চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনা সন্দেহভাজন প্রসূতির প্রসবকালীন দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন চিকিৎসক

নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ এপ্রিল, ২০২০ | ২:৫৮ অপরাহ্ণ

করোনা উপসর্গ নিয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক প্রসূতির প্রসবকালীন পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. জাহানারা শিখা। আবেগঘন এবং শিউরে ওঠা সংকটকালীন সেই দুর্জেয় অভিজ্ঞতা পাঠকদের উদ্দেশ্য তুলে ধরা হল।

‘বাচ্চাটা খুব খারাপ অবস্থায় বেরুবে ভেবেছিলাম। কিন্তু বেরিয়েই চিৎকার দিয়ে জানান দিল সে “তোমাদের ধন্যবাদ !! আমি ভাল আছি। ” ততক্ষণে পিপিইর চাপে জমা ঘাম আর চোখের পানি মিলেমিশে একাকার আমার ।

ডেথ সেন্টেন্স ই মনে হচ্ছিল আজ কাকডাকা ভোরের ফোনকল টাকে। তখন ভোর ছয়টা। সিনিয়র কলিগ ফোন করেছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে একজন রোগী রেফারড হয়েছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। করোনা সাসপেক্টেড লেবার এর রোগী । সিজারিয়ান লাগবে। রোগীর চারদিন ধরে জ্বর , কাশি । যেহেতু এটা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল আর আমি আগামী সাতদিনের জন্য অন কল কনসালটেন্ট, আমাকেই যেতে হবে সিজার করতে। চরম দিশেহারা হয়ে কোনরকমে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে দৌড়ে এলাম হাসপাতালে। শুনলাম স্টাফ নার্সকে নিয়ে অপারেশন করতে হবে। কারণ সকল মেডিকেল অফিসার আইসোলেশন ওয়ার্ড এর রোস্টার ডিউটি করছে।সিজারে এসিস্ট করার কেউ নেই। কম্পমান বুকে মনে মনে ছক কষছি আমি তখন কারণ খুব অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত সিজার শেষ করে আসতে হবে আমাকে । অপারেশন এ সময় যত বেশি লাগবে তত বেশি এফেক্টেড হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে আমার আর আমার টিম এর ।

চশমা ছাড়া কিছু দেখিনা আমি, তার ওপর পিপিইর গগলস, ফেস শিল্ড পড়ে চোখে আদৌ অপারেটিভ ফিল্ড দেখতে পাব কিনা, নার্সকে নিয়ে অপারেশন করে পনের বিশ মিনিট এর মধ্যে অপারেশন শেষ করে আসতে পারবো তো ?
অন্তরাত্মা ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠল । এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় যখন আমার অবস্থা,তখন এগিয়ে এলেন আমার সিনিয়র কনসালটেন্ট শিমুল আপা। বললেন – ‘আমিও যাচ্ছি, চল্ ‘  সাথে সাথে ভয়ডর উধাও হয়ে গেল । কলিজা টা এত্ত বড় হয়ে গেলো আমার । অপারেশন শুরুর আগে রোগীকে এগজামিন করে মনে হলো, খুব খারাপ ভাবে বাসায় হ্যান্ডেল হওয়া অব্সট্রাকটেড লেবার । বাচ্চার হার্টবিট তখনও আছে। সিজার ডিফিকাল্ট হবে । আপা বললেন , ” খারাপ কেস , ঝামেলা হতে পারে।”
এদিকে ব্লাড লাগলে রোগীর লোক তা আনতে পারবে কিনা জানিনা । কোন পুরুষ লোকও সাথে দেখছিনা । আপাকে বললাম ,”আপনি এক্সপোজড হবেন না ,আপা! আপনি তো আছেন ই । প্রয়োজনে হেল্প নেবো আপনার। আমি সিস্টারকে নিয়ে শুরু করি।” কিন্তু আপা আমাকে এসিস্ট করতেই এগিয়ে এলেন। মহৎ হৃদয় আপা’র সহযোগিতায় দ্রুত গতিতে সিজার সেরে বেরিয়ে এলাম, আলহামদুলিল্লাহ । অনেক ব্লিডিং হচ্ছিল একপর্যায়ে । সেটাও দুজনে মিলে দারুনভাবে ম্যানেজ করলাম।
বাচ্চা , মা ভাল আছেন। আলহামদুলিল্লাহ ।
আমরা আছি । মানুষের জন্য । মানুষের পাশে। একটু ভয় করে সত্যি । তবে ভয়টা নিজের জন্য নয়। বাচ্চাদের জন্য ।
মা ছাড়া আমাদের বাচ্চাদের আর কে আছে জগতে ? রোগীর স্যাম্পল কালেকশন করে নিয়ে গেছে। দোয়া করবেন সবাই, যাতে রোগীর কোভিড নেগেটিভ আসে। পজিটিভ হলে বাসায় যেতে পারবনা একুশ দিন। বাচ্চাগুলোকে ‘যাই’ বলতেও পারিনি হাসপাতালে আসার সময়।”

 

 

 

 

 

 

 

 

পূর্বকোণ/এম

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট