চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

আমার প্রিয় বাবা ধ্বনিবিজ্ঞানী

মুহম্মদ আবদুল হাই

হাসিন জাহান

১৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:১১ পূর্বাহ্ণ

গত শতকের নভেম্বরের ২৬ তারিখে আমার বাবা মুর্শিদাবাদের মরিচা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবছরে তাঁর মৃত্যুর ৫০ বছর (৩রা জুন) এবং নভেম্বরে তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হবে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে কোনো আলোচনা বা পত্রিকায় লেখালেখি হয়নি সে কথা হয়তো বলা যাবে না, তবে তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বা তেমন উল্লেখ্য কিছু নয়। দুএকটি ব্যতিক্রম থাকতেও পারে। তবে তা সামান্য। আমার স্মৃতি থেকে এখানে বাবার সামান্য দু-এক’টা কথা উল্লেখ করতে চাই।

আমার বাবাকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে আমার কাছে যে দিকটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সেটা শুধু তাঁর মেধাই নয়, তাঁর গবেষণা ও শিক্ষকোচিত ছাত্র-প্রীতি ও পা-িত্য এবং বিভাগের প্রতি দরদ ও ভালবাসা তথা তাঁর সাংগঠনিক কর্মকা-, তাঁর যে সব দিকগুলির কথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন।
আমার বাবা অল্পবয়সে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দায়িত্ব লাভ করেন। সেটা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সাহেবের অবসর গ্রহণের সময় (১৯৫৪)। তখনই তাঁর নাম যথেষ্ট সুনামের সাথে প্রচারিত হয়েছির। কারণ, বাবা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্রদরে মধ্যে সর্বপ্রথম অনার্স এবং এম.এ.তে প্রথম শ্রেণী লাভ করে রবীন্দ্রনাথেরও প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন। লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়েও তেমনি ডিসটিংশন লাভ করেছিলেন তাঁর দ্বিতীয় এম.এ.(১৯) এবং নাসিক্য ধ্বনি সম্পর্কিত অভিসন্দর্ভের জন্য (১৯৫৩)। তাঁর সেই অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘অ চযড়হবঃরপ ধহফ চযড়হড়ষড়মরপধষ ঝঃঁফু ড়ভ ঘধংধষং ধহফ ঘধংধষরংধঃরড়হ রহ ইবহমধষর’. (প্রকাশ : ১৯৬০) অভিসন্দর্ভটির কারণে তিনি এই দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হন দুটি বিশেষ কারণে। যতদূর আমি জানি, এই অভিসন্দর্ভের আগে কোনও ভারতীয় ভাষার ধ্বনির যান্ত্রিক কোনও বিশ্লেষণ হয় নি। অর্থাৎ এভাবে ধ্বনির বৈজ্ঞানিক আলোচনা এবং এত বিস্তৃত ও সফল বিশ্লেষণও দেখা যায় নি। এছাড়া এই বিশ্লেষণটি অন্যান্য সমধর্মী ধ্বনির আলোচনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক স্বরূপ ছিল। তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ফার্থ সাহেব। তিনি একটি নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন, যাকে তিনি বলেছিলেন ধ্বনির ছন্দবিশ্লেষণ তত্ত্ব। আমার বাবা এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করে তাকে আরও এগিয়ে নিয়েছিলেন। এই জন্য ফার্থ সাহেব আমার বাবাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া সমকালীন ধ্বনিবিজ্ঞানীরাও (যেমন ঐ লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ের ঐ বিভাগের এবং আমেরিকার কয়েকজন বিখ্যাত প-িত) তাঁকে প্রশংসা করেছিলেন। এমন কি যাঁরা মার্কিন পন্থি যেমন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, তিনিও বাবার থিসিসের আলোচনা ও তার পদ্ধতির সমালোচনা করেও প্রশংসা না করে পারেন নি। আমার বাবার এই বইয়ের এবং তাঁর অন্যান্য অবদানের কথা আজহারউদ্দীন খান, কলকাতা ন্যাশনাল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক ও বিখ্যাত সমালোচক নচিকেতা ভরদ্বাজ, সৈয়দ মুজতবা আলী, মুহম্মদ এনামুল হক প্রমুখ প-িতগণ যে আলোচনা করেছেন, এবং আচার্য সনীতিকুমার, সুকুমার সেন প্রমুখ ভারতীয় প-িতজন যে মন্তব্য পাঠিয়েছেন, তাতে শুধু আমরা কেন বাঙ্গালি হিসাবে সকলেরই গর্ভ হতে পারে।

অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই পঞ্চাশ দশকে শুধু বাংলা বিভাগেরই প্রধান ছিলেন না, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও সমগ্র দেশের একজন সর্বজনমান্য শিক্ষাগুরু ও সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট অভিভাবকতুল্য ব্যক্তিত্বও ছিলেন। ধ্বনিবিজ্ঞান তথা ভাষা গবেষণায় তিনি শীর্ষখ্যাতি অর্জন করেছিলেন, আবার প্রশাসক ও সংগঠক হিসাবেও তিনি বাংলা বিভাগের সুনাম বৃদ্ধি করে সুধীমহলে বিশেষ সম্মানের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিভাগের পঠন-পাঠনের উন্নয়নে এবং ছাত্র ও শিক্ষকগণের মধ্যে গবেষণার প্রতি আগ্রহ সঞ্চারণে তিনি যে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন তা পরে আর তেমনটি দেখা যায় নি। বিশেষত এই সিলেবাস রক্ষা ও প্রসারের ক্ষেত্রে সরকারের সাথে তাঁর যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল তা অত্যন্ত কৌশলে মোকাবেলা করে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সেদিন রক্ষা করে ইতিহাসে অমর হওয়ার মতো কাজের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এটা যাঁরা জানেন, কেবল তাঁরাই তার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারবেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র হাত থেকে তিনি বিভাগের দায়িত্ব পান। সেই প্রসঙ্গ এলে একদিন রাতে খাবার টেবিলে আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বাবাকে বলতে শুনেছি, “দেখো আমার বাংলা বিভাগকে শুধু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েই নয়, সারা পূর্ব পাকিস্তানে এক নাম করা বিভাগ করে গড়ে তুলবো।” প্রকৃতই তিনি সেই লক্ষ্যেই কাজও শুরু করেছিলেন। তিনি যখন বিভাগে আসেন, তখন বিভাগটি প্রায় শিক্ষক শূন্যই ছিল বলতে গেলে। তিনি ঐকান্তিক চেষ্টা করে বিভাগের পঠন-পাঠনের বিষয়ে যেমন বিপ্লব ঘটিয়েছেন, তেমনি দেশের বাঘা বাঘা শিক্ষকদেরও সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন তিনি বাংলা বিভাগে। এই বিভাগের মত এত সংখ্যক এত ভাল শিক্ষক আর কখনও কোনো বিভাগে দেখা যায় নি। বলা চলে পঠন-পাঠন এবং শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এই বাংলা বিভাগ শুধু আদর্শই হয়ে ওঠে নি, এখানে প্রাচীন মঠতুল্য বিদ্যাচর্চার ঐতিহাসিক কেন্দ্র কিংবা রেনেশাঁসতুল্য এক জাগরণী পরিবেশপূর্ণস্থান হয়ে উঠেছিল। ব্রজেন্দ্রকুমার দেবনাথ (ব.কু.দে.), মুনীর চৌধুরী, কাজী দীন মুহম্মদ, আহমদ শরীফ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, আমিনুল ইসলাম, সনজিদা খাতুন, রফিকুল ইসলাম, আনোয়ার পাশা, আনিসুজ্জামান, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, অজিত গুহ, ইদ্রিস আলী, প্রমুখ তুল্য ব্যক্তিত্বের একত্র সমাবেশ আর কে কবে কোথায় দেখেছে? এর পরেও তিনি তুখোড় তরুণদের মধ্য থেকেও কয়েকজনকে বেছে নিয়েছিলেন যারা পরিবর্তিত সুনামের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মনসুর মুসা, সৈয়দ আকরাম হোসেন, আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং আহমদ কবীর, প্রমুখ কয়েজন। এরা সকলেই হয়তো তখনও নিয়মিত শিক্ষক হন নি, তবে গবেষণা সহায়ক এবং গবেষক হিসাবে ছিলেন কেউ কেউ। হুমায়ুন আজাদও তখন বিভাগে আসে নি; না এলেও বাবার অধীনে কিছুদিন রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। এঁরাই ছিলেন এই বিভাগের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মর শিক্ষক।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি কতটা আন্তরিক ও সনিষ্ঠ ছিলেন সেটা বোঝা যায় বিশেষভাবে মুনীর চৌধুরী স্যারকে নির্বাচন ও তাঁকে বিভাগে আনার জন্য ত্যাগ স্বীকারের ক্ষেত্রে। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ছিলেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। সেখান থেকে বাংলা বিভাগে তাঁকে আনা সহজ ছিল না। কিন্তু বাবা ভেবেছিলেন তাঁর মত এমন ইংরেজি সাহিত্যে অধিকারী প-িত, আবার বাগ্মী এবং সমালোচনা ও অনুবাদে দক্ষ একজন শিক্ষক বাংলা বিভাগের ছাত্রদের খুবই প্রয়োজন। এ জন্যে মুনীর চৌধুরী যখন ভাষা আন্দোলনের ফলে জেলে যান, তখন আমার বাবা তাঁকে বাংলায় এম.এ. পরীক্ষা দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং জেলের ভিতর প্রয়োজনীয় বই পুস্তুক পাঠিয়ে তাঁকে পরীক্ষা দেওয়াতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। এ ছাড়াও সে সময় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস চেন্সেলার (ড. জেনকিন্স) এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ (মি. টার্নার)-এর সাথে বাবাকে অনেক দেন দরবার করতে হয়েছিল বিষয়টা নিয়ে।
আগামী সংখ্যায় সমাপ্য

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট