চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রাণ-প্রকৃতি আমাদের আত্মার বন্ধন

মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী

১৩ এপ্রিল, ২০২০ | ১:০৩ পূর্বাহ্ণ

অদ্ভুত এক নীরবতায় আচ্ছন্ন ঢাকা। ১১০-১২০ ডেসিবলের শব্দদূষণ নেমে এসেছে প্রায় শুন্যে। বাতাসে পিএম এর মাত্রাও অনেক নীচে নেমে এসেছে। সুইসভিত্তিক সংস্থা এয়ার ভিজুয়াল এর তথ্য মোতাবেক বায়ুদূষণে শীর্ষে অবস্থানকারী ঢাকা এখন ২৩ নম্বরে। মানুষের ছোবলে, দংশনে নির্যাতিত প্রকৃতি যেন জীবন ফিরে পেয়েছে। অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা চোখে পড়েছে। রাজধানীতে দলবেধে সশব্দে টিয়া পাখী উড়ে যাচ্ছে। ঘুঘুর অবিরাম ডাক শোনা যাচ্ছে। বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে চিল খুব নীচু দিয়ে মহানন্দে উড়ে যাচ্ছে। অলিগলিতে বেজি ছোটাছুটি করছে। এ যেন অচেনা অজানা এক ঢাকা। প্রাকৃতিক নিয়মে এভাবেই মানুষ পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ একে অপরের অনুষঙ্গ। পুরো পৃথিবীই অদ্ভুত ছন্দময়।
আমাদের জীবন ছন্দময়। নদী-পাহাড় প্রকৃতি ছন্দময়। বাতাসের বেগ ছন্দময়। সমুদ্রের ঢেউ ছন্দময়। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস ছন্দময়। হৃদপিন্ডের গতি ছন্দময়। কিন্তু এ ছন্দময়তার পতন ঘটিয়েছে মানুষ। এ ছন্দপতনে বিপর্যস্ত প্রকৃতি-পরিবেশ। করোনাভাইরাসে এখন ইমারতবন্দী মানুষের কান্না, কিন্তু প্রকৃতি জুড়ে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের বন্যা। থেমে গেছে নগরীর স্পন্দন, কিন্তু আনন্দে মুখরিত প্রাণ-বৈচিত্র্যের জীবন। প্রকৃতি যেন অধিকার ফিরে পেয়েছে।
প্রকৃতি ও মানুষের বন্ধন ভেঙ্গে মানুষই সৃষ্টি করেছে বৈরীতা, শত্রুতা। মানুষের নীরবতায় রাজধানীর ভবনগুলো যেন সমাধিক্ষেত্র। মানুষের কোলাহল নেই। গভীর রাতেও ঢাকায় এমন নিঃশব্দতা থাকে না। ভোগবাদিতার চরমে পৌঁছে মানুষ লন্ডভন্ড করেছে প্রকৃতি, পরিবেশ। মানুষ ছাড়া যেন আর কারো অধিকার নেই। সর্বত্রই মানুষের জয়জয়কার, অত্যাচার। কিন্তু অদৃশ্য এক ভাইরাস থেকে বাঁচতে থমকে গেছে মানুষের কোলাহল, চলাচল। এ সুযোগে প্রাণবৈচিত্র্য, প্রাণপ্রকৃতি হয়েছে প্রাণোচ্ছ্বল। স্বার্থপরতায় আক্রান্ত মানুষ বিস্মৃত হয়েছে পরার্থপরতা। তার চাওয়া পাওয়া অসীম। ভোগে সে বিলীন। ভোগ আর প্রবৃত্তির দাসত্ব করে মানুষ নামক প্রজাতি সর্বনাশ করেছে প্রকৃতির। বিজ্ঞানের উদ্ভব প্রকৃতি থেকে।বিজ্ঞান ও প্রকৃতি একে অপরের সঙ্গী। কিন্তু বিজ্ঞান দিয়ে সব আয়ত্ত্ব করতে যেয়ে মানুষ প্রকৃতিকে বিপন্ন করেছে। মানুষের জন্য প্রকৃতিকে উচ্চমূল্য দিতে হয়েছে। প্রাণ-প্রকৃতির কোলাহল স্তব্ধ করেছে যে মানুষ, সে মানুষ করোনাভাইরাসের থাবায় আজ নিস্তব্ধ। কী অদ্ভুত নিয়তি মানুষের! নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র যেন অক্ষরে অক্ষরে কার্যকর হয়েছে। পুরো দুনিয়াজুড়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক সব কর্মকা- এখন অচল, স্থবির। বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের খেতাব প্রাপ্ত ফিনল্যান্ডেও হানা দিয়েছে ভাইরাস। মানুষের কিসের এত আত্যাভিমান, এত অহংকার? মাটির তৈরী মানুষ। এ পৃথিবীকে প্রাণের বৈচিত্র্যে অপরূপ সৌন্দর্যে সাজিয়েছেন মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ্। মানুষই এ ভারসাম্য নষ্ট করেছে, সংকট তৈরি করেছে। মানুষ ও প্রাণীর প্রতিযোগিতায় মানুষ জয়ী হয়েছে। কারণ মানুষের হাতে আছে জ্ঞান-বিজ্ঞান মেধা। মানুষ সংকুচিত করেছে প্রকৃতিকে। অথচ মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস প্রকৃতি। পুরো পৃথিবীই মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণের ক্ষতচিহ্ন বহন করছে। মানুষ নিজেদের বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। অন্যদেরও বাসযোগ্যতা বিনষ্ট করছে। রাজধানী ঢাকায় সবুজ আস্তরণ হারিয়ে যাচ্ছে। কংক্রিট দিয়ে সব আবৃত করে ফেলেছি। সামান্য কিছু পাখীর আবাসস্থল আছে ঢাকায়, অথচ কংক্রিটের জঙ্গলে তাদের খাবার নেই, পানি নেই। আমরা ভাবি না অন্যদের কথা, ব্যথা বেদনা, যাতনা।
এভাবে নিজেদের অসুস্থ করেছি, অন্যদের বিপন্ন করেছি। কর্পোরেট শক্তির ফ্ল্যাটবাণিজ্যে বিধ্বস্ত প্রকৃতি। এমনকি ঢাকার কাছেই জলাশয় ও গ্রামগুলো হাউজিং কোম্পানীগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে। অথচ কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে আরব আমিরাত মরুভূমির বুকে জলাশয় তৈরি করছে। ঢাকা শহরে প্রচ- শব্দদূষণে নিরীহ চড়–ই পাখীও কমছে। সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে তাদের ছায়া হারিয়ে যাচ্ছে। ডাহুক হারিয়ে যাচ্ছে। কোয়াক কোয়াক ডাকও শোনা যায় না। প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ ডাহুককে নিয়ে লিখেছেন, “নিদাঘের রৌদ্র তাপে একা সে ডাহুকী, বিজন তরুণ শাখে ডাকে ধীরে ধীরে.”
এদিকে আরেক বিরল ঘটনার অবতারণা ঘটেছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। পর্যটকশূন্যতায় সৈকতজুড়ে চলছে ডলফিনের লাফালাফি-দাপাদাপি। সুনীল সমুদ্রের বুক চিরে লাফিয়ে উঠছে দলে দলে ডলফিন, সমুদ্রের বুক জুড়ে এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
ডলফিনের আনন্দ উছ¦াস জানান দিচ্ছে, ওরা এখন মানুষের উপদ্রব মুক্ত। মানুষ এখন গৃহবন্দী, ডলফিনদের যেন কারামুক্তি। এ যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ। তারা এখন স্বাছ¦ন্দ্যে বুক ভরে অক্সিজেন নিতে পারছে সাগরে। একাকীত্বের ও বন্দীত্বের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট মানুষ দেখছে, পাখী-প্রকৃতি-ডলফিন আজ কত সুখী, দেখছে তাদের দুরন্ত ছোটাছুটি। মানুষ বুঝছেনা, এ পৃথিবী মানুষের একার নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রে টুনা মাছের ভান্ডার শেষ হয়ে যাচ্ছে। গত ৬০ বছরে সাগরে টুনা আহরণের পরিমাণ ১০০০% বেড়েছে। কী অদম্য লোভ মানুষের। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর বেড়েছে টিনজাত মাছের চাহিদা, ফলে টুনার এ দুরবস্থা। জগতজুড়েই মানুষের “চাহিদা বৃদ্ধি” এবং “সবকিছুতে বাণিজ্য দৃষ্টিভঙ্গী”। গবেষকরা বলছেন, সাগর-মহাসাগরের প্রতি ১ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে ১০০ গ্রাম ওজনের মানুষের নিক্ষিপ্ত প্লাস্টিক বর্জ্য। দলে দলে সামুদ্রিক মাছ, প্রাণী ও পাখী খাবার মনে করে গিলে খাচ্ছে এ প্লাস্টিক। এরপর ফুড চেইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঢুকছে আমাদের পেটে।
ঢাকায় এখন নীল আকাশ, মায়াবী চাঁদ। শশব্যস্ত প্রবাহিত জীবনে অদ্ভুত এক ছন্দপতন। নেই শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, বর্জ্যদূষণ। নেই যানবাহন, নেই ধোঁয়া উদগীরণ। কক্সবাজার আর ইনানী সৈকত জুড়েও এখন এক আশ্চর্য নীরবতা। কক্সবাজারের ডলফিন আর ঢাকার ঘুঘু পাখীরা যদি প্রার্থনা করে, মানবপ্রজাতির করোনাসৃষ্ট এ দুঃসময় যেন প্রলম্বিত হয় আরও দীর্ঘসময়, তবে তাদের মুক্ত বিচরণ হবে আরো দীর্ঘ আনন্দময়। না, আমরা তা’ কামনা করিনা।
আমরা চাই বঙ্গোপসাগরে ডলফিনের আর রাজধানী জুড়ে পাখীর নিরাপদ বিচরণ নিশ্চিত হোক। করোনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত মানুষকে শপথ নিতে হবে, “সে দূষণ ছড়াবেনা, প্রকৃতিকে বিনষ্ট করবেনা, পরিবেশের বিনাশ ঘটাবেনা”। এ ঘটনা মানুষের জন্য কঠোর বার্তা দিচ্ছে, “এ পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়। সবারই বেঁচে থাকার, ঘুরে বেড়াবার, শ্বাস নেবার এবং আনন্দ করার অধিকার আছে।” প্রকৃতির নিয়ম ধারায় ফিরে আসুক নীল আকাশ, প্রবাহিত হোক বিশুদ্ধ বাতাস। প্রকৃতির ¯িœগ্ধতায় সুরক্ষিত হোক ডলফিন, ডাহুক আর ঘুঘুর বসবাস। করোনা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, প্রাণ-প্রকৃতি আমাদের আত্মার বন্ধন, একান্ত আপনজন।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট