চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মন্তব্য প্রতিবেদন

হার্ড ইমিউনিটি তত্ত্বে কোভিড-বর্ণবাদ!

আহমেদ শরীফ শুভ

১৯ এপ্রিল, ২০২০ | ২:৫৮ পূর্বাহ্ণ

কোভিড-১৯ প্রতিরোধে হার্ড ইমিউনিটি তত্ত্বের কার্যকারিতা এখনও প্রমাণ সাপেক্ষ না হলেও এ নিয়ে থেমে নেই আলোচনা- সমালোচনা।
তবে ধরে নেয়া হয়, হার্ড ইমিউনিটির সবচেয়ে কার্যকর এবং পরীক্ষিত পন্থা হচ্ছে গণ-ভ্যাক্সিনেশন। হার্ড ইমিউনিটি ডেভেলপ করতে কমিউনিটির প্রায় ৭০% মানুষকে একটি রোগের প্রতি ইমিউন হতে হয়, যাতে ভাইরাসটি পর্যাপ্ত হোস্টের অভাবে ছড়াতে না পেরে এক পর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। গণ-ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমেই এত ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। অন্য আরেকটি উপায় হচ্ছে, ব্যাপকসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠলে তাদের মধ্যে সেই রোগের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হলে।
যারা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটির প্রত্যাশায় আছেন তারা এই দ্বিতীয় পথটিকেই হাতিয়ার করার কথা ভাবছেন। তাদের ভাবনা, যেহেতু এই রোগটি প্রায় ৮০% ক্ষেত্রেই তেমন মারাত্মক নয় এবং অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে মারাত্মক উপসর্গ ও মৃত্যুর হার কম, সেহেতু যদি তাদের মধ্যে রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তবে তা কমিউনিটিতে হার্ড ইমিউনিটির কারণ হবে। হয়তো কথা সত্যি। কিন্তু যদি কমিউনিটির ৭০% মানুষের হওয়ার জন্য আমরা কড়াকড়ি শিথিল করে তরুণদের উপর লক ডাউনের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে তাদের কাজে ফিরতে দেই ( অর্থনীতি সচল রাখার নামে) তাদের মধ্যেও কেউ কেউ যে মারাত্মক উপসর্গে পড়বে না বা মারা যাবে না তা ভাবার কোন কারণ নেই। যদিও রোগটি ৬৫ বছরের চেয়ে বেশি বয়স্কদের মধ্যেই মারাত্মক হয় এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারী শিশু, কিশোর ও তরুণদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাছাড়া তরুণরা ব্যাপক সংখ্যায় আক্রান্ত হলে, যদি তাদের ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক না-ও হয়, তারা তো তা তাদের বয়স্ক বাবা মায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দেবে এবং সেভাবে পর্যায়ক্রমে তা দেশের সমগ্র প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়বে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী হার্ড ইমিউনিটির জন্য যদি ৭০% মানুষকে সংক্রমিত হতে হয় তাহলে দেশের প্রায় ১২ কোটি মানুষের মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে হবে। তাদের মধ্যে যদি ২০% মানুষ মারাত্মক অসুস্থ হয় তাহলে সেই সংখ্যাটি হবে ২৪ লক্ষ। ধরে নিলাম, আক্রান্তদের মধ্যে ১ শতাংশের মৃত্যু হবে (বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে এই হার ৪.৫%), তাহলেও কমপক্ষে ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে, আর বর্তমান পরিসংখ্যানের হার অনুযায়ী তা হবে কমপক্ষে ৫৪ হাজার। আমরা কি হার্ড ইমিউনিটি ডেভেলপ করার মূল্য হিসেবে এতোগুলো মৃত্যু মেনে নিতে প্রস্তুত? যারা ব্যাপক কমিউনিটি সংক্রমণের মাধ্যমে হার্ড ইম্যিউনিটি ডেভেলপ করার সুযোগের কথা ভাবছেন তারা কি তাদের পরিবারে একটিও মৃত্যু মেনে নিতে প্রস্তুত। আরো নিরাশার কথা হচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আজ জানিয়েছে যে, কোভিড-১৯ এর অনেক রোগীই দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হচ্ছেন। অর্থাৎ, তাদের ইমিউনিটি ডেভেলপ করছে না। তার মানে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি ডেভেলপ করার সূত্রটি কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে কার্যকর না হবার সম্ভাবনা প্রচুর।
পাশ্চাত্য দেশগুলো থেকে হার্ড ইমিউনিটি ডেভেলপ করার মেকানিজম নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে, অনেক তত্ত্ব দেয়া হচ্ছে। ভালো কথা। যদি কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে গবেষণা করতেই হয়, তবে তা পাশ্চাত্য থেকেই শুরু হোক। অজ¯্র মৃত্যুর বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশকে এই গবেষণার ল্যাবরেটরি হতে দিতে পারি না। নিজেদের দেশে লকডাউন কড়াকড়িভাবে আরোপ করে অন্যত্র হার্ড ইমিউনিটির থিওরি দেয়া বর্ণবাদেরই পরিচায়ক। আমাদের এধরণের কোভিড-বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে। ভ্যাক্সিনেশন ছাড়া কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি ডেভেলপের চেষ্টা করার চেয়ে কড়াকড়িভাবে লকডাউন আরোপ এবং শারীরিক দূরত্ব বাজায় রাখা ছাড়া আপাততঃ আর কোন বিকল্প নেই। পাশ্চাত্যে হার্ড ইমিউনিটি তত্ত্ব কার্যকর হলে আমরা নিশ্চয়ই অনুসরণ করব।
লেখক : মেলবোর্ন প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, কবি, গল্পকার ও সমাজকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট