চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সেজে ১৭টি অবৈধ ট্যাক্সি ছাড়িয়ে নেন সাহেদ

নাজিম মুহাম্মদ

১৫ জুলাই, ২০২০ | ৩:০৪ অপরাহ্ণ

নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিচয় দেয়া ‘মহাপ্রতারক’ সাহেদ করিমের এক ফোনে অবৈধ সন্দেহে আটক করা সতেরোটি সিএনজি ট্যাক্সি উদ্ধার করার কয়েকঘণ্টার মধ্যেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ওই অভিযানে অংশ নেয়া চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগও করেন সাহেদ করিমের বন্ধু জিয়া মো. জাহাঙ্গীর। সাহেদ করিম বলেছিলেন, ‘পুলিশের সিকিউরিটি সেল আমার হাতের মুঠোয়ে।’ এরমধ্যে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাকি দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত চলছে। সবই হয়েছে সাহেদ করিমের ইশারায়।

সিএনজি ট্যাক্সি উদ্ধারের ঘটনার দুই মাসের মাথায় সাহেদ করিম স্বশরীরে সিএমপি সদর দপ্তরে এসে তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্যকে অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘টেলিফোন করে বলার সাথে সাথে সবকিছু কেন সমাধান করা হয়নি? সামান্য সিএনজি ট্যাক্সির জন্য আমাকে কেন চট্টগ্রাম আসতে হলো’। অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশ সদস্যদের বকাবকিও করেন প্রতারক সাহেদ। বলেন, ‘মন্ত্রী, সচিব, বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবাই আমার কথা শুনতে বাধ্য। চট্টগ্রামের মেগা মোটরসের মালিক জাহাঙ্গীরসহ বাংলাদেশের অনেককেই এ ধরনের সিএনজি ট্যাক্সি আনার কাজে আমি সহায়তা করি। বিআরটিএ’র মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থাও করে দেই।’

১৭টি ট্যাক্সি পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার পরবর্তী তিনমাসে দফায় দফায় সাহেদ করিমকে ৯১ লাখ টাকা দেন জাহাঙ্গীর। তিন বছরের মাথায় দাপুটে সাহেদ করিম ও তার এক সহযোগীর বিরুদ্ধে ৯১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে নগরীর ডবলমুরিং থানায় মামলা দায়ের করেন জাহাঙ্গীরের জেঠাতো ভাই সাইফ উদ্দিন।

ঘনিষ্ঠ সাহেদকে ঘটনার তিন মাসের মাথায় প্রতারক দাবি করে মামলা দায়ের প্রসঙ্গে জিয়া মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের জেঠাতো ভাই মামলার বাদি সাইফ উদ্দিন পূর্বকোণকে জানান, গোয়েন্দা পুলিশ আনোয়ারার আমাদের গুদাম থেকে ১৭টি গাড়ি নিয়ে আসে। তখন সাহেদ করিম পুলিশকে ফোন করেন। এরপর গাড়িগুলো ছেড়ে দেয়। তিনি বলেন, সাহেদ করিমের সঙ্গে তখন আমাদের লেনদেন হয়নি। আমাদের ম্যানেজার শহীদুল্লাহর মাধ্যমে ঢাকায় শাহেদ করিমের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর লেনদেন হয়। সাইফুদ্দিনের দাবি, শাহেদ করিম অনেকটা নিজে থেকেই পুলিশকে ফোন করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিচয় দেন। তার কথায় গাড়িগুলো ছেড়ে দিলে আমরা বিশ্বাস করে ঢাকা বিআরটিএ থেকে কাগজ বের করতে পরবর্তীতে ৯১ লাখ টাকা দেই।
সিএনজি ট্যাক্সি উদ্ধারের অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) বর্তমানে পশ্চিম জোনের এডিসি হুমায়ুন কবির জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খোঁয়াজনগর এলাকা থেকে ১৭টি অবৈধ সিএনজি উদ্ধার করেছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে উদ্ধার করা এসব সিএনজি যাচাই বাছাই করার আগেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাৎক্ষণিক ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওই ঘটনায় আটক দুই ব্যক্তিকে একজন আইনজীবীর জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো।

২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর দুপুরে কর্ণফুলী খোঁয়াজনগর মেগা মোটরসের গুদাম থেকে সতেরোটি ট্যাক্সি উদ্ধার করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ওই সময় প্রতিষ্ঠানের মালিক এ জেড এম জাহাঙ্গীর ও ম্যানেজার জাহেদ মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিনকে আটক করা হয়। ঘটনার রাতেই ট্যাক্সি ও আটক দুইজনকে ছেড়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে বিষয়টি তাৎক্ষণিক সমাধান করার নির্দেশ দেন সুচতুর সাহেদ করিম। ‘প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিচয়দানকারী’ সাহেদের ফোন পেয়ে ঐদিন রাতেই ১৬টি ট্যাক্সি (বিক্রি না করা ও প্রয়োজনে ফেরত সাপেক্ষে) ও দুই ব্যক্তিকে একজন আইনজীবীর জিম্মায় ছেড়ে দেয় পুলিশ। বিআরটিএ’র কাছে বৈধতা যাচাই করতে একটি ট্যাক্সি মনসুরাদাবাদ ডাম্পিংয়ে রাখা হয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ট্যাক্সিগুলোর বৈধতা যাচাই করতে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিআরটিএ। কমিটির পাঁচ সদস্য বিআরটিএর চট্টমেট্রো সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক আবদুল করিম, মাহবুব কামাল, আনিসুর রহমান, রবিউল ইসলাম ও মেকানিক্যাল এসিস্ট্যন্ট শাহাদাত হোসেন চৌধুরী মনসুরাবাদ ডাম্পিং স্টেশনে সরেজিমন পরিদর্শন করে ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবরে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে বলা হয়েছে, উদ্ধার করা সিএনজি ট্যাক্সির মূল ড্যাসবোর্ড ফ্রেমে চ্যাসিস নম্বর এবং একই চ্যাসিস নম্বরের উপরে আলাদা প্লেটে আরও একটি চ্যাসিস নম্বর পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের মোটরযান চ্যাসিস নম্বর নজিরবিহীন বিধায় অধিক যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদের দ্বারা যাচাই করা প্রয়োজন বলে মনে করেন কমিটি। বিআরটিএ প্রতিবেদন দিলেও জিম্মায় নেয়া সতোরোটি সিএনজি ট্যাক্সির বিষয়ে আর কোনো তদন্ত করেনি পুলিশ।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট