চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

অষ্টম কলাম

নৃগোষ্ঠীগুলোর বর্ষবরণ উৎসব

কামাল আহমেদ

১৬ এপ্রিল, ২০২০ | ৩:২৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে বসবাসরত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের উৎসবে আনন্দে বাংলা নববর্ষ ও চৈত্র-বৈশাখমাস বিশাল একটা স্থান দখল করে আছে। তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে উৎসবমূখর বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট, উত্তর-পশ্চিমে বৃহত্তর রাজশাহী-দিনাজপুর-রংপুর-বগুড়া-পাবনায় এবং উপকূলীয় এলাকায় এদের বেশির ভাগের বসবাস। এসব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, রাজবংশী, কোঁচ, খাসিয়া, মনিপুরী, প্যাংখো, গারো, হাজং, চাকমা, তংচঙ্গা, ¤্রাে, খেয়াং, খামি, লুসাই, মাহাতো, মারমা, মুরুং, রাখাইন, ত্রিপুরা, রাই, মুষহর, তুরি, মালো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
গারো সম্প্রদায় সম্পূর্ণ রূপে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় অভ্যস্ত। তাই তাদের উৎসবও কৃষিনির্ভর। অনাবৃষ্টিতে বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ মাসে কিমরী দেবতাকে উৎসর্গ করে বৃষ্টির প্রার্থনায় পূঁজার আয়োজন করে। গ্রামের কোথাও কৃত্রিম মাটির পাহাড় তৈরি করে সেখানে ছাগল বলি দেয়। কলসী দিয়ে পানি সংগ্রহ করে সে পানি ও বলিকৃত ছাগলের রক্ত ছিটানো হয় পাহাড়ের গায়ে, চলে গীত-বাদ্য-নৃত্য। এতে বৃষ্টি ত্বরান্বিত হয় বলে মনে করে তারা। গারোরা তাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি অনুসারে গ্রামদেবতা আসং কোশির উদ্দেশ্যে গালমাকজা উৎসব দিয়ে বর্ষবরণ করে। তারা বিশ্বাস করে এ উৎসব পালনে সারাবছর ঝামেলাহীন থাকা যাবে। হাজংরা বছরের শেষদিন শুরু করে উৎসবের মধ্যদিয়ে আর তা চলে নতুন বছরের আরো দু’একদিন। শুরু হয় ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র পরিচ্ছন্নতা ও গৃহপালিত পশু গোছল করিয়ে রং মাখিয়ে দিয়ে। নতুন বছরে চলে গৃহসজ্জার কাজ। বেত ও শন দিয়ে তৈরি টেপা ঝুড়ি দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরদিন টেপা সাথে নিয়ে দলবেঁধে নদীতে ডুব দিয়ে টেপাগুলো তলদেশের মাটিতে পুতে রাখা হয়। পুতে রাখার অর্থ হলো- বিগত বছরের দু:খ, বেদনা, পাপ বিসর্জন। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার পর বিশেষ প্রার্থনায় উৎসবের সমাপ্তি হয়। হাজংদের এই উৎসব হংঅরাণী নামে পালিত হয়। বৈশাখী পূর্ণিমা রাখাইনদের বিবিধ আচার অনুষ্ঠানে ভরপুর থাকে। এদের বিশেষ তিনটি ঘটনা এইদিন সংঘটিত হয়েছিল। তা হলো : বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি এবং মহানির্বাণ। তাই তারা বৈশাখী পূর্ণিমাতে পুষ্পপূঁজা, সংঘদান, পঞ্চশীল, পানিপূঁজা, ধর্মদেশনা ও অষ্টশীল- এই ছয় ধরণের আচার পালন করে আসছে। সাঁওতালরা বাংলা নববর্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করে থাকে। এতে সাঁওতালি লোকনৃত্য, বাদ্য, পূঁজা-পার্বণ ইত্যাদি পালন হয়। তাছাড়া চৈত্রে বোঙ্গাবুঙ্গি ও বৈশাখে হোম পুঁজা পালন করে। রাজবংশী সম্প্রদায় চৈত্র-বৈশাখ মাসে কয়েক ধরনের উৎসব বা পুঁজা পালন করে। তুলসী পুঁজার মাধ্যমে এরা বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। চৈত্রমাসের শেষদিনে চড়ক পুঁজা হয়। পার্বতী ও হর এর ছদ্মবেশে ধরে পূঁজারিগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৈবেদ্য সংগ্রহ করে অবশেষে চড়ক পুঁজার কাজ চলে। রাজবংশীরা মদনকাম নামে আর একটি সামাজিক উৎসব পালন করে বৈশাখ মাসে। ওঁরাও সম্প্রদায় চৈত্রমাসে সারহুল উৎসব পালন করে। এ উৎসব মূলত গ্রামরক্ষাকারী আত্মাকে স্মরণ করে পালন করাহয়। তাছাড়া পূর্বপূরুষদেরকে স্মরণ করেও এ উৎসবে তারা ভোগ দেয়। উৎসবের মূলকথা- সূর্যের সাথে পৃথিবীর বিয়ে। উৎসবে নাচ-গান-বাদ্যের পর ঘরের দরজায় প্রচুর পানি ঢালে এবং শালফুল ঘরের চালে ঝুলিয়ে রাখে। মুন্ডারা চৈত্রমাসে ঘর থেকে দুষ্টপ্রভাব ও রোগবালাই দূর করতে রোঘারা উৎসব পালন করে। তাদের মাঘে পরব নামে আর একটি উৎসব করে, যা বাংলা মাঘমাসে অনুষ্ঠিত হয়। তবে এটিই তাদের বর্ষবিদায়-বর্ষবরণ। উত্তরবঙ্গে বসবাসরত রাই সম্প্রদায় বাংলা নববর্ষে বৈশাখব্রত পালন করে। তাছাড়া চৈত্রমাসে তারা রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে হরিবাসর নামে একটি উৎসব পালন করে। মুষহররা চৈত্রমাসে চৈত্রবিষমা নামে একটি উৎসব পালন করে।
এ সম্প্রদায় চৈত্রমাসের শেষদিনে চড়কপুঁজা এবং বৈশাখমাসে চামুন্ডাপূঁজা ও মেলার আয়োজন করে। মালোগণ বিশেষ খাবার গ্রহণ, পরিবেশন, বস্ত্রবিতরণ, নাচ-গানে বর্ষবরণ করে থাকে। পার্বত্য জেলাগুলোতে বসবাসকারী ত্রিপুরাগণ বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমা সম্প্রদায় এর বিজু নামে যে বর্ষবরণ-বিদায় উৎসব ঝমকালো ভাবে পালন করে আসছে তার আদ্যাক্ষরের সমন্বিত নাম বৈসাবি। বৈসু উৎসব ত্রিপুরারা একাধারে তিনদিন পালন করে। প্রথমদিন হারিবৈসু, দ্বিতীয়দিন বিসুমাবৈসু ও তৃতীয় দিন বিসিকাতাল বা আতাদাং পালন করে। মারমাদের সাংগ্রাই উৎসবের নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নারী-পুরুষের সম্মিলিত নাচ, বৃদ্ধদের অষ্টশীল উল্লেখ্য। সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব হচ্ছে- যুবক যুবতীদের ওয়াটার ফেস্টিভেল বা জলক্রীড়া বা রিংপোয়ে। একটি সজ্জিত প্যান্ডেলে যুবতীরা পানি নিয়ে অপেক্ষমাণ থাকে, যুবকরা প্রবেশমাত্রই পরষ্পরে পানি ছিটানো শুরু হয়। চাকমারা বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্রমাসের ২৯ তারিখ ফুলবিজু, ৩০ তারিখ মূলবিজু আর নববর্ষের প্রথমদিন গজ্যাপজ্যাবিজু পালন করে। এসব জনগোষ্ঠীর শত শত বছরের নববর্ষ উদযাপনের যে রকমারি রীতিনীতি প্রচলিত তা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বহুমাত্রিকতা দিয়েছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট