চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বেগম রোকেয়া নারীশিক্ষার মহীয়সী বার্তাবাহক

ডেইজী মউদুদ

৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:২২ পূর্বাহ্ণ

আজ ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মদিবস। আজ থেকে প্রায় দেড়শত বছর আগে যখন আমাদের সমাজ নানা অসঙ্গতি আর কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল, সে সময়ে সমাজ ও পরিবারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে নারীশিক্ষার বার্তাবাহক হয়ে যিনি আলোকবর্তিকা জ¦ালিয়েছিলেন তাঁর নাম বেগম রোকেয়া। তিনিই প্রথম নারীদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিলেন। বঙ্গীয় নারীদের মধ্যে তিনিই কলম ধরেন। কলম ধরেন নারীকে পণ্যকরণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাতে। যার লেখনীতে ঘোষিত হয়েছিল মানুষ হিসেবে ভগিনীদের আত্মসম্মান ও নিজস্ব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার কথা। ভাবতে অবাক লাগে, কি ভাবে তিনি

বুঝেছিলেন , নারী শিক্ষা ছাড়া সমাজের কঠোর এই

শৃঙ্খল ভাঙ্গার কোন উপায় নেই। তিনি বুঝলেন একমাত্র নারী শিক্ষাই পারে এ দুঃসহ জীবন থেকে নারীদের মুক্তি দিতে। তাই তিনি বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মোমের আলোর ক্ষীণ শিখায় তিনি তাঁর অগ্রজের কাছ থেকে শিক্ষার পাঠ নিতেন। লুকিয়ে লুকিয়ে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শেখেন।

খানিকটা রপ্ত হলেই তিনি নারী সমাজকে এই কূপম-ুকতা থেকে বেরিয়ে আসার ডাক দিলেন। তিনি নিজে জেগেছেন, এরপর ব্রত নিলেন অন্যদের জাগাতে। সমকালীন শিক্ষা বঞ্চিত ও অনগ্রসর নারীদের তিনি জাগাতে চেয়েছিলেন। তাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা তৈরি করেন, উদ্যোগ নেন নারী শিক্ষার পাঠশালা প্রতিষ্ঠার। বিয়ের পর স্বামী শাখাওয়াত হোসেনের সহযোগিতায় তিনি মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে শুরু করে শাখাওয়াত মেমোরিয়েল স্কুল।

দুটো বেঞ্চ আর আটজন মাত্র ছাত্রীকে নিয়ে রোকেয়া স্কুলের প্রথম ক্লাস করলেন। স্কুলের শিক্ষিকা মাত্র একজন, রোকেয়া নিজেই। তার না ছিল কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না ছিলো বাড়ির বাইরে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা। কেবল মনোবল আর ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে তিনি দাঁড় করিয়ে ফেলেন সমাজের অন্ধকার সময়ে এরকম এক আলোর প্রতিষ্ঠান। স্কুল পরিচালনার জন্যও অভিজ্ঞতার দরকার, রোকেয়া সমাজের প্রভাবশালী মহিলাদের সাহায্যে কলকাতা বেথুন, গোখেল মেমোরিয়াল প্রভৃতি মেয়েদের স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত করা শুরু করলেন, শিক্ষকদের পড়ানোর ধরণ, স্কুল পরিচালনার পদ্ধতি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা, হাতের কাজ, সেলাইয়ের কাজ, এমনকি শরীরচর্চার শিক্ষা ছাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিলো। ভাবা যায়? যে সময়ে মেয়েদের বাড়ির বারান্দায় আসার আগে দুবার ভাবতে হতো, তখন রোকেয়া ভেবেছিলেন মেয়েদের শরীরচর্চা শিক্ষার কথা! কত সুদূরপ্রসারী চিন্তাশীল ছিলেন তিনি! কেবল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেই বেগম রোকেয়া ক্ষান্ত ছিলেন না, তিনি মনোনিবেশ করেন সাহিত্য রচনায়। মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন , অবরোধবাসিনী রচনার মধ্য দিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন নারী স্বাধীনতার। অবরোধ প্রথার যাতাকলে কি পরিমাণ নিষ্পেষিত হয়েছে নারী, কত ধরণের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে নারী তার জীবন্ত চিত্র এঁকেছেন এই গ্রন্থে বেগম রোকেয়া। নারী কঠোর পর্দা প্রথার আড়ালে উপোষ মরেছেন, কেউবা, পাল্কীর ভেতরে সাতপাকের বাঁধায় জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। সমাজের এসব চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি অবতীর্ণ হন সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায়।সাহিত্য রচনার পাশাপাশি তিনি সমাজ সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে’ নামক সংগঠন গড়ে তুলে তিনি দুঃস্থ ও বিধবা নারীদের কল্যাণে কাজ করেছেন। নারীদের হাতে কলমে কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের রোজগারের পথ সুগম করেছিলেন। নিষ্পাপ শিশুদের কথা ও তিনি ভেবেছেন। শিশুতোষ নির্মল আনন্দে মেতে উঠার কারণে শাসিত হিসাবে প্রাণ দেয়ার গল্প ও আমরা তাঁর সাহিত্য কর্মে দেখেছি। বেগম রোকেয়ার কাল শেষ হয়েছে শতাধিক বছর হলো, প্রশ্ন জাগে তিনি যে স্বপ্ন দেখেেিছলন, আমরা কি এখন তাঁর স্বপ্ন পূরণের জায়গায় আসতে পেরেছি ঃ মূলত: আমাদের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়তো কিছুটা হয়েছে,কিন্তু সামগ্রিক যে বিষয়টা বেগম রোকেয়া শত বছর আগে ভেবেছিলেন, সেই মুক্তি এখনো সদূর পরাহত। সেই জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি বলেই, আজ নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে অনেকগুণ সেই সংকট থেকে উত্তরণের এখন সময় এসেছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট