চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কোভিড-১৯ ও বিপন্ন বিশ্ব : হারবে না মানুষ

ডা. দিলীপ দে

৮ এপ্রিল, ২০২০ | ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

শত বছরের ভয়ঙ্করতম ভাইরাস শ্বাসতন্ত্র তছনছ করে দেয়া নভেল করোনা তথা কোবিড-১৯ কিম্বা সার্স-কভ-২ কার্যতঃ গোটা বিশ্বের কর্মকা-কে পূর্ণমাত্রায় স্থবির করে দিয়েছে। বাসার লকডাউনে থেকে করোনাবিরোধী বাঙ্কারে বসে এ লেখা যখন লিখছি তখন দেখছি যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি নিউজ বলছেÑ নিউইয়র্কে মৃত্যু অন্ততঃ ২৫% বেড়ে গেছে। ট্রাম্প তাঁর দেশে থেকে সকল ‘পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুপমেন্ট’(পিপিই) বাইরে বিক্রী ও হস্তান্তর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তবে নিউইয়র্কের চিকিৎসাবিভাগের এক কর্মী যখন বলেনÑ “এই পোষাকে আমি নিরাপদ বোধ করছিনা’, তখন এত দূরে বসে আমাদের উদ্বেগ কমেনা। নিউইয়র্কের হাসপাতালে ডিউটিরত একজন রেসিডেন্ট চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, “ডাক্তারদের যখন বলা হচ্ছে, ‘তুমি ইমাজেন্সিতে কাজ করো, বুঝলাম তোমার এজ্মা আছে। তোমার ৭ মাসের বাচ্চা আছে। তবে তোমার এন-৯৫ মাস্ক বরাদ্দ পাওয়ার কথা নয়। দেয়া যাবে না’- তখন বল তোমার কেমন বোধ হয়। আবার একটা মাস্ক দিয়ে যদি বলা হয়, ‘এই মাস্ক ৫ দিনের জন্য, এই পিপিইÑটা দশ দিনের জন্য’Ñতখন এই তীব্র খাটুনিতে কেমন ঝাঁকুনি বোধ হয়?” এই হচ্ছে হাসপাতালের বাস্তবতা। ফেসবুকে নিউইয়র্কের এক মহিলা ডাক্তার ভিডিও পোস্ট করে কেঁদে কেঁদে বলছেনÑ ‘আমাকে করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি দিয়েছে, আমার ঘরে ছোট বাচ্চা, আমেরিকা করোনার জন্য তৈরী নয়।’
করোনা নিয়ে মানুষের বর্তমান মনোজাগতিক শংকা ও আর্তনাদ এর অবস্থা বর্ণনা করে মার্কিন সাইকোলজিস্ট ম্যাগী মালকুনি যখন বলেনÑ ‘উদ্বেগাবস্থা থেকে মানুষের মনোভাব এক ধরনের আত্মসমর্পণে ও হতাশায় এসে ঠেকেছে, এবং ক্রমাগত ত্যাগ স্বীকারের পরও মানুষ এ পথে দৃশ্যমান গন্তব্যের শেষবিন্দুটি বা খুঁটিটি দেখতে পাচ্ছেনা আর এ নিয়ে একটা পরাজয়ের বোধ তার মধ্যে তৈরী হচ্ছে’, তখন আমার মনেও সেই একই বোধ নড়াচড়া করে। অনেকেই বলছেন, অনিশ্চিত সময়কালের এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা মানুষের মধ্যে এক নৈরাশ্যবোধ ও বিপন্নতার জন্ম দিচ্ছে। কেউ কেউ বলছেনÑ ‘এটা বলা কোন কাজের কথা নয় যে, আমরা গ্রীষ্ম পর্যন্ত ঘরে আবদ্ধ থাকবো’। এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহে করোনা আরো গেড়ে বসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে সবার সামাজিক দায়িত্ব বাড়ছে, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা এবং নিজে গৃহে অন্তরীণ অবস্থানে থাকা অধিকতর জরুরী হয়ে উঠছে। খোদ নিউইয়র্ক নিয়ে বলা হচ্ছেÑ সতর্ক না হলে সেখানে হাজার নয় লাখে মানুষ মারা যেতে পারে। কাজেই ঘরে থাকার বিকল্প নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া এবং লুসিয়ানায় সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হলেও সামাজিক দূরত্ব রক্ষার কারণে প্রথমোক্ত রাজ্যে করোনার নতুন আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যু হারের গ্রাফ ক্রমশঃ নি¤œগামী হয়েছে। বলছেন ভাইরাস ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ড. জোসেফ ফেয়ার, ‘ক্যালিফোর্নিয়া তার সামজিক দূরত্ব রক্ষাব্যবস্থা সুর্নিদিষ্ট ও যথোচিত ভাবে পালন করেছে, তার সারা রাজ্যে ব্যবসায়িক কার্যকলাপও বন্ধ করে দিয়েছেÑ যা করতে লুসিয়ানা দেরী করেছে। ফলতঃ লুসিয়ানায় পরে শুরু হলেও আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর হার এখনো যথেষ্ট বাগে আনা যাচ্ছেনা। উদাহারণস্বরূপ দুটো রাজ্যেই বেড়েছে মৃত্যু। তবে তা যথাক্রমে ১৩% ও ২৩% হারে।“ঘরে থাকো” ইত্যাদি কর্মসূচিতে কিছু দেরী এই ফলাফল পার্থক্যের অন্যতম কারণ। কেউ কেউ বলছেন, প্রতিদিন এই বলে দিনটা শুরু হয়, “একদিন আর পাঁচ মাস এক কথা নয়, আমি আরো চার মাস এভাবে ঘরে থাকতে পারবোনা”।
এনবিসি নিউজে বলা হচ্ছেÑ “একটি আগাম হিসেবে হোয়াইট হাউস বলছেÑ সরকার মনে করে যে, সব ব্যবস্থাপনা যথোচিত নেয়া হলেও আমেরিকায় করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখ ৪০ হাজার ছাড়াতে পারে।” প্রায় একই কথা বলছেন মার্কিন সংক্রামক ব্যাধি ডিরেক্টর এন্টনি ফাউসি। তিনি বলছেনÑ করোনায় মৃত্যু হতে পারে ২ লাখ। ফাউসির এমন দাবীর পর ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেনÑ করোনা ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা এক লাখের নীচে রাখতে পারাটা হবে সফলতা। আর জন হপকিন্স এর হিসেব মতে আক্রান্ত ইতিমধ্যেই ২৪২,১৮২। আমেরিকায় ৫ এপ্রিলে আক্রান্ত ৩১১৬১৬ জন, মৃত ৮৪৪৯ জন। এই হচ্ছে সংক্ষেপে কোভিড-১৯ এর মার্কিনী বাস্তবতা। এমনকি কারাগারের কয়েদীরাও আতংকিত। ওয়াশিংটন ডিসিতে জেলে থাকা কয়েদীরা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছে এই বলে যে, তাদেরকে সেনিটাইজার, সাবান যথার্থ পরিমাণে দেয়া হচ্ছেনা, করোনার উপসর্গ সমেত রোগীদের করোনার টেস্ট হচ্ছে না, এবং তাদের চিকিৎসা দিতেও দেরী করা হচ্ছে। আর এদিকে ৫ এপ্রিলের ইস্টার সানডে-তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পÑ ‘অনেক মৃত্যু’র বিভীষিকা দেখছেন। ইস্টার সান ডে প্রচুর জনসমাবেশ হয় আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে। যার অনুপস্থিতেতে ট্রাস্প দুঃখ প্রকাশ করেন। নিউইয়র্ক সিটিতে এখনই ৬৩ হাজার করোনা ভাইরাস রোগী, ৫ এপ্রিল পর্যন্ত নিউইয়র্ক সিটিতে ২৬২৪ মৃত্যু। ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে ৪১২৬ জন। নিউ ইয়র্কের হাসপাতালগুলো যেখানে এখনি সামাল দিতে পারছেনা সেখানে বলা হচ্ছে সর্বাধিক রোগীর আশঙ্কা এপ্রিলে শেষে। ইতিমধ্যে তেসরা এপ্রিল নিউ ইয়র্ক সিটি অফিস প্রত্যেকের ঘরে ঘরে তৈরী খাবার পৌঁছে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
লক্ষণীয়, মার্চের শেষের দিকে প্রতিদিন নতুন বিশ হাজার রোগী আমেরিকায়। কি ঘটছে? মানেটা এই, এটা ছড়িয়ে যাবার পর যা কিছু ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। এছাড়া এই দীর্ঘসূত্রিতার সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ কৌশল অবলম্বন যুক্ত হয়েছে। ২০১৮ সালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের অধীনস্থ ‘পেনডেমিক কাউন্সিল’টি বাতিল ঘোষিত হয়। যথাসময়ে নিউইয়র্কে কোয়ারেন্টাইন হওয়া উচিত ছিল। যথেষ্ট পরিমাণ মাস্ক, টেস্ট কিট, ভেনটিলেটর যে ছিলনা তা উপরের বর্ণনায় দৃশ্যমান। অর্থাৎ এসব তৈরীর জন্য নতুনভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানীগুলোকে শুরু থেকেই শুরু করতে হয়েছে। এসব সময়ক্ষেপণে নোবেল করোনা ভাইরাস বেশ নোবেল হয়ে দিব্যি হেসেখেলে আয়াসে ছড়িয়েছে আমেরিকায়। অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রকেও এরা যথাযথ সহায়তা দেয়নি কোবিড-১৯কে রোধ করার। প্রথম দিকে এটাকে ফ্লু বলেও চালানো হয়েছে। এর আক্রান্তের সংখ্যা নিয়েও হালকাভাবে দেখার প্রবণতা দেখা গেছে। সময়ক্ষেপণের এই কালেও এই পেনডেমিক ভাইরাস আরো ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। নিউইয়র্কে আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজারের অধিক। অথচ লোকসংখ্যার অনুপাতে টেস্ট হয়নি। এসব কারণে এ রোগ আমেরিকায় দুর্ভাগ্যজনক বিস্তৃতি পেয়েছে। অন্যদিকে ৩১ মার্চ তারিখ বিখ্যাত মার্কিন রণতরী থিওডর রুজভেল্ট পেন্টাগণকে চিঠি দিয়ে দাবী জানিয়েছেন তাদেরকে আইসোলেশনে নিতে। এখানে নাকি অন্ততঃ শ’খানেক আক্রান্ত। এ ধরনের উদাহারণ এটাই প্রথম। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে এ রণতরীর সে কি দাপট। করোনা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকাগুলোতে ঘাটতি আছে বলে কারো কারো মন্তব্য। যেমন হু’র নির্দেশিকাসমূহের একটিতে বলা হচ্ছে, রাস্তায় হাঁটাকালীন দু’জন মানুষ তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখলে করোনা সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব। তবে এ নিয়ে এমআইটি তথা ম্যাসেচ্যুসেট্স্ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’র গবেষক অধ্যাপক লিডিয়া বুরিবা হু’র এ দাবী কল্পনাপ্রসূত বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলছেন, ১৯৩০ সালের পাওয়া তথ্য দিয়ে ২০২০ এর নির্দেশিকা সাজালে চলবেনা। গেলো মার্চের শেষ সপ্তাহে আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন এর জার্নালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি বলছেন, দু’জন মানুষ ২৩ থেকে ২৭ ফুট দূরত্বে থাকলেও করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকেই যায়। এছাড়া তিনি করোনা ভাইরাস বাতাসে বেশীক্ষণ বাঁচে না মর্মে যে প্রচারÑ সে দাবী খন্ডন করে লিডিয়া বলছেনÑ করোনা বাতাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে। বুরিবা’র এ দাবী উড়িয়ে দিতে পারেনি হু। বরং বলেছে করোনা নিয়ে আরো তথ্য হাতে এলে হু তাদের গাইড লাইন বদলাবে। লিডিয়া বরিবা’ও এ’ গাইডলাইন পরিবর্তনের জোর দাবী জানিয়েছেন।
রয়টারের এক রিপোর্টে ধারণা করা যায়, রোগটার বিশ্ববিস্তৃতির ভয়াবহ অবস্থাÑ প্রথম ৫৫ দিনে আক্রান্ত ছিল এক লক্ষ। আর ৭৬ দিনে তা হয়ে দাঁড়ায় ৫ লক্ষ। এদিকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন অন্ততঃ ১২০৩৮৮৭ লোক, মারা গেছেন ৬৪৭৮৭ জন, সুস্থ হয়েছেন ২৪৭৩০১ জন লোক। ২০৬টি দেশে এ রোগের বিস্তৃতি এক তটস্থ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। কিছু নতুন তথ্যও উঠে আসছে। দিন দশেক আগে পর্যন্ত আমরা জানি যে ০-৯ বছরের কোন শিশু মারা যায়নি। কিন্তু এখন হু সাবধান করে দিচ্ছে যেÑ করোনায় শিশুমৃত্যুও অন্তর্ভূক্ত। এ ছাড়া নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন বলছে চীনের ইউহানে অন্ততঃ দশমাসের একটি করোনা পজিটিভ বাচ্চা মারা গেছে। ইদানিং আমেরিকায় মারা গেছে ৯ মাসের এক করোনা পজিটিভ শিশু। ৪ তারিখও মারা গেছে ভারতে ২ জন শিশু। উল্লেখ্য করোনা মা থেকে বাচ্চাতেও ছড়াতে পারে।
১৯ মার্চ এক ভাষণে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর দেশের লোকজনকে বলেছিলেনÑ ঘরে থাকতে, খাবার ওষুধ পানীয় ছাড়া বাকী সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে, এক মাসের খাবার সবার বাসায় পৌঁছে দেবার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারপরেও দিনে দিনে করোনা বেড়েছে, মৃত্যু হয়েছে। কানাডায় ৫ এপ্রিল পর্যন্ত কানাডায় আক্রান্ত ১৪০১৮ জন। ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী ২৬০৩ জন। মোট মৃত্যু ২৩৩ জন। ৪ এপ্রিল পর্যন্ত তিন লাখ ৯ হাজার ২১১ জনের করোনা টেস্টে দুই লাখ তিরানব্বই হাজার ৩৬১ জনের রিপোর্ট নিগেটিভ। পুতিনের দেশে ১লা এপ্রিলে আক্রান্ত ৪৭৩১ জন, সুস্থ হয়েছেন ৩৩৩ জন এবং মৃত ৪৩ জন। এটা বাড়ছে। শুরুতেই পুতিন বলেছিলেন, দুই সপ্তাহ ঘরে থাকো, নয়তো ৫ বছরের জন্য জেলে যাও। (চলবে)

ডা. দিলীপ দে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, কবি ও কলামিস্ট, গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট