চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দেড় কোটি পরিবারের জন্য নগদ সহায়তা চায় পিআরআই

নিজস্ব প্রতিবেদক

৪ মে, ২০২০ | ৭:৫৩ অপরাহ্ণ

  • মাসিক ৩ হাজার টাকা করে ৩ থেকে ৬ মাস এই সহায়তা দেয়ার সুপারিশ

মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে দেশের দেড় কোটি কর্মহীন-দরিদ্র পরিবারে নগদ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রতি পরিবারকে যদি মাসিক ৩ হাজার টাকা করে দেয়া হয় তাহলে এ দেড় কোটি পরিবার অন্তত দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারবে।
একই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এ সুবিধা তিন থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস দেয়া যেতে পারে। এই সুবিধা দীর্ঘদিন অব্যাহত রাখলে প্রান্তিক মানুষেরা সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। প্রস্তাব মোতাবেক প্রথম প্রান্তিকে, দেড় কোটি পরিবারকে তিন মাস তিন হাজার টাকা করে দিলে সরকারের খরচ হবে ১১ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা।
গবেষণায় উপকারভোগীর তালিকা প্রস্তুতের ব্যাপারে ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তালিকা তৈরির বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করলে তাতে রাজনীতিকীকরণের আশঙ্কা থাকে। তাই এ বিষয়ে বিকল্প ভাবার উপর গুরুত্বারোপ করেছে গবেষণা সংস্থাটি। একইসঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে কিভাবে নগদ সহায়তা পৌঁছতে পারে সে ব্যাপারে গুচ্ছ প্রস্তাবও দিয়েছে সংস্থাটির ওই প্রতিবেদনে।
পিআরআই’র ‘রিচিং আউট টু দ্য পুওর এন্ড নিডি উইথ ডাইরেক্ট ক্যাশ সাপোর্ট: ডিলিং উইথ দ্য লাস্ট- মাইল ডেলিভারি চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রস্তাব আকারে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।
পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ছাড়াও এই গবেষণায় অন্যদের মধ্যে ছিলেন, আবদুর রাজ্জাক ও বজলুল এইচ খন্দকার।
কেন নগদ সহায়তার প্রস্তাব :
কেন নগদ সহায়তার প্রস্তাবের কারণ ব্যাখ্যা করে পিআরআই-এর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে দীর্ঘ সময়ের জন্য সামাজিক দূরত্ব এবং লকডাউন ব্যবস্থা প্রয়োজন হতে পারে। আর এ সময়ে অর্থনৈতিক সংকট পুনরুদ্ধারে ৩-৬ মাসের জন্য জীবিকা-সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর অনানুষ্ঠানিক পেশায় নিযুক্ত লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। একটি সংবাদপত্র পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, রপ্তানির আদেশ ব্যাপকভাবে বাতিল এবং ভবিষ্যতের রপ্তানির সম্ভাবনা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ৪৭ শতাংশই চাকরি হারিয়েছেন কিংবা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন।
এদিকে, দেশব্যাপী আরোপিত লকডাউনের কারণেও কয়েক লাখ পরিবহণ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন অধিকার গোষ্ঠী এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির মতে, লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব ব্যবস্থা কার্যকর করার পর থেকে আনুমানিক ৯০ লাখ শ্রমিকের আয়ের কোনো উৎস নেই। নানা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে গবেষণায় দেখা যায়. কর্মসংস্থান হারানোয় ক্ষতির দায় বহন করতে হতে পারে প্রায় ১ কোটি থেকে সোয়া কোটি পরিবারকে।
পিআরআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ৫.৫ মিলিয়ন জনসাধারণের জন্যে একটি খাদ্য রেশন ব্যবস্থা চালু করার বিষয়েও চিন্তাভাবনা করছে। এটি যেহেতু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তাই সরাসরি নগদ সহায়তা এক্ষেত্রে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। প্রয়োজনে পরবর্তীকালে রেশন সুবিধাভোগীদের প্রস্তাবিত নগদ ভাতা কার্যক্রম থেকে নগদ সহায়তা বাদ দেওয়া যেতে পারে।
ত্রাণ বণ্টনের ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয়টিও গবেষণায় তুলে ধরে বলা হয়েছে, দুর্ভাগ্যজনক কিছু বাস্তবতায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম দেশে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা খুব কঠিন। চুরি এবং ত্রাণ সামগ্রীর অপব্যবহারের অভিযোগতো আছেই। এ অবস্থায় সাধারণ লোকজনের নিত্যপণ্যের স্বাচ্ছন্দ্যময় ব্যবহার, কেনাকাটা নিশ্চিত করতে নগদ সহায়তা জরুরি। ত্রাণ মানে নির্দিষ্ট কিছু পণ্য। কিন্তু একটি পরিবারের দৈনন্দিন নানা পণ্যের প্রয়োজন হয়, যা প্রাপ্ত ত্রাণে থাকে না। সেই জন্যই নগদ অর্থ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
নগদ অর্থ সহায়তা প্রদানের সবচেয়ে উপযুক্ত যুক্তি হল- প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের মৌলিক প্রয়োজনাদি বিতরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সহায়তা প্রদানের প্রক্রিয়া প্রমাণের দক্ষতা অর্জন করলেও করোনা সম্পূর্ণ ভিন্ন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে সংগঠিতকরণ এবং পরিষেবা সরবরাহের ফলে মানুষের মাঝে রোগের বিস্তার ঘটার আশঙ্কা বিদ্যমান। তাই সামাজিক সুরক্ষা অক্ষুণœ রাখতে হলে পরিবারগুলোতে নগদ অর্থ প্রদানের কর্মসূচিটি ব্যবহারিক এবং উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে।
অন্য দেশ কী করছে? :
করোনার এমন নাজুক পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশ কী করছে, সেই উদাহরণ দিতে গিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, পেরু এমনকি প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চিত্র তুলে ধরেছেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিলিতে নতুন উপকারভোগীদের (নতুন দরিদ্র) সহায়তার জন্য নাগরিকদের জাতীয় আইডি’র মাধ্যমে জরুরি অর্থ প্রদান করা হচ্ছে।
পেরুতে দরিদ্রতম নাগরিকদের শনাক্ত করার জন্য আদমশুমারির বিশদ তথ্য ব্যবহার করে। সেখানে ‘কন্ডিশনাল ক্যাশ ট্রান্সফারে’র (সিসিটি) জন্য তৈরি ডাটারভিত্তিতে ন্যূনতম মজুরির ৫০ শতাংশের সমতুল্য অতিরিক্ত অর্থ স্থানান্তর করে। উপকারভোগীরা অনলাইনে তাদের প্রাপ্যতা যাচাই করতে পারেন এবং একটি জাতীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সে অর্থ পাঠানো হয়।
প্রতিবেশী দেশ ভারত সরকার দরিদ্রদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য তৈরি করা আধার আইডি সিস্টেমের সাথে যুক্ত জনগণের একাউন্টে অর্থ প্রেরণ করেছে। উত্তরপ্রদেশ রাজ্য ঘোষণা করেছে, দরিদ্র ও দৈনিক মজুরিতে সরাসরি অনলাইন অর্থ প্রদান করবে।
পাকিস্তানে ডাটাবেস না থাকায় পরিস্থিতি বিবেচনায় পাকিস্তান দরিদ্রদের নগদ অর্থ স্থানাস্তরসহ একটি ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। জরুরি প্রয়োজনে জাতীয় পরিচয় নম্বর দিয়ে টেক্সট অথবা এসএমএস করার পর স্ব-নির্বাচিত সুবিধাভোগীদের তিন মাসের ভাতার (১২ হাজার পাকিস্তানি রুপি) একটি কিস্তি হস্তান্তর করা হয়েছে।
একগুচ্ছ প্রস্তাবনা :
অসহায় ও অভাবী প্রান্তিক মানুষের সঠিক তালিকা তৈরি এবং তাদের হাতে নগদ সহায়তা কিভাবে দ্রুততম সময়ে পৌঁছানো যায়, সে ব্যাপারে একগুচ্ছ প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি জোর দিয়েই বলেছে, তালিকার বিষয়টি যেন রাজনৈতিক না হয়। মেম্বার, চেয়ারম্যানরা এই তালিকা করলে রাজনীতিকীকরণের আশঙ্কা থাকে। এতে অনেকেই বাদ পড়বেন। এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
অন্যদিকে, তালিকাভুক্তদের হাতে সরাসরি নগদ অর্থ পৌঁছানোর ব্যাপারে মোবাইল আর্থিক পরিষেবা (এমএফএস)-কে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সহজলভ্য এবং দ্রুত সম্প্রসারণের প্রেক্ষিতে এখন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও খুব সহজে টাকা পাঠানো যায়। তাই, জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলে বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে সমস্ত কর্ম-ভিত্তিক খাদ্য স্থানান্তর কার্যক্রমগুলিকে নগদ সহায়তা প্রকল্পে রূপান্তর করার প্রস্তাব দিয়েছে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
১. এক কোটি থেকে সোয়া কোটি পরিবারের জন্য একটি নতুন শর্তহীন ‘জরুরি নগদ ভাতা প্রোগ্রাম (ইসিএপি)’ স্থাপন করা, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হবে। প্রত্যেক পরিবারের জন্য মাসিক ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করতে হবে। যা তারা বিকাশ, রকেট, নগদ, শিওরক্যাশ ইত্যাদি ডিএফএস ব্যবহার করে মোবাইল ফোন একাউন্টের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারবেন।
২. সহায়তার প্রয়োজন এমন পরিবারগুলোকে ভাতার জন্য স্ব-শনাক্তকরণ বা স্ব-নিবন্ধন করা। প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে নাগরিকদের সর্বাধিক মাসিক ভাতা (৩ হাজার টাকা) সম্পর্কে অবহিত করা, এবং এই শর্তে যে, কেবলমাত্র কোভিড-১৯ এ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারই এই রাষ্ট্রীয় সহায়তার জন্য উপযুক্ত।
৩. নাগরিকদের মোবাইল নম্বরে কল / ডায়ালিং/ এসএমএস পাঠানোর মাধ্যমে কর্মসূচিতে নিজেকে শনাক্ত বা স্ব-নিবন্ধিত করতে হবে। নিবন্ধকরণ প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট সহজ করতে হবে যাতে সুবিধাভোগীরা কোন সমস্যা ছাড়াই আবেদন করতে পারেন। নিবন্ধকরণের সময় তাদেরকে পরিবারের প্রধানের নাম, ঠিকানা এবং ইউনিয়ন পরিষদের ভিত্তিতে পরিবারের সদস্যদের জন্য বা তাদের জন্মের তারিখ উল্লেখ করতে হবে। এবং অর্থ প্রদানের জন্য তাদের ডিএফএস একাউন্টের তথ্যও দিতে হবে।
৪. নিবন্ধকরণ প্রক্রিয়া জরুরি নগদ ভাতা কর্মসূচির আওতায় সহায়তাপ্রাপ্ত পরিবারের একটি ডাটাবেস স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করতে পারে। এক কোটি থেকে এক কোটি ২০ লাখ পরিবার নিয়ে একটি ডাটাবেস ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে তৈরি করা যেতে পারে।
৫. এই কার্যক্রম পরিচালনা করতে অনেক পরিবারের নিবন্ধনে সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ হলো, এমএফএস এজেন্টদের পরিষেবাগুলি ব্যবহার করা। উপরের উল্লিখিত হিসাব অনুযায়ী প্রায় এক কোটি এজেন্ট সারাদেশে আছে। এজেন্টদের সামাজিক দূরত্ব পর্যবেক্ষণ করার সময় আবেদনকারীদের কীভাবে সহায়তা করা উচিত সে সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশাবলী সরবরাহ করা।
৬. অগ্রাধিকারে থাকবে সম্ভাব্য প্রাপকেরা যাতে পরিষেবা প্রদানকারীদের সরকার কর্তৃক বাছাই না করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি সাধারণ বাজার ব্যবস্থার নীতিগুলোর সাথে সামঞ্জস্য করবে এবং পরিষেবা সরবরাহকারীদের উৎসাহিত করতে পারে। এজেন্টদের জন্য, কিছু পরিষেবা চার্জ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত থাকবে। চার্জগুলো নিয়ে এমএফএস সরবরাহকারীদের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। যা সরাসরি সরকার সরবরাহ করতে পারে বা প্রাপকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট