চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কার জন্য এত সম্পদ

বাদল সৈয়দ

১৪ জুলাই, ২০২০ | ২:০৩ পূর্বাহ্ণ

রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম কিংবা জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরী ও তার স্ত্রী ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনের অপকর্মের সমালোচনায় তোলপাড় সারাদেশ। কোভিড- ১৯ ’র নমুনা পরীক্ষার নামে এ তিনজন যে জালিয়াতি করেছেন এবং নানা উপায়ে সম্পদের যে পাহাড় গড়েছেন, সেটা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়। এত বিত্ত-বৈভব গড়ার ফল যে সুখকর হয় না, সেটাই মাঝেমধ্যে ধরাপড়া দুর্নীতিবাজদের পরিণতি দেখলে বুঝা যায়। লেখাটি বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্বকোণ পাঠকদের ভাল লাগবে, সেই বিশ্বাসে অভিজ্ঞতালব্ধ কথাগুলো পত্রস্থ করা হল।

১. ওয়ান ইলেভেনের সময় একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেন। সাথে তাঁর স্ত্রী। এ সময় তাঁদের সম্পদের তদন্ত করা হচ্ছিলো। দায়িত্বপ্রাপ্ত টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে ভদ্রমহিলাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ বিপুল সম্পদ জোগাড়ের উৎস সম্পর্কে আপনার কিছু বলার আছে? তিনি উত্তর দিলেন, আমার হাজবেন্ডকে জিজ্ঞেস করুন। তাঁকে আপনারা জেলে দিন, ফাঁসি দিন, কিন্তু আমাকে নিয়ে টানাটানি করছেন কেন? আমি বললাম, কিন্তু আপনি তো তাঁর সম্পদের সুবিধাভোগী- কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বললেন, আমি তাঁকে বলিনি চুরি করে আমাকে সম্পদ বানিয়ে দিতে। সে দিয়েছে, আমি এনজয় করেছি। আমার কী দোষ? তাঁকে শাস্তি দিন, আমাকে নয়। তাঁর পাপের শাস্তি আমাকে কেন দেবেন?
২. আরেকজন। বাড়ির সংখ্যা কুড়ির ওপর। জিজ্ঞেস করলাম- ভাই, এত বাড়ি কেন করলেন? কার জন্য? কয়টা বাড়ি এক জীবনে লাগে? অন্তত একটি জায়গায় এসে থামতে তো পারতেন! তিনি উত্তর দিলেন, স্যার, প্রথম বাড়িটি করার পর কেমন নেশার মতো হয়ে গেলো। কেন এত বাড়ি করলাম নিজেও জানি না। এর কিছুদিন পর জামিনে থাকা অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। কয়েকদিন পর তাঁর আইনজীবী মৃত্যুর খবর দেয়ার জন্য অফিসে এলেন। তখন শুনলাম ভয়ংকর এক কাহিনী।
ভদ্রলোকের নাকি দুই বিয়ে ছিলো। তাঁর লাশ উঠানে ফেলে দুই পক্ষ তীব্র ঝগড়ায় মাতলো সম্পত্তির বিলি-বন্টন নিয়ে। উভয় পক্ষের জেদ- তাঁকে দাফন করার আগেই এ বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। অনেকে বুঝালেন যা হবে আইন অনুযায়ী হবে। কে শোনে কার কথা! উভয় পক্ষের দাবি তাঁদের প্রাপ্যতা বেশি।
তাঁরা ঝগড়া করছেন আর সম্পদ উপার্জনকারীর লাশ উঠানে পিঁপড়ায় খাচ্ছে!
৩. অন্য আরেকজন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। আমার সাথে দেখা এ শতকের প্রথম দিকে। তখন তাঁর বয়স প্রায় পঁচাশি। আমি একবার জিজ্ঞেস করলাম- স্যার, কিছু মনে করবেন না, এ বয়সে আপনার কি এতো ঝামেলা করে অফিসে অফিসে ঘুরার দরকার আছে? বাড়িতে আর কেউ নেই?
তাঁর চেহারা কুঁচকে গেলো, সেখানে কিলবিল করতে লাগলো হতাশা। তিনি বললেন- আপনি আমার পুত্র না, নাতির বয়সী। আপনাকে একটি কথা বলি, চাকুরি জীবনে আমি প্রয়োজনের চাইতে বেশি কামিয়েছিলাম। সেটিই আমার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি মাত্র ছেলে। পড়াশুনা করেনি। সারাদিন ঘুমায় আর সন্ধ্যা হলে ক্লাবে গিয়ে মদ নিয়ে বসে। মাঝরাতে পাঁড় মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। ভোরের দিকে ঘুমায়। তারপর সারাদিন বিছানায়। বিয়েশাদিও করাতে পারি নাই।
বলতে বলতে তিনি কাছে ঝুঁকে বললেন, ভাই, আমার ছেলে মানুষ হয় নাই কেন জানেন? আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি বলতে লাগলেন, কারণ সে জানে তাঁর বাবার টাকা এক জন্মে খেয়ে সে শেষ করতে পারবে না। আমি যদি প্রয়োজনের বেশি উপার্জন না করতাম তাহলে এটা হতো না। সন্তান ‘অমানুষ’ হওয়ার মতো কষ্ট আর কিছুতে নেই ভাই।
৪. এবার একদম নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। একবার আমি আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা, আমার উপার্জনে যদি কোনো কালো দাগ থাকে তুমি কি তার দায়ভার নেবে? আমার স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি জানি আমার উত্তরে তুমি মন খারাপ করবে, তবু সত্য কথাটা বলি। তা হলো, পরিবারপ্রধান হিসেবে আমাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব তোমার, কিন্তু সে উপার্জনের দায়ভার ইহকালে বা পরকালে আমি বা অন্য কেউ কখনোই নেবে না। অতীতেও কেউ নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে না। কেউ চাইলেও নিতে পারবে না। একইভাবে আমি যে রোজগার করি তার দায়িত্ব তুমি নেবে না। ইউ মাস্ট ডাইজেস্ট দিস বিটার ট্রুথ।
একদম বুকে ধাক্কা দেয়ার মতো সত্য কথা, তাই না?

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট