চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

প্রতিবন্ধিদের প্রতি অবহেলা নয়, পাশে দাঁড়াতে হবে

মঈনুদ্দীন কাদের লাভলু

৪ এপ্রিল, ২০২০ | ২:০৮ পূর্বাহ্ণ

সামাজিকভাবে ধিকৃত, বিকৃত ও অবহেলিত মানুষ যাদের প্রতিবন্ধী বলে পরিচয় দিলেও একজন নাগরিকের সর্বপ্রকার অধিকার তাদের প্রাপ্য ও মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিবন্ধীদের সমঅধিকার রয়েছে এবং তাদের বাদ দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হতে পারেনা ও জাতিসংঘ পরিচালিত এক সমীক্ষায় জানা যায়, বিশ্বের জনসংখ্যার ২০% লোক কোন ও না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী ও যদি পুরোপুরি হিসেব করা যায় এই সংখ্যা ২৫% এ উন্নীত হতে পারে ও এ সমীক্ষায় আরো জানা যায় উন্নয়নশীল দেশে ৮০% প্রতিবন্ধী গ্রামে বাস করে ও প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য পদক্ষেপের অভাবে এ হার বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বলতে দুর্ঘটনার শিকার, চিকিৎসাত্রুটি বা জন্মগতভাবে কোন ব্যক্তির শারীরিক বা মানসিক অবস্থার ক্ষতি হওয়ার মাধ্যমে কর্মক্ষমতা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে লোপ পাওয়া ব্যক্তিকে বুঝায়। প্রতিবন্ধী মূলতঃ শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের ক্ষতির কারণে হয়ে থাকে ও মৃদু, মাঝারি এবং চরম প্রকার প্রতিবন্ধিতার প্রকোপ দেখা যায় ও কোনো ব্যক্তির হাত বা হাতের অংশ না থাকলে, হাত পূর্ণ বা আংশিক অবশ থাকলে, পা বা পায়ের কোনো অংশ না থাকলে, অবশ ও শক্তিহীন থাকলে, শারীরিক গঠন বিকৃত হলে, মস্তিষ্ক সংক্রান্ত সমস্যার জন্য শারীরিক স্বাভাবিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা স্থায়ী ভাবে ক্ষতি হলেই শারীরিক প্রতিবন্ধী হয় ও মানসিক প্রতিবন্ধীরা বয়োবৃদ্ধির সাথে বুদ্ধিবৃত্তির পূর্ণতা ও স্বাভাবিক বিকাশ লাভ ব্যর্থ এবং বয়সের তুলনায় কমবয়সীদের মতো আচরণকারীকে বুঝায়। যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তার একেবারে দেখতে পান না। একচোখে দেখতে পায়না, লেন্সের মাধ্যমেও যদি কারো ভিজ্যুয়াল ইকুইটি ৬/৬০ বা ২০/২০০ (লেন্সের পদ্ধতি) অতিক্রম না করে, ফিল্ড অব ভিশন যদি ২০ ডিগ্রী কোনের বিপ্রতীপ কোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তাকেই বুঝায় ও আবার শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী যারা তাদের শ্রবণক্ষমতা কমপাংকের কথোপকথন সীমা ৪০ ডেসিবেল বা অধিক হয় এবং যে ব্যক্তির শব্দ উচ্চারণ করার ক্ষমতা নেই বা অস্পষ্ট থাকে ও আমাদের সমাজে উন্নয়ন ও সমন্বয় সাধনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ অংশগ্রহণের লক্ষে প্রতিবন্ধিত্ব নিরোধ, প্রতিবন্ধিত্বের কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন ও প্রতিবন্ধীদের দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ প্রতিবন্ধিদের অবস্থা জাতীয় পর্যায়ে সার্বিক উন্নতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী দশক হিসেবে পালন করে ও বিশ্ব কর্মসূচীতে এর উদ্দেশ্য প্রেক্ষাপট, প্রতিবন্ধীত্ব নির্ধারণ প্রতিবন্ধীত্ব নিরোধ, প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা ও পুনর্বাসন, সুযোগের ও পূর্ণ অংশগ্রহণের সমতা বিধানকল্পে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয় ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রতিবন্ধীদের অবস্থা, সমাজব্যবস্থায় তাদের সুযোগ ও আইনের অধিকার, সমস্যা ও সংকট এবং গ্রহণযোগ্যতা ও অভিগম্যতা বিশ্লেষণ করা হয়।
সমাজের প্রতিটি স্তরে বিশেষ করে পল্লী এলাকায় এবং শহরের বস্তি অঞ্চলে সমাজভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্য মা ও শিশুদের জন্য উপযুক্ত ও পুষ্টিকর খাবার যোগান, সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, নিরাপদ যাতায়াতবিধি, স্বাস্থ্যনীতি, শিক্ষাবিষয়ক জীবনব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে এবং প্রতিবন্ধিতার কারণগুলোর বিরুদ্ধে সর্বাধিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় ও সমাজজীবনে প্রতিবন্ধিরা আমাদেরই আপনজন, স্বাভাবিক মানুষের অধিকার তারাও সমানভাবে প্রাপ্য ও প্রতিবন্ধীকে সমাজের বোঝা হিসেবে মনে না করে তাদের প্রতি সহনশীল ভূমিকা রাখা প্রত্যেকের প্রয়োজন ও যাতে প্রতিবন্ধীরা অন্য সবার মতো সকল নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্বাধীনভাবে বসবাস ও সামাজিক পরিবেশে অবস্থান করার ক্ষেত্রে কোনরকম বৈষম্য কাম্য নয়। ‘সুযোগের সমতা বিধানের’ আলোকে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিবন্ধিদের বিকশিত করার সুযোগ দেয়া দরকার। প্রতিবন্ধীরা যাতে বসতি স্থাপনে পরিকল্পনা প্রবেশাধিকার পায় তা নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। সর্বোপরি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এদের জন্য আয় সংরক্ষণে কর্মক্ষম ও নিরাপত্তা সৃষ্টির উদ্যোগ প্রয়োজন। এজন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নীতিমালার অনুসরণ দরকার।
শিক্ষা জীবনমান উন্নয়নের একমাত্র মাধ্যম। শিক্ষার মাধ্যমে মানবসমাজ দক্ষতা অর্জন করে বিকাশ লাভ করে। প্রতিবন্ধীদের জন্য সমাজের মূল ¯্রােতধারায় সাধারণ স্বাভাবিক ও নিয়মিত প্রচলিত শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষার ব্যবস্থা উপযোগী পরিবেশ, সহায়ক উপকরণ সরবরাহ ও যথাযথ প্রশিক্ষিত, বিশেষ শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষাদান এবং প্রতিবন্ধীরা যাতে কোনো ধরণের প্রতিকূল ও নেতিবাচক আচরণের প্রভাব বা বিরূপ পরিবেশের প্রতিক্রিয়ায় পতিত না হয় সেজন্য সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাহলেই প্রতিবন্ধীরাও শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে। প্রতিবন্ধীদের ক্ষমতা বৃদ্ধির মাত্রা প্রয়োজনীয় ও উপযোগিতা বিচার করে তাদের শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বাভাবিকের তুলনায় শ্রম বেশি হলেও এতে ভালো ফল পাওয়া যাবে। কারণ শিক্ষাই মানসিক উন্নয়নের একমাত্র সিঁড়ি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিদের জন্য ব্রেইল, শ্রবণপ্রতিবন্ধিদের জন্য ইশারা ভাষা যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিদ্যালয়ে যাবার উপযোগী ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে উপার্জনক্ষম করে তোলা যায়। প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে রীতিমতো কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে আত্মনির্ভরশীল হবার এবং জাতীয় আয়ের সাথে সম্পৃক্তকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মানুষ হিসেবে প্রতিবন্ধিদের সামাজিক অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে সুশীল সমাজ কায়েম সম্ভব। কর্মক্লান্ত জীবনে সবার মাঝে প্রতিবন্ধিদের জন্য বিনোদনমূলক কর্মকা-ের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। বিনোদন, সংস্কৃতি,খেলাধুলা , সামাজিক কর্মকান্ডে যাতে পূর্ণভাবে স্বাধীন মনোভাব নিয়ে প্রতিবন্ধিরা কাজকর্মে অংশ নিতে পারে সে অনুযায়ী সরকারী পদক্ষেপ প্রয়োজন। মানবাধিকার বিষয়ে প্রতিবন্ধিদের অবস্থান বিবেচনার সমতা রক্ষার কর্মসূচিকে সার্থক করতে সর্বাত্মক কার্যকরী পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী মানুষজন সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অধিকার বঞ্চিত হয়। এজন্য তাদের সুযোগ-সুবিধার সমতা বিধানে কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসা দরকার। প্রতিবন্ধী হিসেবে নয়, তাদেরকে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাহলে তারা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারবে।

মঈনুদ্দীন কাদের লাভলু কলামিস্ট
ও মানবাধিকারকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট