চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কনটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড সিনেমা

মুঘল-ই-আজম রূপালি ফিতেয় লেখা মহাকাব্য

শান্তা মারিয়া

২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

নর্তকীর প্রেমে পড়েছেন যুবরাজ। সম্রাজ্ঞী বানাতে চান তাকে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় বংশমর্যাদা, সমাজ ও পরিবার। এই তিনের আক্রমণে রচিত হয় প্রেমের সমাধি। ইতিহাসের তেমন কোনো ভিত্তি নেই। নিছকই এক কিংবদন্তি। এই কিংবদন্তিকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে বলিউডের মহাকাব্য ‘মুঘল-ই-আজম’। এটি বলিউডের শতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ছবি। এ ছবির সংলাপ, সংগীত, অভিনয়, সেট, রূপসজ্জা, কাহিনি, প্রযোজনার বিপুল ব্যয় এবং পরিচালনাÑসব কিছুর মধ্যেই রয়েছে মহাকাব্যিক দ্যোতনা।
পরিচালক কে আসিফ ‘মুঘল-ই-আজম’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন চল্লিশের দশকের শুরুতে। মুঘল বাদশাহ আকবরের ছেলে শাহজাদা সেলিম এবং রাজসভার নর্তকী আনারকলির প্রেমের কিংবদন্তিকে ঘিরে নাট্যকার ইমতিয়াজ আলি একটি মঞ্চ নাটক লেখেন ১৯২২ সালে। ‘সেলিম ও আনারকলি’ নামের এই নাটকটি মঞ্চে জনপ্রিয়তা পায়। তখন নির্বাক ছবির যুগ। জনপ্রিয় মঞ্চ নাটকটির ভিত্তিতে নির্মাতা আরদাশির ইরানি ‘আনারকলি’ নামে একটি ছবি তৈরি করেন ১৯২৮ সালে। ১৯৩৫ সালে ছবিটি আবার মুক্তি পায় শব্দসংযোজনসহ। বেশ দর্শকপ্রিয়তা পায় ছবিটি। চল্লিশের দশকের শুরুতে যখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে এবং ভারতে প্রচুর গোরা সৈন্য এসেছে, তখন ছবির বাজার রমরমা। সে সময় প্রযোজক শিরাজ আলি এবং তরুণ পরিচালক কে.আসিফ পরিকল্পনা করেন যে, সেলিম-আনারকলির কাহিনী নিয়ে বড় প্রেক্ষাপটে বড় বাজেটের একটি ছবি বানাবেন তারা। এ জন্য আমানুল্লাহ খান, ওয়াজাহাত মির্জা, কামাল আমরোহি এবং এহসান রিজভিকে দায়িত্ব দেয়া হয় চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখার। ছবির শিল্পীও স্থির করা হয়। চন্দ্রমোহন, ডি. কে.সাপ্রু ও নার্গিসকে নেয়া হয় আকবর, সেলিম ও আনারকলির ভূমিকায়। ১৯৪৬ সালে বোম্বে টকিজ স্টুডিওতে ছবির কাজ শুরু হয়ে যায়।
কিন্তু এরই মধ্যে বদলে যায় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ইংরেজের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সারা দেশ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যায়। প্রযোজক শিরাজ আলি চলে যান পাকিস্তানে। ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালে চস্ত্রমোহন আকস্মিক হৃদরোগে মারা যান।। ছবির অন্যতম চিত্রনাট্যকার কামাল আমরোহি নিজেই ছবিটি পরিচালনা করতে উদ্যোগী হন। কিন্তু কে আসিফ এটা জানতে পেরে তাকে নিষেধ করেন। কারণ ‘মুঘল-ই- আজম’ একান্তভাবে তারই স্বপ্ন।
পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আবার শুরু হয় ‘মুঘল-ই-আজম’-এর কাজ। এবার প্রযোজক হন ধনী ব্যবসায়ী শাপুরজি পাল্লোনজি। এই পার্সি ব্যবসায়ী ভদ্রলোক চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে একেবারেই যুক্ত ছিলেন না। শুধু বাদশাহ আকবর ও তার ছেলে শাহজাদা সেলিম বা জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে আগ্রহের কারণে তিনি এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে রাজি হন। নতুনভাবে অভিনয়শিল্পী স্থির করা হয়। আকবর, সেলিম ও আনারকলির ভূমিকায় এবার চূড়ান্ত হন পৃত্থিরাজ কাপুর, দিলিপ কুমার ও মধুবালা। ১৯৫৩ সালে শুরু হয় ছবির কাজ। দীর্ঘ সময় এবং বিপুল অর্থ ব্যয় হয় এর নির্মাণে। ছবিটি নির্মাণে প্রায় ২০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় হয় যা সে যুগের হিসেবে ছিল অবিশ্বাস্য। এই অর্থব্যয় নিয়ে প্রযোজক ও পরিচালকের মধ্যে বেশ দ্বন্দ্ব চলে। আর্থিক সংকটে ছবির কাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। পাশাপাশি মানসিক দ্বন্দ্বও চলছিল কলাকুশলীদের মধ্যে। দিলিপ কুমারের বোনকে বিয়ে করেন কে আসিফ। তাদের দুজনের মধ্যে বেশ মনোমালিন্য ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত দেখা দেয়। দিলিপ কুমার ও মধুবালার সম্পর্কের টানাপড়েনও প্রতিফলিত হয় ছবির কাজে। ছবিটি যখন শুরু হয় তখন দিলিপ-মধুবালার প্রেম চলছে। ছবির নির্মাণের শেষ পর্যায়ে তাদের প্রেম ভেঙে যায়।
ছবির প্রথম দিকে দেখা যায় সন্তান লাভের জন্য ধর্মগুরু সেলিম চিশতির খানকা শরিফের দিকে হেঁটে চলেছেন বাদশাহ আকবর। রাজস্থানের মরুভূমিতে খালি পায়ে সম্রাট আকবরের হেঁটে চলার দৃশ্য শুটিং করার সময় পায়ে ফোস্কা পড়ে পৃত্থিরাজ কাপুরের।
কাহিনীতে দেখা যায় দরবারের নৃত্যশিল্পী আনারকলির সঙ্গে শাহজাদার বিয়েতে রাজি হন না আকবর। এ নিয়ে পিতা-পুত্র সংঘাত এবং এক পর্যায়ে বিদ্রোহী পুত্রের সঙ্গে যুদ্ধ। যুদ্ধের দৃশ্যে ভারি বর্ম পরে অভিনয় করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন দিলিপ কুমার।
আর আনারকলিরূপী মধুবালা তো অসুস্থই ছিলেন। তার হৃদরোগ ছিল। স্টুডিওর বদ্ধ পরিবেশে শুটিংয়ের সময় একাধিকবার অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ছবির নির্মাণের শেষ পর্যায়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু কাজটি শেষ করার জন্য তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর।
সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন নওশাদ। তার জীবনের সেরা কাজ ছিল ‘মুঘল-ই-আজম’। গীতিকার ছিলেন শাকিল বাদ্যায়ানি। ছবির ১২টি গানে কণ্ঠ দেন লতা মুঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি ও শাস্ত্রীয় ধারার অন্যান্য শিল্পী। ‘আয়ে মোহাব্বত জিন্দাবাদ’ গানে কোরাসে প্রায় শতাধিক শিল্পী অংশ নেন। গানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও লোকসংগীতের সুর ব্যবহার করা হয়।
সেট নির্মাণ করা হয়েছিল মুঘল দরবারের আদলে। প্রপস তৈরির জন্য সারা ভারত থেকে সেরা কারুশিল্পীদের আনা হয়। জারদৌসী কাজ করা পোশাকে সত্যিকারের সোনা ও রূপার জরি ব্যবহার করা হয়। শিল্পীদের ব্যবহৃত অলংকারগুলোও ছিল সত্যিকারের সোনার তৈরি। সেগুলো তৈরি করেছিলেন হায়দ্রাবাদের স্বর্ণকাররা। রাজস্থানের কর্মকাররা লোহার বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করেন। মহারানি যোধা বাইয়ের পূজার দৃশ্যে সত্যিকারের সোনার তৈরি কৃষ্ণমূর্তি ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধের দৃশ্যের জন্য ব্যবহার করা হয় ২০০০ উট, ৪০০ ঘোড়া ও ৮০০০ সৈন্য।
‘মুঘল-ই-আজম’ মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। মুক্তির পর পরই দর্শকদের ঢল নামে প্রেক্ষাগৃহগুলোতে। এটি ভারতীয় সিনেমাজগতের সব অতীত রেকর্ড ভেঙে ফেলে। মুঘল-ই-আজমকে বলা হয় সর্বকালের সেরা ব্যবসাসফল ছবি। সাড়ে পাঁচ কোটি রুপি আয় করে সে সময়। এমনকি ২০০৪ সালে এটি যখন ডিজিটালভাবে রঙিন করে আবার মুক্তি দেয়া হয় তখনও এটি ব্যবসাসফল হয়।
‘মুঘল-ই- আজম’-এর সংলাপ ছিল অনবদ্য। এত যেন কাব্যের সুষমা মাখানো ছিল। দিলিপকুমার ও মধুবালা তাদের জীবনের সেরা অভিনয় উপহার দেন এই ছবিতে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট