চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

উন্নয়ন কাজে অর্থায়নের জন্য ইসলামী বন্ড ‘সুকুক’ ছাড়বে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

৩০ আগস্ট, ২০২০ | ৫:৫৪ অপরাহ্ণ

দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থায়নে নতুন একটি বন্ড ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। তবে এটি এমন একটি শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি বন্ড যা বিশ্বব্যাপী চালু আছে। এ ধরনের বন্ডকে ‘সুকুক’ বলা হয়। সুকুক একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে সিলমোহর লাগানোর মাধ্যমে কাউকে অধিকার ও দায়িত্ব দেয়ার আইনি দলিল।

সুকুক ইসলামী বন্ড চালু হলে অর্থ সংগ্রহের নতুন একটি উৎস তৈরি করতে পারবে সরকার। সাধারণত বাজেটের খরচ মেটাতে এত দিন রাজস্ব সংগ্রহের পাশাপাশি সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও ব্যাংক ঋণের ওপর ভরসা করে আসছিল। তবে সর্বশেষ ২০১৯–২০ অর্থবছরে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার উদ্বৃত্ত তহবিল থেকেও ১৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, সরকার অর্থায়নের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে সুকুক ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ৯ মাস ধরে এ নিয়ে অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে কাজ করছে। অর্থ বিভাগের প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা সুকুকের মাধ্যমে তোলা সম্ভব। এ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা যাবে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হতে পারে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের এ ব্যাপারে যে প্রায়োগিক কোনো ধারণা নেই, এ উপলব্ধিও তাদের রয়েছে। শুরুর দিকে একটি নীতিমালা তৈরি করার কথা থাকলেও মাঝে আগে বন্ড ছাড়া হবে, পরে তৈরি করা হবে নীতিমালা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু এখন নীতিমালা তৈরির কাজই চলছে।

সুকুক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের সভাপতিত্বে গত ৩ ফেব্রুয়ারি এবং অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সভাপতিত্বে গত ২৬ জানুয়ারি দুটি আলাদা বৈঠক হয়। উভয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এসআইবিএল, শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শরিয়াহ কাউন্সিলের প্রতিনিধিরা। একটি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারও। এ নিয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সর্বশেষ বৈঠকটি হয়।

অর্থ বিভাগের পর্যবেক্ষণ বলছে, পুরো ব্যাংকব্যবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর প্রায় ২৫ শতাংশ অংশীদারত্ব রয়েছে। অথচ সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে দেশে শরিয়াহভিত্তিক কোনো উপকরণ নেই। ফলে একদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর নিরাপদ এ খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকছে। একইসাথে ঘাটতি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যবহার করতে পারছে না সরকার। অর্থ বিভাগ বলছে, সুকুকের মাধ্যমে ঘাটতি অর্থায়ন করা হলে সরকারের সুদের ব্যয়ও কমবে।

ইসলামী বন্ড বা সুকুক চালুর পক্ষে যুক্তি দিয়ে অর্থ বিভাগ আরও বলেছে, অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত বেশি, যা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আশা করা যায় না। এ কাজ করতে যে ঘাটতি অর্থায়ন করতে হয়, সরকার এখন পর্যন্ত তা করে আসছে প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা থেকে। অথচ এ প্রক্রিয়ায় শরিক হতে পারে ইসলামী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। এর মাধ্যমে সহজেই সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ নিতে পারে তারা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠকে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে, যেসব প্রকল্পের বিপরীতে বন্ড ছাড়া হবে, সেগুলোর সম্ভাব্য সম্পদ চিহ্নিত ও মূল্যায়ন করে একটি তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো। বাংলাদেশ ব্যাংক পরে ওই তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরিয়াহ উপদেষ্টা কমিটির কাছে পাঠালে কমিটি উপযুক্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারণ করবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের শরিয়াহ উপদেষ্টা কমিটি প্রয়োজনে দেশে কার্যরত ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ উপদেষ্টা কমিটির মতামত নেবে। সব শেষে শরিয়াহ উপদেষ্টা কমিটির বাছাই করা প্রকল্পের বিপরীতে সুকুক বন্ড ছাড়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে পরামর্শ দেবে।

জানা গেছে, সুকুকের মাধ্যমে অর্থায়নের জন্য সম্প্রতি ৬৮টি প্রকল্পের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। নির্ধারণ করা হয়েছে প্রকল্পগুলোর টাকার পরিমাণও। এর মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পের জন্যই টাকা লাগবে ১২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ৭০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার ৫টি, ৪০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকার ১২টি এবং ২০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ৪৬টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে।

বৈচিত্র্যপূর্ণ মতামত

ইসলামী ব্যাংক বলেছে, সুকুককে জনপ্রিয় করতে সরকারের মাধ্যমে বন্ড ছাড়তে হবে । শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক বলেছে, দীর্ঘমেয়াদির পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি সুকুকও চালু করা যেতে পারে। তবে ব্যাংক যেহেতু জনগণের আমানতের টাকায় চলে, তাই এই টাকা বিনিয়োগ করতে হবে লাভজনক কোনো প্রকল্পেই। কারণ, জমানো টাকার বিপরীতে আমানতকারীদের মুনাফা দিতে হয়।

এক্সিম ব্যাংকের মতে, সরকারের দৃশ্যমান প্রকল্পগুলো সামনে রেখে সুকুক চালু করা যেতে পারে। তবে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে যেহেতু সরকারের দৃশ্যমান কোনো আয় হয় না, তাই এ ধরনের প্রকল্পের বিপরীতে সুকুক ছাড়া হলে প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে পাওয়া সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে সরকার জনগণের পক্ষে সুকুকে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দিতে পারে।

এসআইবিএল বলেছে, সুকুক চালুর পূর্বশর্ত হচ্ছে আন্ডারলাইন এসেট, যা অবশ্যই সরকারি মালিকানাধীন হতে হবে এবং যা থেকে আয় আসতে হবে। সরকারের বিদ্যমান প্রকল্প বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বা চলমান প্রকল্প পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদিকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে।

ইউনিয়ন ব্যাংকের মতে, সুকুকের বিপরীতে মুনাফা দিতে হবে বিধায় তাই লাভজনক প্রকল্প নির্ধারণ করাই সমীচীন হবে।

যত ধরনের সুকুক আছে

সুকুক ছাড়া হয় মূলত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎস হিসেবে। জানা গেছে, প্রচলিত বন্ড ও ইসলামী সুকুক বন্ডের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বন্ড হচ্ছে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি। এতে উল্লেখ থাকে ঋণের পরিমাণ, পরিশোধের সময় ও সুদের হার। প্রচলিত বন্ডে সুদ, ফাটকা ইত্যাদি থাকায় তা শরিয়াহসম্মত নয়। আর সুকুক হচ্ছে সম্পদের ওপর মালিকানা দেয়ার নিশ্চয়তা থাকে এমন একটি বিনিয়োগ সনদ। সাধারণত সুকুকধারীরা সম্পদের মালিকানা লাভ করেন ও মুনাফা পান।

দেশে ইসলামী ব্যাংকিং চালু থাকা ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুদারাবা (মুনাফায় অংশীদারি), মুশারাকা (লাভ-লোকসান ভাগাভাগি), মুরাবাহা (লাভে বিক্রি), ইশতিসনা (পণ্য তৈরি), করজ হাসান (উত্তম ঋণ), সালাম (অগ্রিম ক্রয়) ও ইজারা (ভাড়া) সুকুক প্রচলিত আছে।

দেশে দেশে সুকুক

জানা যায়, বিশ্বে সুকুক ছাড়ার দিক থেকে বর্তমানে মালয়েশিয়া প্রথম স্থানে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও (আইডিবি) সুকুক ছেড়েছে। এছাড়া সুকুক প্রচলিত রয়েছে বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। মুসলিম দেশের পাশাপাশি অনেক অমুসলিম দেশেও এখন সুকুক চালু রয়েছে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা থমসন রয়টার্সের ২০১৬-১৭ সময়ে প্রকাশ করা ‘বৈশ্বিক ইসলামি অর্থনৈতিক প্রতিবেদন’ অনুযায়ী ২০১৫ সালে বৈশ্বিক ইসলামী অর্থায়নের সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ ট্রিলিয়ন বা দুই লাখ কোটি মার্কিন ডলার। ইসলামী অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি প্রবল ইতিবাচকতার কারণে ২০২১ সালেই তা উন্নীত হবে প্রায় সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে।

 

 

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট