চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সমঝোতায় তারেক রহমান যেভাবে দেশ ছেড়েছিলেন

সমঝোতায় তারেক রহমান যেভাবে দেশ ছেড়েছিলেন

পূর্বকোণ ডেস্ক

১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ৫:৫০ অপরাহ্ণ

দু’হাজার সাত সালের মার্চ মাস।

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের তখন তাড়া করে ফিরছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক।

জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার প্রথম দুই মাসে দেড়শো’ জনের বেশি রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীকে আটক করা হয় দুর্নীতির অভিযোগে।

অনেকের মনে তখন একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল – তারেক রহমান কি গ্রেপ্তার হতে যাচ্ছেন?

তারেক রহমানের সম্ভাব্য গ্রেফতার নিয়ে সংবাদ মাধ্যমেও তখন নানা রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এমন রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছিল যে যেকোন সময় আটক হতে পারেন তারেক রহমান।

ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে মইনুল রোডের বাড়িতে তারেক রহমান তখন অস্থির সময় পার করছেন, এমন একটি চিত্রও ফুটে উঠেছিল সংবাদপত্রের খবরগুলোতে।

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০০৭ সালের ৭ই মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অথচ মাত্র মাস ছয়েক আগেও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হিসেবে তারেক রহমানের ছিল দোর্দন্ড প্রতাপ।

সমালোচনা রয়েছে, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেও তারেক রহমান হয়ে উঠেছিলেন ক্ষমতার সমান্তরাল আরেকটি ক্ষমতার কেন্দ্র – হাওয়া ভবন-কেন্দ্রিক।

বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বেশ দ্রুততার সঙ্গেই তারেক রহমানকে দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে খালেদা জিয়া কার্যতঃ তখনই তারেক রহমানকে দলের ভবিষ্যত নেতা হিসেবে তুলে ধরেন।

রিমান্ড ও তারেক রহমান

গ্রেপ্তারের পর মি. রহমানকে যেভাবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল, সেটি দেখে অনেকেই চমকে উঠেছিলেন। র‍্যাব-এর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং হেলমেট পরিয়ে ঢাকার একটি আদালতে তোলা হয়েছিল তাকে।।

এরপর তারেক রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল।

তারেক রহমান এবং বিএনপির তরফ থেকে এরপর অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে রিমান্ডে তার উপর ‘অমানুষিক নির্যাতন’ চালানো হয়েছে।

আদালতে দেয়া তারেক রহমানের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে ভারতের দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা ২০০৮ সালের ১০ই জানুয়ারি লিখেছিল, “রিমান্ডের সময় আমাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই হাত ও চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল … আমাকে বেঁধে রুমের ছাদের সাথে ঝুলিয়ে আবার ফেলে দেয়া হয় এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।”

কারাগারে থাকা অবস্থায় মি. রহমানের উপর নির্যাতনে অভিযোগ তখন বেশ জোরালোভাবে দলের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছিল।

খালেদা জিয়ার সাথে সেনা কর্মকর্তাদের দরকষাকষি

তারেক রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার প্রায় ছয় মাস পরে খালেদা জিয়া নিজেও আটক হন। তারও আগে ১৬ই জুলাই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

খালেদা জিয়া ছিলেন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর খালেদা জিয়াকেও গ্রেপ্তারের জন্য তৎকালীন সেনা-সমর্থিত সরকারের উপর চাপ বাড়তে থাকে।

অনেকে ধারণা করেছিলেন যে সরকারের সাথে সমঝোতা করে দুই ছেলেকে নিয়ে খালেদা জিয়া হয়তো দেশের বাইরে চলে যেতে পারেন।

তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন ‘নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর’ বইতে এ সংক্রান্ত একটি ধারণাও দিয়েছেন।

“আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের পর গুঞ্জন হচ্ছিল বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে। অনেকে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন যে খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত তার দুই পুত্রকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবেন,” লিখেছেন মি. হোসেন।

তবে ওই গুঞ্জন পরে আর সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি।

২০০৮ সালের গোড়ার দিকেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সে বছরের শেষ নাগাদ সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রধানের উপর আন্তর্জাতিক চাপও বাড়তে থাকে।

তখন থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বস্তুতঃ পর্দার আড়াল থেকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যোগাযোগ শুরু করে।

২০০৮ সালের মে মাস থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অপ্রকাশ্যে আলোচনা চালায় সরকার, যদিও সবকিছুর মূল চাবিকাঠি ছিল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাতে।

কিন্তু দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানের মুক্তি ছাড়া কোন ধরণের আলোচনায় রাজি ছিলেন না খালেদা জিয়া।

সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় সাব-জেলে খালেদা জিয়ার বৈঠক করেন। বৈঠকের একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিল নির্বাচনে অংশ নিতে খালেদা জিয়াকে রাজি করানো।

বিএনপি’র সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমদ তখন কারাগারে ছিলেন। তবে ওই সময়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি পরে যে বইটি লিখেছেন, তাতে তিনি খালেদা জিয়া ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে দরকষাকষি নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়েছেন।

‘কারাগারে কেমন ছিলাম (২০০৭-২০০৮)’ বইতে মি. আহমেদ লিখেছেন, সেনাকর্মকর্তারা শুধু আলোচনার উপর নির্ভর করেননি। একইসাথে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ এবং ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ মামলার প্রস্তুতিও গ্রহণ করে।

২০০৮ সালের ২৬শে জুন নাইকো দুর্নীতি মামলায় কারাগার থেকে আদালতে নেয়া হয়েছিল খালেদা জিয়া এবং মওদুদ আহমদকে। শুনানির সময় খালেদা জিয়া এবং মওদুদ আহমদ পাশাপাশি বসে ছিলেন। তখনই খালেদা জিয়ার সঙ্গে মওদুদ আহমদের কিছু কথা হয়।

খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে মওদুদ আহমদ তাঁর বইতে লিখেছেন, “নাইকো মামলায় এজলাসে আমি ছিলাম তাঁর পাশে। চিকিৎসার জন্য তাঁর দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠানো না হলে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে কোন আলোচনায় তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আমার সাথে আলোচনার সময় তিনি এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন।”

“বেগম জিয়া আমাকে বললেন যে সেনা অফিসাররা মাঝরাতে এসে নানা কথা বলছেন ও নানা শর্ত দেখাচ্ছেন।”

কারাগারে খালেদা জিয়ার সাথে দরকষাকষির একপর্যায়ে সেনা কর্মকর্তারা ছোট ছেলে আরাফাত রহমানকে মুক্তি দিতে সম্মত হলেও তারেক রহমানের ব্যাপারে ছাড় দিতে রাজি হননি।

কিন্তু খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন উভয় ছেলের মুক্তি এবং তাদের বিদেশে চিকিৎসা।

তারেক রহমানের মুক্তি এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি খালেদা জিয়ার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বলেই মনে হয়।

সেনা কর্মকর্তাদের সাথে খালেদা জিয়ার সমঝোতা

২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পেছনে ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা কূটনীতিকদের একটি নিরব সমর্থন ছিল। ওই সরকারের যারা উপদেষ্টা ছিলেন, তারা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।

এছাড়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও তাদের মনোভাব প্রকাশ করতেন ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকদের কাছে।

২০০৮ সালে ঢাকায় নিজের দায়িত্বে যোগদান করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি।

তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বিএনপির মধ্যে যে এক ধরণের দরকষাকষি চলছিল, তা পরিষ্কার বোঝা যায় মি. মরিয়ার্টির পাঠানো গোপন তারবার্তা থেকে।

ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে তিনি যেসব তারবার্তা বিভিন্ন সময় পাঠিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু উইকিলিকস সাইটে ফাঁস হয়েছে।

২০০৮ সালের ২১শে অগাস্ট মি. মরিয়ার্টির পাঠানো এমন এক তারবার্তায় বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তাঁর ছেলে তারেক রহমানের কারামুক্তি নিয়ে যে দরকষাকষি চলছে, সেটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিতর্ক আবর্তিত হচ্ছে।

মি. মরিয়ার্টি লেখেন, “খালেদা জিয়ার অনুগত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকর্তা-উভয়পক্ষ আমাদের বলেছে যে একটি সমঝোতা খুব নিকটবর্তী। তবে পরষ্পরের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে চূড়ান্ত সমঝোতা হচ্ছে না।”

তারেক রহমানকে নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে স্বীকার করেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান এবং গোলাম কাদের। একটি তারবার্তায় এমনটাই লিখেছিলেন মি. মরিয়ার্টি।

তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ২৮শে আগস্ট তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ কারাগারে খালেদা জিয়ার সাথে একটি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে উপস্থিতি ছিলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআই-এর তৎকালীন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার এটিএম আমিন।

২০০৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর মি. মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনে যে তারবার্তা পাঠান, সেখানে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

মি. মরিয়ার্টি জানান, ওই বৈঠকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার আমিনের আলোচনা হয়। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মুক্তি এবং মুক্তির পর তারেক রহমানকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয় ওই আলোচনায় উঠে আসে। এছাড়া, রাজনীতি থেকে তারেক রহমানের কিছু সময়ের জন্য বিরতিতে যাওয়ার কথাটিও তখন আলোচিত হয়।

কারাগারে খালেদা জিয়ার সাথে খন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং আলী আহসান মুজাহিদের বৈঠকের বিষয়টি মওদুদ আহমদও তাঁর বইয়ে লিখেছেন।

“খন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং আলী আহসান মুজাহিদকে সাব-জেলে খালেদার সঙ্গে দু’ঘণ্টার জন্য দেখা করতে দেয়া হয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, এখন সিরিয়াস ধরণের রাজনৈতিক দেন-দরবারের পালা চলছে। “

শুধু দুই ছেলের মুক্তি নয়, তাদেরকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়েও খালেদা জিয়া ছিলেন অনড়। এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে।

তবে খালেদা জিয়ার সাথে সরকারের কী ধরণের সমঝোতা হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিএনপির নেতারাও জানেন না বলে মনে হচ্ছে।

‘বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি এন্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)’ শিরোনামের আরেকটি বইতে মওদুদ আহমদ অনুমান করেছেন যে ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।

রাজনীতি থেকে তারেক রহমানের সাময়িক বিরতি?

মুক্তি পাওয়ার পর তারেক রহমান ২০০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন পরিবারের সদস্যদেরকে সাথে নিয়ে।

আর ওইদিনই কারাগার থেকে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। মুক্তি পাওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই চিকিৎসাধীন ছেলেকে দেখতে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যান। প্রায় দুই ঘণ্টা ছেলের পাশে অবস্থান করেন তিনি।

লন্ডন যাত্রার কয়েকঘণ্টা আগে তারেক রহমান দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেরিয়েছিল।

ঢাকায় বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা কাদির কল্লোল বলেন, এ কথা ঠিক যে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে তারেক রহমান বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন।

তারেক রহমান অন্তত তিন বছর রাজনীতি না করার শর্তে রাজিও হয়েছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তাঁর ‘কারাগারে কেমন ছিলাম (২০০৭-২০০৮)’ বইতে লিখেছেন, “এমনও হতে পারে তিনি (খালেদা জিয়া) জেনারেলদের সাথে এই সমঝোতা করেছিলেন যে, তারেক রহমান আপাতত নিজেকে রাজনীতিতে জড়াবেন না এবং এ মর্মে তারেক রহমান কোন সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকতে পারেন।”

মি. রহমান লন্ডন যাত্রার আগে তার মা খালেদা জিয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে সুস্থ না হয়ে উঠা পর্যন্ত তারেক রহমান রাজনীতির বাইরে থাকবেন।

খালেদ জিয়াকে উদ্ধৃত করে বিবিসি নিউজ তখন লিখেছিল, “চিকিৎসকরা বলেছেন তার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর লাগবে।”

মওদুদ আহমদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, খালেদ জিয়া বেশ ভালো করেই বুঝেছিলেন যে তারেক রহমান যদি সে মুহুর্তে মুক্তি না পান, তাহলে আর কখনোই দেশ ছেড়ে যেতে পারবেন না। যেকোন একটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হলেই তার কারাবাস অনেক দীর্ঘ হতে পারতো।

“তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেলে অন্ততঃপক্ষে তার বিরুদ্ধে আনীত ফৌজদারি মুখোমুখি হওয়া থেকে রেহাই পাবে এবং তাতে করে পরবর্তীকালে সে আরো অনুকূল পরিবেশে রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারবে,” লিখেছিলেন মওদুদ আহমদ।

তারেক রহমানের মুক্তি ও লন্ডন যাত্রা

১৮ মাস কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর তারেক রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর আগে ১৩টি মামলায় জামিন পান তারেক রহমান।

ওই সময়ে বেশ জোর আলোচনা ছিল যে বিএনপিকে নির্বাচনে যাবার শর্ত হিসেবে খালেদা জিয়ার দুই ছেলেকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

জেল থেকে ছাড়া পেলেও তারেক রহমানের সঙ্গে গণমাধ্যমের কেউ সাক্ষাৎ করতে পারেনি।

অন্যদিকে, কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে খালেদা জিয়া ঘোষণা করেন যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে এক্ষেত্রে কিছু শর্ত দেয় বিএনপি।

তারেক রহমানের মুক্তির পরদিন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার এক প্রতিবেদনে জানায়, তারেক রহমানের মুক্তির বিষয়টি তার মা খালেদা জিয়া ও সরকারের মধ্যকার রাজনৈতিক সংলাপকে ত্বরান্বিত করবে।

মি. রহমানের মুক্তির পর ফিন্যান্সিয়াল টাইমস একটি রিপোর্ট করে, যাতে বলা হয় যে ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকার তার বড় ছেলে তারেক রহমানকে মুক্তি দিয়েছে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের ওই রিপোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আতাউর রহমানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “এটা উল্টো পথে যাত্রা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে প্রতিশ্রুতি, তা ধ্বংস হয়ে গেল।”

তারেক রহমান ১২ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে একাধিক মামলায় তার সাজা হয়েছে। তবে এখন তিনি লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করছেন।

তিনি লন্ডনে যাওয়ার পর থেকে বিএনপির তরফ থেকে বারবারই বলা হচ্ছিল যে তিনি সেখানে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছেন।

তবে ২০১৮ সালের ২৪শে এপ্রিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন যে ২০১২ সালে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যেই সেটি গৃহীত হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট