চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

খালেদার মুক্তি মিলতে পারে প্যারোল কিংবা দণ্ড স্থগিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১০:০৮ অপরাহ্ণ

জামিনে কারামুক্তি পেতে আইনি লড়াইয়ে আবারও ব্যর্থ হয়েছেন কারাবন্দি বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তবে হাইকোর্ট জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেও এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগের পাশাপাশি প্যারোল (বিশেষ ব্যবস্থায় সাময়িক মুক্তি) ও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকারের বিশেষ বিবেচনায় দণ্ড স্থগিত করে তার মুক্তির পথ খোলা রয়েছে। তবে বিএনপির চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা জানান, তারা কোন পথে যাবেন তা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার করা জামিনের আবেদনটি গতকাল প্রত্যাখ্যান করে হাইকোর্ট। বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে চেয়ে করা জামিনের আবেদনটিতে কোনো সারবত্তা নেই জানিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে তা প্রত্যাখ্যান করে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। সূত্র : দেশ রূপান্তর

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা দুটি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন গত এপ্রিল থেকে কারা কর্তৃপক্ষের অধীনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আদেশে হাইকোর্ট বলেছে, খালেদা জিয়া যদি মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যাডভানসড ট্রিটমেন্ট (উন্নত চিকিৎসা) নিতে সম্মতি দেন তাহলে দ্রুত তার উন্নত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। এছাড়া উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে মেডিকেল বোর্ড চাইলে নতুন কোনো বিশেষজ্ঞকেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে বলে আদেশ দিয়েছে আদালত।

সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসনের কারামুক্তি প্রশ্নে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা ও গুঞ্জনের মধ্যে উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদনের ওপর শুনানি শেষে এ আদেশ হলো। খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমদ ও জয়নুল আবেদীন। এছাড়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির সময় আদালতে সরকারপন্থি ও বিএনপিপন্থি বিপুলসংখ্যক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। এদিকে একের পর এক আইনি লড়াইয়ে দৃশ্যত ব্যর্থ ও হতা খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, হাইকোর্টের এ আদেশের মধ্যে দিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার কারামুক্তির পথ আরও বিলম্বিত হলো। নিকট ভবিষ্যতে তিনি জামিনে কারামুক্তি পাবেন সে সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। তবে প্যারোল (বিশেষ বিবেচনায় সাময়িক মুক্তি) কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারা অনুযায়ী সরকারের নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত করে কারামুক্তির পথ খোলা রয়েছে তার সামনে। যদিও এ ধরনের বিশেষ পদ্ধতিতে কারামুক্তি নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতা, দলটির আইনজীবীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার কারামুক্তির প্রশ্নের বিষয়টি এখন রাজনৈতিক ‘সমঝোতা’ ও রাজনৈতিক ময়দানের সিদ্ধান্তের বিষয় উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ ব্যবস্থায় কারামুক্তির বিষয়টি তার পরিবারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।’ উভয়পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, হাইকোর্টের এ আদেশের অনুলিপি প্রকাশ হলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদনের সুযোগ থাকছে।

বিস্তারিত জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘খালেদা জিয়ার যে শারীরিক অবস্থা তাতে এই মুহূর্তে তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু কারামুক্তি প্রশ্নে এই মুহূর্তে আইন অঙ্গনে কিছু করার নেই। এখন এটি রাজনৈতিক ময়দানের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার খালেদা জিয়াকে “গিনিপিগ” বানিয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করতে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে যেটি মনে হচ্ছে, যেহেতু আইনি প্রক্রিয়ায় কিছু করার নেই তাই সরকার এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের সিদ্ধান্তের ওপর তার কারামুক্তি নির্ভর করছে। সেটি প্যারোল বা দণ্ড স্থগিত করে হতে পারে।’

প্রসঙ্গত, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালত খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়। গত বছর ৩১ জুলাই খালেদার জামিনের আবেদন খারিজ করে হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের এ আদেশ বাতিল ও জামিন চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করলে গত বছর ১২ ডিসেম্বর সে আবেদনটিও খারিজ হয়ে যায়। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে বলা হয়, খালেদা জিয়ার সম্মতি থাকলে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে দ্রুত ‘অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্ট’ দিতে হবে। এরপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ফের জামিন চেয়ে আবেদন করেন খালেদা জিয়া।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট জানতে চেয়েছিল মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী তিনি (খালেদা জিয়া) অ্যাডভান্স চিকিৎসার জন্য সম্মতি দিয়েছেন কি না, দিয়ে থাকলে চিকিৎসা শুরু হয়েছে কি না এবং চিকিৎসা শুরু হলে সবশেষ শারীরিক অবস্থা কী? বিএসএমএমইউকে প্রতিবেদন আকারে জানানোর নির্দেশের পর গতকাল সকালে শুনানির শুরুতে আদালতের কাছে তা হস্তান্তর করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর। প্রতিবেদনে বলা হয়, খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য কোনো সম্মতি দেননি। এতে আরও বলা হয়, তিনি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও অস্টিও আর্থ্রাইটিস (প্রতিস্থাপনজনিত হাঁটুর ব্যথা) রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আর্থ্রাইটিসের বিষয়ে অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্ট (উন্নত চিকিৎসা) প্রয়োজন হলেও তিনি সম্মতি হননি। যে কারণে এ বিশেষ চিকিৎসার জন্য যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার, সেগুলোও করা যাচ্ছে না।

গতকাল প্রতিবেদনের ওপর আংশিক শুনানি শেষে দুপুর ২টায় আদেশের জন্য রাখে আদালত। দুপুরে ফের শুনানি নিয়ে আদেশে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘অবশ্যই তাকে (খালেদা জিয়া) মনে রাখতে হবে যে তিনি একজন বন্দি। একজন দ-প্রাপ্ত আসামি। একজন সাধারণ মানুষ যেভাবে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চিকিৎসা নিতে পারে একজন বন্দি তা পারেন না। কারাবিধি ও নিয়মনীতি অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে এবং দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ আদালত আরও বলে, ‘যে প্রতিবেদনটি বিএসএমএমইউ হাসপাতাল থেকে পাঠানো হয়েছে, সেখানে বিস্তারিতভাবে রোগের বিবরণ দেওয়া আছে। চিকিৎসার একটি পরিকল্পনাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়া তার চিকিৎসার জন্য সম্মতি দেননি। যেহেতু এখন পর্যন্ত তিনি সম্মতি দেননি, তাই উন্নত চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।’ বিচারক বলেন, ‘আমরা নতুন এ আবেদনে জামিনের নতুন কোনো কারণ পাইনি। তাই আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা হলো।’

এদিকে বিএনপির চেয়ারপারসনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা আইনজীবী। আমরা আগে আইনি বিষয়টি দেখব। আইনিভাবেই মোকাবিলার চেষ্টা করব। এমন পরিস্থিতিতে কী করণীয় তা আইনজীবী প্যানেল বসে সিদ্ধান্ত নেব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারের হাত অনেক লম্বা। তাই আমাদের আরও অনেক ভাবতে হবে যে কী করা যায়। আর প্যারোল একটি ভিন্ন বিষয়, এ বিষয়ে তার পরিবারই সিদ্ধান্ত নেবে।’

অন্যদিকে হাইকোর্টের আদেশের প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল গুলশানে তার আবাসিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্ট গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেই এ আদেশ দিয়েছেন। যেহেতু তিনি (খালেদা জিয়া) উন্নত চিকিৎসার সম্মতি দেননি তাই আদালত বলেছেন তাদের কিছু করার নেই।’ দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘বিচারক বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জামিন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে হাইকোর্টের এ আদেশটি তারা চ্যালেঞ্জ করে ও জামিন চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারবেন।’

দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ক্ষমতাসীন দলের প্রথম সারির কয়েকজন নেতা বলে আসছেন, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তির আবেদন করলে সরকার তা ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করবে।

২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালত খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদ- দেয়। সাজা বাতিল চেয়ে একই বছরের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিল করেন তিনি। এটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাকে পাঁচ বছর কারাদ- দেয় আদালত। পরে উভয়পক্ষের আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ মামলায় তার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করে। আইনিপন্থায় কারামুক্তি পেতে খালেদা জিয়াকে দুটি মামলাতেই জামিন পেতে হবে।

এদিকে আইনজীবীরা বলছেন, প্যারোল নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকলেও এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নীতিমালা রয়েছে। ২০১৬ সালের জুনে জারি করা সেই নীতিমালা অনুযায়ী, বন্দিদের নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিংবা নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ বা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তির প্রয়োজন দেখা দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দিকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে। নীতিমালায় প্যারোলের এ সময়সীমা ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না বলা হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস ও বৃদ্ধি করতে পারবে। আইনজীবীরা বলছেন, নীতিমালায় বন্দির দোষ স্বীকারের কোনো বিধান নেই। আইনজীবীরা জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী কোনো অপরাধের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে সরকার যেকোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয় সেই শর্তে দণ্ডকার্যকরীকরণ স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারে। তবে এজন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হলে দণ্ডদানকারী সংশ্লিষ্ট আদালতের মতামত নিতে হবে।

জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্যারোল সম্পূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এটি যেকোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হতে পারে বা সরকারের আদেশে এর মেয়াদ কমবেশি হতে পারে। আর দোষ স্বীকার কিংবা ক্ষমা চেয়ে প্যারোলে কারামুক্তির বিষয়টি সঠিক নয়। সরকারের যারা এ কথা বলছেন এটি তাদের অজ্ঞতা। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে যারা প্যারোলে কারামুক্তি পেয়েছিলেন তাদের কেউই দোষ স্বীকার কিংবা ক্ষমা চেয়ে প্যারোল পাননি। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারা অনুযায়ী সরকার শর্তহীনভাবে বেগম খালেদা জিয়ার কারামুক্তির আদেশ দিতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের অনেক ক্ষমতা। আমাদের দাবি আগে তার (খালেদা জিয়া) সুচিকিৎসা হোক। তাকে কারামুক্তি দিন।’

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট