকে জাতীয় চরিত্র ও চেতনার সংযোগ ক্ষেত্র তৈরিতে ব্যর্থ হলে নীতি-নৈতিকতার সম্প্রসারণ অসম্ভব। সংকীর্ণতাকে সংহার করে মনের দীগন্তকে অনেক বেশি উদার করে মানবসমাজকে ধারণ করতে হবে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ঘোষণা’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি দিয়ে স্বল্পপরিসরে এই নিবন্ধের ইতি টানতে চাই। ‘এদেশ আমার গর্ব,/এ মাটি আমার কাছে সোনা।/এখানে মুক্তির লক্ষ্যে হয় মুকুলিত/আমার সহ¯্র সাধ, সহ¯্র বাসনা।… এদেশ আমার গর্ব/এ-মাটি আমার চোখে সোনা।/আমি করি তারি জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা।’ করোনাযুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা যেন জাতির নতুন বীরত্বগাঁথা রচিত করে এই যুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধাদের চন্দ্রাতপ আয়োজনে সুমহান মর্যাদায় অভিসিক্ত করতে পারি- এটুকুই আজকের প্রার্থণা।

প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী সমাজবিজ্ঞানী; শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট