চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

‘ফণী’র ছোবলে নিহত ৭ সহস্রাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

৫ মে, ২০১৯ | ২:৫০ পূর্বাহ্ণ

প্রবল শক্তিশালী ঘূর্নীঝড় ফণী বাংলাদেশের সীমানায় পৌঁছানোর আগেই দুর্বল হয়ে নিন্মচাপে পরিণত হওয়ায় তেমন বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তারপরেও, সমুদ্র উপকুলবর্তী কয়েকটি জেলায় ফণীর তা-বে গাছপালা ও বাঁধ ভেঙ্গে মানুষের সহায় সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি অন্তত ৭ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। তাছাড়া বিভিন্ন জেলায় সহস্রাধিক ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে, সরকারিভাবে ৪ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ঘূর্ণিঝড় ফণী দুর্বল হয়ে পড়ায় মোংলা, পায়রা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে বিপদ সংকেত ৭ থেকে নামিয়ে ৩ নং স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলেছে। গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান, আবহাওয়া অধিদফতরের উপপরিচালক আয়েশা খাতুন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ফণী ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চলসহ আশপাশের অঞ্চলে যেভাবে ছিল তা অনেকটা দুর্বল হয়েছে। এটা এখন গভীর নিম্নচাপ আকারে পাবনা, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ অঞ্চল হয়ে আসামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এজন্য আমরা বিপদ সংকেত নামিয়ে ফেলতে বলেছি। গতকাল শনিবার ভোরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা খুলনা ও সাতক্ষীরা হয়ে ঘূর্ণীঝড়টি বাংলাদেশে প্রবেশ করে মধ্যাঞ্চল ময়মনসিংহ ও ঢাকা হয়ে আসমের দিকে বেরিয়ে যায়। ঘূর্নীঝড়ের প্রভাবে সমুদ্র তীরবর্তী বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, বাগেরহাটে নদীর পানি বেড়ে যায়। কোথাও আবার জলোচ্ছ্বাসও হয়েছে।
গতকাল সকাল থেকেই সারাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে হালাকা ও মাঝারি বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া বইছিল। বিকালের পর, আশ্রয় শিবির থেকে আশ্রিতরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন। গতকাল শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন নৌ রুটে লঞ্চ চলাচলও যথারীতি শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, শুক্রবার মধ্যরাতের পর ফণীর প্রভাবে ও প্রবল জোয়ারের চাপে ঝালকাঠির রাজাপুর এবং কাঁঠালিয়া উপজেলার বিষখালী নদীর বেড়িবাঁধ কয়েকটি স্থানে ভেঙে এবং পূর্বে ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া রাজাপুরে পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উঠতি বোরো ফসল। এদিকে ঝড়ের প্রভাব কমে আসায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। নৌযান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। একই অবস্থা সাতক্ষীরাও। জানা গেছে, সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৬০০ কাঁচা ঘর-বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রায় ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া জেলায় ২ হাজার হেক্টর ফসলি জমির ধান নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান গতকাল বিকালে জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ে চার জন নিহত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়ার কারণেই তাদের প্রাণহানি ঘটেছে। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে না থাকে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা, নগদ টাকা কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারের জন্য ইতোমধ্যে ২০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে।’ ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ফণী’ দুর্বল হয়ে আঘাত হানার কারণে ফসলি জমির তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ত্রাণ পৌঁছে দিতে বিমান বাহিনীর সব হেলিকপ্টার প্রস্তুত রয়েছে। এর আগে সারা দেশের ১৬ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, ‘১৯টি জেলার ৪ হাজার ৭১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৬ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। ফসল এবং গবাদি পশুর তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। বরগুনায় ২ জন, ভোলায় একজন ও নোয়াখালিতে একজন মারা গিয়েছেন। এদের মধ্যে দুইজন ঘর চাপায় এবং দুইজন গাছ চাপা পড়ে মারা গিয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়ার কারণেই এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।’
স্থানীয় প্রশাসনিক সূত্র জানায়, লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় ঘরচাপা পড়ে আনোয়ারা বেগম (৭০) নামে এক নারী মারা গিয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আও ১০ জন। আহতদের রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভোলায় ফণীর প্রভাবে দুই শতাধিক কাঁচা ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এসময় ঘরচাপায় রানু বেগম (৫০) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, ভোরে ভারী বর্ষণের সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়। এতে দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের বালিয়া ও কোড়ালিয়া গ্রামের দুই শতাধিক ঘড়বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় ঘরচাপা পড়ে রানু বেগম মারা যান।
নোয়াখালির সূর্বণচর ও কোম্পানীগঞ্জে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এদের একজনের বয়স আড়াই বছর ও অন্যজন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট কয়েক মিনিটির টর্নেডোর আঘাতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় গাছ চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে নাজমুন নাহার ঝুমুর নামে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী। এছাড়া ফণীর আঘাতে সুবর্ণচর উপজেলার চর ওয়াপদা ইউনিয়নের চর আমিনুল হক গ্রামে বসতঘরের চাপায় ইসমাইল হোসেন নামের আড়াই বছরের একটি শিশুরও মৃত্যু হয়েছে। নিহত ইসমাইল ওই গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে।
বরগুনার পাথরঘাটায় প্রচ- ঝড়ে কাঠের ঘর ধসে দাদি ও নাতির মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণ চরদুয়ানি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পাথরঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম কবির এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিহতরা হলেন, নুরজাহান বেগম (৬০) ও নাতি জাহিদুর (৯)। উপজেলা চেয়ারম্যান জানান, মধ্য রাতের পর পাথরঘাটায় প্রচ- বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে। রাত তিনটার দিকে উপজেলার দক্ষিণ চরদুয়ানী গ্রামে ঝড়ে গাছ উপড়ে ঘরের উপর পরে। এতে ঘর বিদ্ধস্ত হয়ে নিচে চাপা পরে নূরজাহান বেগম ও তার নাতি জাহিদুল ইসলাম মারা যায়।
গত শুক্রবার সকাল থেকে ভারতের ওডিশা রাজ্যে ‘ফণী’র তা-ব শুরু হয়। সেখানকার পুরি উপকূলে প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ে। সেখানে আটজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এরপর সেটি পশ্চিমবঙ্গে আঘাত আনে। মধ্যরাতের পর ভারতের এই রাজ্যে প্রবেশ করে ‘ফণী’। ৯০ কিলোমিটার বেগে খড়গপুরে এটি আঘাত হানে। পরে আরামবাগ, কাটোয়া, নদীয়া হয়ে গেছে মুর্শিদাবাদে। তারপর সেখান থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে আলিপুর আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট