চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মন্তব্য প্রতিবেদন

সেই পরিণতি যেন বরণ করতে না হয় আমাদের

আহমেদ শরীফ শুভ

২৯ মার্চ, ২০২০ | ৭:১৬ অপরাহ্ণ

এই প্রতিবেদন লেখার সময় সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখ ছুঁই ছুঁই। মৃতের সংখ্যা ২৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে এ সংখ্যা নিতান্তই কম। সরকারি তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এ পর্যন্ত ৪৮ এবং মৃতের সংখ্যা ৫। কিন্তু এই তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে যারা সন্দিহান তাদের ভাষ্য হল, দেশে মানসম্পন্ন টেস্টের সংখ্যা নিতান্তই কম বলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও এত কম। ইতালি ও অন্যান্য দেশ থেকে হাজার হাজার প্রবাসী গত কয়েক সপ্তাহে দেশে ফিরে এসেছেন। যে কোন কারণেই হোক কিংবা যাদের ব্যর্থতাই হোক, তারা কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম কানুন না মেনে কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছেন। ত্বরিৎগতিতে সংক্রমণে সক্ষম এই জীবাণুটি তাদের কারো কারো মাধ্যমে এর মধ্যে কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েনি এমনটি মনে করা ঠিক নয়। আইইডিসিআর কয়েকদিন আগেই মন্তব্য করেছে যে দেশে ‘সীমিত আকারে’ কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হতে পারে। আমাদের মতো ঘন বসতির দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হলে তা সীমিত আকারে থাকবে না সেটা বলাইবাহুল্য। বরং তা আমাদের নগর ও গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে অতি দ্রুত। মূলতঃ টেস্টের সংখ্যার সীমাবদ্ধতার কারণেই প্রকৃত রোগী আর শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় ব্যাপক ব্যবধান বলে অনেকে মনে করছেন।

করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব এবং আতঙ্ক না ছড়ানোর জন্য সরকার বারবার আহ্বান করেছে। মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যে কোন গুজব এবং আতঙ্ক ছড়ানো একটি সামাজিক অপরাধ। সুতরাং, সরকারের এই আহ্বানের সাথে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে সঠিক তথ্যের প্রবাহ থেকে জনসাধারণকে বঞ্চিত করাও কাম্য নয়। তাতেও হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কা থাকে। আইইডিসিআর নিজেই যেখানে বিশ্বাস করছে (সত্যতা উপলব্ধির জন্য তাদের ধন্যবাদ) কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের সম্ভাব্যতা সেখানে শুধুমাত্র বিদেশ ফেরতদের এবং কোভিড-১৯ রোগীদের প্রত্যক্ষ সং¯্রবে যারা গেছেন তাদের মধ্যে টেস্ট সীমাবদ্ধ রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

অনেকদিন থেকেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও আমলাদের মধ্যে বাস্তবতা অস্বীকার করার একটি প্রবণতা দেখা গেছে। প্রথমে আমাদের জানানো হয়েছিল করোনা মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি উন্নত বিশ্বের চেয়েও ভালো। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলে ইতালি ফেরত কিছু প্রবাসীকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা গেল না। সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ না করেই সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলো। তাতে রেল ও সড়ক পথে ভিড় করে শহরের মানুষ গ্রামে ছুটলো। এতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যাবতীয় উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে।

অথচ চীন এই রোগের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছিল। তারা যত সম্ভব টেস্ট করে রোগী শনাক্ত করেছে, আইসোলেশনে নিয়েছে এবং লকডাউন করে জনচলাচল ব্যাপকভাবে সীমিত করেছে। রোগের উৎপত্তিস্থলে শুরু থেকেই ব্যাপক আইসোলেশন কৌশল কার্যকর করায় ঘন বসতির দেশ হয়েও চীন কোভিড-১৯ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করেছে। ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র এই পদ্ধতি আরোপে দেরি করায় এখন তার মূল্য দিচ্ছে। চীন ও ইউরোপের বিপরীতধর্মী পদক্ষেপগুলো থেকে শিক্ষা নেয়ার সময় চলে যাচ্ছে আমাদের। আমরা যদি চোখ বন্ধ করে থাকি এবং কম সংখ্যায় টেস্ট করে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কম রাখতে চাই তাহলে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা মোটেও কমবে না। বরং শনাক্ত না হওয়া এই রোগীরা লোকচক্ষুর অন্তরালে নীরবে সারা দেশে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে দেবে। শনাক্ত হয়ে চিকিৎসাধীন কিংবা বাধ্যতামূলক আইসোলেশনে থাকলে এই সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলই কিন্তু বেশি কার্যকরী। আর শনাক্ত হওয়ার বাইরে যেসব রোগীরা আছেন তারা যখন অন্য কোন উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোতে যাবেন তখন নীরবে সেই রোগ হাসপাতালের অন্য রোগী ও অসতর্ক স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে এই দুর্যোগকে আরো ঘনীভূত করে তুলবেন। সেই সংক্রমণ কিন্তু হাসপাতালে থাকা চিকিৎসক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ বা সরকারি আমলাকে রেহাই দেবে না। এই ভাইরাস কাউকেই ছাড় দেয় না।

সুতরাং, দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণের গতি শ্লথ না করলে এই দুর্বিপাক থেকে নীতি নির্ধারকদেরও নিস্তার নেই। ভুলে গেলে চলবে না তাদের অনেকেরই হৃদরোগ, ডায়বেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত বিধায় তাদের ঝুঁকিও অনেক বেশি। আর এই মুহূর্তে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার উপায়ও অনেকটাই রুদ্ধ।

কী হয়েছে, কী হতে পারতো আর কী হয়নি- এই পর্যালোচনা করে সময়ক্ষেপণ না করে আমাদেরকে দ্রুত পরবর্তী ধাপের প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক। করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি সংক্রমণ ব্যাপকতা পেলে নীতি নির্ধারকরা কিছুতেই তা ঢেকে রাখতে পারবেন না, যদি মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত হতে থাকে। তাই এখনই করোনাভাইরাসের উপসর্গের রোগীদের যত বেশি সম্ভব টেস্ট করা শুরু করতে হবে। দেশে টেস্ট কিটের অপ্রতুলতা থাকলে, বিশেষতঃ গণস্বাস্থ্যের টেস্ট কিট বাজারে আসার পূর্ব পর্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে বিদেশ থেকে টেস্ট কিট আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের সুস্থ মানুষদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যই এই কাজটি করতে হবে দ্রুত। না হয় আপামর জনসাধারণ নির্বিশেষে নীতিনির্ধারকরাও এর থাবা থেকে রেহাই পাবেন বলে মনে হয় না।

যদি কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে কোভিড-১৯ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তাহলে বিদ্যমান হাসপাতাল বেডগুলোতে রোগীর সংকুলান হবে না। আইসোলেশনের সুবিধা নিশ্চিত না করে রোগী ভর্তি করা শুরু করলে তা নিমিষেই ছড়িয়ে পড়বে অন্যান্য রোগী আর স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে। হাসপাতালে যেসব জটিল রোগাক্রান্তরা থাকেন তাদের মধ্যে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়লে মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে বহুগুণে। সেজন্য যুদ্ধকালীন ফিল্ড হাসপাতালের আদলে অস্থায়ী ‘কোভিড-১৯ হাসপাতাল’ স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় ঢাকাসহ দেশের অন্ততঃ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এ ধরনের হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া অত্যাবশ্যক। এই হাসপাতালগুলো স্থাপন করতে পারলে কোভিড-১৯ রোগীদের আইসোলশন কিছুটা হলেও সুদৃঢ় হবে। তাতে সংক্রমণের গতি শ্লথ হবে। আমরা যত দেরি করবো, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে নাগরিক বিপর্যয় ততই ভয়াবহ হবে।

দেশে জীবন রক্ষাকারী ভেন্টিলেটরের সংখ্যাও নিতান্তই অপ্রতুল। তাই কাল বিলম্ব না করে বিদেশ থেকে ভিন্টিলেটর আমদানি করার ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন। ভেন্টিলেটর না থাকলে আক্রান্ত রোগীদের অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হবে না। প্রয়োজনে স্থানীয় ভিত্তিতে ভেন্টিলেটর বানানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এই নিয়ে দেরি করা হবে আত্মহত্যার শামিল।

সরকারি ছুটি ঘোষণার পর জনচলাচল সীমিত হয়েছে, যা সংক্রমণের গতি শ্লথ হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এই পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসারযোগ্য। তবে জনচলাচলের এই সীমিতায়ন আরও বিস্তৃত করতে হবে। ভারতে আদলে পূর্ণাঙ্গ লক ডাউন ঘোষণা করার কোন বিকল্প নেই। খেটে খাওয়া দিনমজুরদের দুই তিন সপ্তাহ খাওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও বিত্তবানদের সমন্বিতভাবে নিতে হবে। আমাদের দেশে শত কোটি টাকার মালিক এখন শত শত। আমাদের রাষ্ট্রের একক সাধ্যও কম নয়।

দেশে এখনও ব্যাপক আকারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে একথা বলা যাবে না। আমরা হয়তো ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের একটি উইন্ডো পিরিয়ডে আছি। সংক্রমণের ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়ার আগে এটাই আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণের শেষ সুযোগ। এই সময়টুকু কাজে লাগাতে না পারলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র কেউই এই উইন্ডো ঠিকমতো কাজে লাগায়নি। আমাদের যেন সেরকমটি না হয়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

লেখক : মেলবোর্ন প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট