চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ইসলামের আলোকধারা

কোভিড-১৯ ও বিপন্ন বিশ্ব : আমাদের করণীয়

মনিরুল ইসলাম রফিক

১৬ এপ্রিল, ২০২০ | ৩:২৭ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারস … হে আল্লাহ অবশ্যই আমি তোমার নিকট পানাহ চাই স্বেতী, উন্মাদ, কুষ্ঠরোগ এবং সকল প্রকার কঠিন ব্যাধি থেকে।’- (আবু দাউদ, তিরমিজি শরীফ)। মরণব্যাধি মানববোমা করোনাভাইরাসে আজ বিপন্ন বিশ্ব, তছনছ সমাজ সভ্যতা, দৈনন্দিন ধর্মকর্ম। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ্বনেতৃবৃন্দ, জ্ঞানবিজ্ঞান ও সভ্যতার দাবীদারগণ দৌঁড়ে হয়রান, কিন্তু মোকাবিলা করার শক্তি-সামর্থ্য এখনো কেউ যোগাড় করতে পারেননি। অধিকাংশ চিন্তাশীল ও গবেষকদের মতে এটি সৃষ্টিকুলের প্রতি সৃষ্টিজীবের অপব্যবহারে স্রষ্টার পক্ষ থেকে অসন্তুষ্টির নিদর্শন এবং প্রকৃতির প্রতিশোধ।
মহান আল্লাহ কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন: জলেস্থলে বিকশিত সমুদয় বিপর্যয় মানবজাতি হাতের কামায়…।’-(সূরা রোম)। ওবাদা বিন সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত আছে- মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) একদল সাহাবাদের সমাবেশে বললেন: তোমরা আমার কাছে এ বিষয়ে বায়াত বা সংকল্পবদ্ধ হও যে, আল্লাহর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না, চুরি করবে না, যেনা করবে না, বেয়াইনি ভাবে সন্তানদের হত্যা করবে না, পরষ্পর মিথ্যা অপবাদ দেবে না, আর কোন ন্যায়ানুগ বিষয়ে অবাধ্য হবে না। যারা বিষয়গুলো মেনে চলবে আল্লাহর কাছে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান। আর যারা এসব বিষয়গুলো অমান্য করবে তারা এর শাস্তি ভোগ করবে দুনিয়াতেই।’ প্রিয় পাঠক! দেখুন কিছু পাপের প্রায়শ্চিত্ত দুনিয়াতেই মানবজাতি ভোগ করতে হবে বলে নবীজি দৃঢ়তার সাথে বলে গেছেন। এখন এ পাপগুলো দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন আধুনিক নামে সভ্যতার অংশ ও পালনীয় বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আল্লাহতায়ালা সভ্যতার বিশুদ্ধ ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য হালাল হারাম বা বৈধ অবৈধের সীমা রেখা টেনে দিয়েছেন। মানবজাতি এ সীমারেখা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। নিজেদের জন্য উপকারি হালাল বিষয়গুলো বেমালুম তরক করেছে আর দিব্যি হালাল করে নিয়েছে হারাম বা অবৈধ ক্ষতিকর দ্রব্য ও চরিত্রগুলো। পরিণামে আজ এমন পরিস্থিতি।
এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, উত্তীর্ণ হতে হবে। বাঁচার পথ হলো ¯্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সুসম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে বান্দার ফিরে আসা। তাওবা ইস্তিগফার অনুশোচনায় বিদগ্ধ হওয়া। ঈমান আমলে তন্দুরুস্তি নিয়ে আসা। আবার এমন দেহ মনের অধিকারী হতে পারলে এ রোগে মরলেও শহীদ। আর যদি বেঁচে থাকি আমরা হবো খালিস গাজি বান্দা। আমাদের আত্মসচেতন হতে হবে। পরিশুদ্ধ হতে হবে। না হয় এ যিল্লতির ভয়াবহতা হবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। আমরা কেউ এমন মৃত্যুমিছিল চাইনি। চীনের মহাপ্রাচীর ডিঙিয়ে মানবতার এ আর্তনাদ এশিয়া ইউরোপ আমেরিকা আফ্রিকা সর্বত্র। কি মুসলিম অমুসলিম ধনী-গরিব শিশু-বৃদ্ধ নারী-পুরুষ আশরাফ-আতরাফ কেউ নিস্তার পাচ্ছে না। এ মরণবায়ু আমার আপনার গায়েও যে কোন সময় ধাক্কা দিতে পারে। কত অস্বাভাবিক অপ্রত্যাশিত অভাবিতপূর্ণ এ মৃত্যু। যেখানে সঠিক দাফন নেই কাফন নেই জানাযা নেই, নেই প্রিয়জনদের উপস্থিতির সুযোগ ।
আজ একে একে হারিয়ে যাচ্ছে হজ্ব-উমরাহ। পবিত্র হারাম শরীফের উঠোনে রোনাজারির দুআ ফরিয়াদ। অথচ কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে মান্ দাখালাহু কানা আমিনা…যে ব্যক্তি এখানে প্রবেশ করবে সে হবে নিরাপদ।’ হারিয়েছি আমরা জুমা জামাত। হারিয়েছি লাইলাতুন নিফস মিন শাবান বা লাইলাতুল বারাত। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আসন্ন রহমত বরকত মাগফিরাতের মাস মাহে রমজানের শ্রুতিমধুর খতমে তারাবীহ। কী আছে কী থাকছে আর? আমরা আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের কথা শুনেছি চেঙ্গিসের মস্কো অভিযান, নাদির খাঁর দিল্লি হামলা, হিটলারি বর্বরতার গল্প শুনেছি। কেউই এভাবে শত্রুমিত্র না চিনে হামলে পড়েনি। একমাত্র নোবেল করোনাভাইরাস বা কোভিড ১৯; যে কিনা সর্বত্রই বেপরোয়া, পয়মাল, অপ্রতিরোধ্য গতিতে ধাবমান।
এর পশ্চাৎচিত্র হবে আরো ভয়াবহ। ধেয়ে আসছে দুনিয়া জুড়ে মন্দা, অভাব, অবিশ্বাস, দুর্ভিক্ষ, পারষ্পরিক হানাহানির ঘনঘটা। এখন বঙ্গবন্ধুর মতো বলতে হবে ‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো…’। বাঁচতে হলে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। অন্তত কিছু বিষয় আমাদের দৈনন্দিন আমলে অনুশীলনে নিয়ে আসতে হবে। কথায় আছে প্রিভেন্টিভ ইজ ব্যাটার দেন কিউর।
ধর্মীয় ও আধুনিক উপদেশ পরামর্শ মেনে চলার কোন গত্যন্তর নেই। যেমন পরওয়ার দিগারের কাছে ক্ষমার হাত পাতা, আমরা লোক দেখানো ফ্যাশানেবল ইবাদাতবন্দেগী পরিহার করব। নামাজ কালামে একটু বেশি সময় নেব। নামাজে একাগ্রতা নিয়ে আসব। যেন আমি আল্লাহকে দেখছি আল্লাহ আমাকে দেখছেন। আমি না দেখলেও তিনি অবশ্যই আমাকে দেখছেন। একে বলে নামাজ খুসু খুজু। তিলাওয়াত ও তাসবিহের সময় অর্থের দিকে খেয়াল রাখব এবং দয়াময়ের দয়া ও ক্ষমা কামনারত থাকব। নবীজি (স.) বলেছেন: দুআ ছাড়া কিছুই মানুষকে হিফাজত করে না। দুআই হলো ইবাদাতের সারবত্তা। অশ্রু সজল নয়নে দুআ মুনাজাতে অংশ নিতে হবে। মনে বিশ্বাস রাখতে হবে ফরজ নামাজের পর দুআ কবুল হয়। মজলুমের দুআ ও হয়।
ঘালাল-হারাম সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্তকর কোশেশ করা, অজু গোসল ধোয়া-মোছার মাধ্যমে নিজেকে এবং পরিবেশকে পাক-পবিত্র, পরিচ্ছন্ন রাখা। পানাহারে রান্নাবান্নায় রুচিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত আয়োজন করা। অপচয় থেকে দূরে থাকা, সঞ্চয়ী হওয়া। মহান আল্লাহ যেন নারাজ না হন সেজন্য মৃত্যু ভয় ও আখিরাতে জবাবদিহিতার কথা সামনে রেখে কারো প্রতি জুলুম না করে শালীন সৎ জীবন পরিচালিত করা।

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট