চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনা মোকাবেলা

অগ্রাধিকার : প্রতিরোধ না চিকিৎসা?

ডা. রুমী আহমেদ খান

৮ এপ্রিল, ২০২০ | ২:৫৬ পূর্বাহ্ণ

বিপদের সময় দেশের মানুষের কালেকটিভ ফাইটিং স্পিরিট আর গুড সামারিটান নেচার এর প্রকাশ পাওয়া যায়। সবাই বাংলাদেশের জন্য মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর এর কথা বলছে। দেশে বিদেশে দেশের জন্য মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর/কৃত্তিম শ^াসযন্ত্র সংগ্রহ অথবা নিজেরা লোকালি ম্যানুফ্যাকচার করার চেষ্টা চলছে। অনেক গ্রুপ অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে দেশের জন্য ভেন্টিলেটর কেনার জন্য। তবে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর এর অর্থ আর এফোর্ট ব্যয় করার আগে আমাদের কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড বেসিক ফ্যাক্ট জানা দরকার। আমার মতামত হচ্ছে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর এর উপর ফোকাস করতে গিয়ে আমরা আরো জরুরি অথচ সহজসাধ্য ইন্টারভেনশন গুলো ইগনোর করছি। নিচে এ প্রেমেসিস গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি-
১. করনোভাইরাসে আক্রান্ত যারা তাদের ৮০% এর খুব মাইল্ড অসুখ হয়। সামান্য সাধারণ ঠান্ডার মতো। এরা এমনি এমনি ভালো হয়ে যায়। ২. বাকি ২০% রোগীর নিউমোনিয়া হয়ে যায়, এবং এদের অনেকের রক্তে অক্সিজেন এর মাত্রা কমে যায়। এদের অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। ৩. উপরের ২০% এর মধ্যে পাঁচ শতাংশ রোগীর অবস্থা ক্রিটিকাল হয়ে যায় (ইতালির এক্সপেরিয়েন্স অনুসারে দশ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে)। এই পাঁচ পার্সেন্ট রোগীর জীবন সংহারী এআরডিএস ডেভেলপ করে, এদের কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র এবং আইসিইউ-এর প্রয়োজন হয়।
৪. এই যে শেষ পাঁচ শতাংশ রোগীর কথা বললাম – এদের মধ্যে শতকরা পঞ্চাশ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি সর্বাধিক উন্নত আইসিইউর দেশ চায়না, ইতালি বা যুক্তরাষ্ট্রে। ৫. বাংলাদেশে বর্তমানে আইসিউ বেড এর সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। সরকারি হাসপাতালে বিছানা খালি পাওয়া চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালগুলোতে যে পরিমাণ আইসিইউ বেড আছে তার সংখ্যা নগণ্য এবং সেগুলার ব্যয় বহন করা সাধারণ মানুষের জন্য অসম্ভব।
৬. দেশের আইসিইউগুলো ওপেন ওয়ার্ড এর মতো – কোনো আইসোলেশন বেড নাই, নেগেটিভ প্রেশার এর ব্যবস্থা নাই। ওখানে রোগী যেই ভর্তি হচ্ছে – তার একটা বড় অংশ অতিদ্রুত প্রচ- রেজিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছে আর ওই ইনফেকশন থেকেই মারা যাচ্ছে। এখন একজন করোনাভাইরাস এর রোগীকে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করলে তিনি আইসিইউ’র সব রোগীকে সংক্রমিত করে দেবে এবং নিজে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সংক্রমিত হয়ে যাবে। আমাদের ফোকাস করতে হবে সেই ৯৫% রোগীর প্রতি যাদের আইসিইউ তে যাবার প্রয়োজন পড়বে না।
আইসিইউর এই ৫% রোগীগুলোকে চিকিৎসা করার মতো ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও যথেষ্ট ট্রেইন্ড ম্যানপাওয়ার এই মুহূর্তে আমাদের নেই। এই ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও হিউমেন রিসোর্স বিল্ড করার সময়ও আমাদের হাতে নেই। আর ওদের ভালো করতে গিয়ে আইসিইউতে বাকি সব রোগীকে ইনফেক্টেড করে দেবার কোনো যুক্তিও নেই। তাই এই মুহূর্তে আইসিইউ রোগীর কথা আমাদের ভুলে যেতে হবে।
প্রশ্ন হলো মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন বা কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র কিনে বা বানিয়ে আমরা কি রাতারাতি দেশের আইসিইউর ক্যাপাসিটি বাড়িয়ে দিতে পারবো?
আমাদের মনে রাখতে হবে ভেন্টিলেটর পাজল এর একটা পিস্ মাত্র। এই পাজল এর আর পিস্গুলো কি? ওগুলো কি আমাদের হাতে আছে?
ভেন্টিলেটর ফিট করার জন্য রুমের দেয়ালে হাই প্রেশার অক্সিজেন সেটাপ লাগবে, দেয়ালে অটোক্লেভ করা পানির সোর্স থাকতে হবে। কয়টা হাসপাতালে কয়টা রুমে এই ব্যবস্থা আছে?
এই সব করে ভেন্টিলেটর কিনে বা বানিয়ে হয়তো রোগীকে ভেন্টিলেটর এ রাখলাম। কিন্তু এই রোগীকে তো সব রুমে বা গণ আইসিইউ ওয়ার্ডে রাখা যাবে না। কোভিড আক্রান্ত রোগীগুলোকে রাখার জন নেগেটিভ প্রেশার আইসোলেশন রুম লাগবে।
রোগীকে ভেন্টিলেটর এ দিলে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য প্রোপোফল, ফেন্টানিল টাইপের সিডেটিভ ঔষধ লাগবে। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এতো রোগী ভেন্টিলেটরে আছে যে ওই ঔষধ গুলোর চরম ঘাটতি হয়ে গেছে। এই ঔষধের সাপ্লাই এর কি অবস্থা বাংলাদেশে? আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রী কি ঔষধ ব্যবসায়ী সমিতির সাথে বৈঠক করে এই সাপ্লাই গুলো নিশ্চিত করেছেন?
একটা আইসিউ’র মূল জীবনীশক্তি হচ্ছে এর ট্রেইন্ড নার্সরা। আমাদের বড় বড় আইসিইউ তে তাই ট্রেইন্ড নার্সের প্রচ- সংকট। এতগুলো নতুন ভেন্টিলেটর বানিয়ে আইসিইউ বেড যে বাড়াবো নার্স কোথায় পাবো? ভেন্টিলেটর এর মতো নার্স তো কেনা যাবে না। আর দুদিনে তো একটা আইসিইউ নার্স বানানো যাবে না!
করোনাভাইরাস এ আক্রান্ত হয়ে যারা ভেন্টিলেটর এ আছেন তারা অবধারিত ভাবে করোনাভাইরাস ইনফেকশনের দুটো কমপ্লিকেশনে ভুগছেন। এআরডিএস; আর সাইটোকাইন স্টর্ম। এগুলো খুব কমপ্লিকেটেড এবং ডেলিকেট ক্রিটিকাল ইলনেস যা চিকিৎসা করার জন্য বিশেষ ভাবে ট্রেইন্ড সুপারস্পেশিয়ালাইজড ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিনে ট্রেইন্ড ডাক্তার লাগবে।
একটা রোগীকে ভেন্টিলেটর এ দেবার সময় যারা তাকে ইনটিউবেট করবে তারা ভাইরাস এরোসল (বাতাসে ভাসমান) দিয়েও সংক্রামিত হবার জন্যে খুব হাই রিস্কে। আর ভেন্টিলেটরে কোন রোগী থাকলে রোগীকে নড়াচড়া করার সময় ক্ষণিকের জন্য হলেও ভেন্টিলেটর ডিস্কানেক্ট হয়ে কেবল নার্স, চিকিৎসক, ওয়ার্ডবয় নয় অন্যান্য রোগীও এই ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত হয়ে যেতে পারেন।
আবারও বলি, চায়না তাদের সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি ক্ষমতা/ভেন্টিলেটর/বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক/আইসিইউ নার্স উহানে পাঠিয়েছে আইসিইউ সাপোর্ট এর জন্য। এই করেও ওরা এমনকি ৫০ শতাংশ আইসিইউ রোগীকেও বাঁচাতে পারেনি।
ইতালি আর যুক্তরাষ্ট্রের ইনিশিয়াল নাম্বার গুলো আরো খারাপ। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার আরও অনেক বেশি। এই লেভেলের এআরডিএস রোগীদের সিংহভাগ ইতালি, ব্রিটেন, আমেরিকা, স্পেন বাঁচাতে পারছে না । বাংলাদেশের আইসিইউতেতে এরা বাঁচবে না। কিন্তু এরা নিজে তো মারা যাবেনই, সাথে আরো কিছু নার্স চিকিৎসক রোগীকে ইনফেক্ট করে দিয়ে যাবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভেন্টিলেটর একটা খুব পাওয়ারফুল মেশিন, এটার ব্যবহার ইনভেরিএবলি ফুসফুসের গভীর ক্ষতি করবে। এটা নিরাপদে ব্যবহার করার জন্য অভিজ্ঞতা আর ট্রেইনিং এর কোনো বিকল্প নেই।
আপনারা ১০০০ ভেন্টিলেটর বানাবেন কিন্তু এই যন্ত্র দিয়ে ক্ষতি না করার পরিবর্তে উপকার করার মতো চিকিৎসক ট্রেইনিং ও অভিজ্ঞতা আপনারা রাতারাতি কিভাবে তৈরি করবেন?
আসুন আমরা বাকি ৯৫% এর কথা বলি যাদের বাঁচানো যাবে কিন্তু যাদের জন্য ভেন্টিলেটর লাগবে না। ওদের খালি লাগবে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন এর সরবরাহ এবং সেই সরবরাহটা খুব সহজেই নিশ্চিত করা যায়।
লেখক পরিচিতি : বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত এবং ট্রেনিং প্রোগ্রামের পরিচালক। মেডিসিনের (রেসপিরেটরি এবং আইসিইউ) সহযোগী অধ্যাপক। ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান।

আরও ৫ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ৪১
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১৭। এছাড়া নতুন করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও ৪১ জন। মোট শনাক্ত সংখ্যা এখন ১৬৪। নতুন শনাক্তদের মধ্যে ২০ জন ঢাকার এবং ১৫ জন নারায়ণগঞ্জের। তাদের মধ্যে পুরুষ ২৮ জন এবং নারী ১৩ জন।-বাংলানিউজ
নতুন করে আর কেউ সুস্থ হয়ে ওঠেনি। করোনা আক্রান্ত ৪১ জনের মধ্যে পুরুষ ২৮ জন, মহিলা ১৩ জন। বয়স বিভাজন এর ক্ষেত্রে ১০ বছর নিচে একজন। ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে চারজন, ২১ থেকে ৩০ মধ্যে ১০ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে পাঁচজন, ৪১ থেকে ৫০ বছরে মধ্যে ৯ জন, ৫১ থেকে ৬০ এর মধ্যে রয়েছেন সাতজন, ৬০ বছরের উপরে রয়েছে ৫ জন।
করোনা আক্রান্ত ৪১ জনের মধ্যে ২০ জন ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার। এছাড়া ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে ১৫ জন, কুমিল্লায় একজন, কেরানীগঞ্জে একজন, চট্টগ্রামে একজন শনাক্ত হয়েছে। নতুন মৃত পাঁচজনের মধ্যে চারজন পুরুষ ও একজন নারী। এদের মধ্যে ৬০ বছরের উপরে দুইজন, ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে রয়েছে দু’জন, ৪০ থেকে ৫০ এর মধ্যে রয়েছে একজন। এদের মধ্যে দু’জন ঢাকার, বাকি তিনজন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার। মঙ্গলবার (৭ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনলাইন ব্রিফিংয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এ তথ্য জানান।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট