চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনাকাল

পুলিশের বর্তমান ইমেজ কি ধরে রাখতে পারবে?

ড. মোঃ কামাল উদ্দিন

১২ মে, ২০২০ | ২:৩৭ পূর্বাহ্ণ

করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশে যারা সামনের সারিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ অন্যতম। ব্রিটিশ আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানা কারণে বাংলাদেশ পুলিশের কিছু কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ পুলিশের গৌরবোজ্জল অবদানসহ তাদের অনেক প্রশংসিত ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এ সকল গৌরবোজ্জল ইতিহাস ম্লান হয়ে যায় নানা কারণে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারের সরকারের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এছাড়া অন্যান্য কিছু কারণেও পুলিশের গণমুখী ও জনকল্যাণমূলক কাজ ম্লান হয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে জানি, তাঁরা মানুষ হিসেবে যেরকম ভালো, সততা ও নিষ্ঠার সাথে মানুষকে সেবা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাদের কাজ দেখে পুলিশ সম্পর্কে যে সচরাচর ধারণা তার সাথে মেলাতে পারিনা। এ কারণে রয়েছে খোদ তাদের ভেতরেও অনেক অসন্তোষ।
দুর্যোগকালীন মুহূর্তে বাংলাদেশ পুলিশ প্রায় সবসময় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। জনগণকে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে পিছপা হয়নি। পুলিশ চাইলে অনেক কিছু করতে পারে সে সামর্থ্য পুলিশের আছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগণ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে কাজ করে বাংলাদেশের সুনাম কুড়িয়েছে। শান্তিমিশনে পৃথিবীর উন্নত দেশের অনেক পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ থাকলেও বাংলাদেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ নেই।
এখন প্রশ্ন জাগে, জাতিসংঘের শান্তিমিশনে শান্তিরক্ষা ও অন্যদেশ গঠনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ প্রশংসিত ভূমিকা রাখতে পারলে আমাদের দেশে কেন পারবে না? করোনাকালীন দুর্যোগে একেবারে সামনে থেকে তারা যদি কাজ করতে পারে অন্য সময়ে কেন তারা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না?
করোনার সময় যখন আমাদের দেশে চরম মাত্রায় অমানবিকতার দৃশ্যপট ফুটে উঠে, যেমন- অসুস্থ মাকে রাস্তায় ফেলে দেয়া, সামাজিকভাবে কোরোনা রোগী ও তাঁদের আত্মীয়-স্বজন লাঠিসোটা দিয়ে আক্রমণ করা; এ সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা এগিয়ে এসেছে। রাস্তায় সামাজিক দূরত্ব, নিজের উদ্যোগে ত্রাণ দেয়া, চিকিৎসাসেবা পেতে সহযোগিতা করা, এসকল ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ সদস্যের অনেকেই করোনা আক্রান্ত। প্রাণ দিতে হয়েছে অনেককে। তবুও মনোবল হারায়নি তারা। এখনো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। শেষ পর্যন্ত কাজ করে যাবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, করোনা শেষ হলে পুলিশ কি আগের জায়গায় ফিরে যাবে? নাকি যে ইমেজ তৈরি করেছে, সেই ইমেজকে কাজে লাগিয়ে এ বাহিনী ঘুরে দাঁড়াবে? আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের পুলিশবাহিনী যদি নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে পারে তাহলে তাদের ইমেজ সংকট কাটিয়ে তাদের উপর জনগণের প্রবল আস্থা বাড়বে।
পুলিশের দুর্নীতি নির্মূল, রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার, নিরপেক্ষ নিয়োগ, এগুলো মোটাদাগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। পুলিশকে কতটুকু রাজনীতিতে ব্যবহার করবে তা পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর। এছাড়া কিছু বিষয়, যা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে জনগণ আরো বেশি সেবা পাবে, পুলিশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে।
পুলিশের কার্যক্রমকে সবধরনের দালাল মুক্ত করতে হবে। পুলিশের সাথে সরাসরি জনগণের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। জনগণের সাথে পুলিশের আচরণের আমূল পরিবর্তন করতে হবে। পুলিশ জনগণের সাথে যে আচরণ করে সে আচরণে বেশিরভাগ জনগণ সন্তুষ্ট নয়। কিছু পুলিশ জনগণের সাথে এগ্রেসিভ ও অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করে, যা পুরো বাহিনীকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। পুলিশ যদি শুধু জনগণের সাথে ভালো আচরণ করে, জনগণের কথা ভালোভাবে শুনে, তাহলে বাংলাদেশ পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা অনেক গুন বেড়ে যাবে। এ ছাড়াও পুলিশ তাদের আওতার বাইরে অনেক কাজ করে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় জনগণকে হয়রানি ও তদবির বন্ধ করতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে পুলিশকে বেরিয়ে আসতে হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তারা আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এলিট ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ক্ষমতার দাপটে পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে অসহায় হয়ে পড়ে। এ সমস্যার আশু সমাধান করতে হবে।
পুলিশের বর্তমান ইমেজ ধরে রাখার জন্য সমাজের সকল ধরনের ভালো কার্যক্রমে সব সময় অংশগ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের পুলিশ সাধারণত গতানুগতিক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে, বর্তমান যুগে নিরাপত্তা সংজ্ঞাটি পরিবর্তন হওয়ায় অগতানুগতিক নিরাপত্তা যেমন দারিদ্র বিমোচন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, দুঃস্থদের জন্য কাজ করা, পথশিশুদের জন্য কাজ করার বস্তিবাসীদেরকে শিক্ষার মাধ্যমে অপরাধপ্রবণতা থেকে দূরে রাখা ইত্যাদি অগতানুগতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুলিশকে বেশি পরিমাণ কাজ করতে হবে। এ কাজগুলোর মাধ্যমে পুলিশ ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে। পুলিশ সমাজের বঞ্চিত মানুষের আস্থার জায়াগায় রূপান্তরিত হবে।
পুলিশের কাজের জবাবদিহিতা যেরকম নিশ্চিত করতে হবে তদুপরি পুলিশের উপর অতিরিক্ত চাপও কমাতে হবে। তাদের ওপর একসাথে নানান কাজের চাপ থাকলে তারা পুলিশিং কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেনা। তাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পুলিশের সাথেও মানবিক আচরণ করতে হবে। তাহলে পুলিশও সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব হয়ে উঠবে। তখন তাদের কাছ থেকে জনকাক্সিক্ষত মানবিক আচরণ পাওয়া যাবে।

ড. মোঃ কামাল উদ্দিন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট