চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

বিলুপ্তির পথে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

১৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:১১ পূর্বাহ্ণ

একটি জাতির নিজেস্ব সংস্কৃতি হচ্ছে তার জাতিগত প্রকৃত পরিচয়। নিজেস্ব সংস্কৃতিই হচ্ছে ওই জাতির ঐতিহ্য। হাজার বছরের বাঙালি জাতির সংস্কৃতি আমাদের পরিচয় বহন করে। বাঙালি জাতির সংস্কৃতির মূল পটভূমি হচ্ছে গ্রাম। হাজার বছরের গ্রামীণ সংস্কৃতি হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। এই ডিজিটাল যুগে, আধুনিকায়ন ও বিশ্বায়নের প্রভাবে গ্রাম গুলো এখন আর গ্রাম নেই। কালের বিবর্তনে ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি হুমকির মুখে। বর্তমানে গ্রামে গিয়েই পাওয়া যায় না, সেই ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতি। ইতিমধ্যেই হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির অনেক কিছুই বিলুপ্তির পথে আবার অনেক কিছুই প্রায় বিলুপ্ত। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী অনেক গুলো লোকজ খেলা এখন প্রায় বিলুপ্ত। এইসব বিষয়ে আমাদের খুব বেশি একটা মাথা ব্যথা নেই। বই পুস্তকে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলোর নাম পাওয়া গেলেও বর্তমানে অধিকাংশ খেলার প্রচলন নেই। সরকারি ও বেসরকারি ভাবে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির লোকজ খেলাগুলোর বিকাশে তেমন একটা উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, তারা তাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করতে সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্ট আয়োজন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ্য যোগ্য হচ্ছে কাবাডি, কুস্তি, ঘোড়া দৌড়, লাঠি খেলা, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানো প্রভৃতি। এই ইভেন্টগুলো তাদের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এতে করে এসব খেলার প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এছাড়াও তাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নিজেস্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। এছাড়াও বিশেষ এসাইনমেন্ট ও ব্যবহারিক ক্লাসের ব্যবস্থা করে খেলাগুলোর সাথে পরিচয় করানো হয়। শিশু-কিশোরদের মননশীল উন্নয়ন ও মেধাবিকাশে খেলাধুলার কোন বিকল্প নেই। তবে আমাদের দেশে সম্পূর্ণভাবে উল্টো চিত্র। আগে যদিও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় খেলাধুলায় কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া হলেও বর্তমানে সেটা আর দেখা যায় না। সরকারি ভাবে হাতেগোনা কিছু খেলায় স্বল্প পরিমাণে পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও যা খেলাগুলোর সম্প্রসারণে অতি নগণ্য। বইয়ের পাতায় বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা গুলোর নাম পাওয়া যায় কিন্তু চর্চা নেই। সত্যি কথা বলতে, আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা গুলো নিয়ে কারো তেমন আগ্রহ নেই।

বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ লোকজ খেলাগুলোর মধ্যে কুতকুত, কড়ি খেলা, লুডু, সাত চারা, ধাপ্পা, রস-কষ, ঘুড়ি ওড়ানো, পাশা খেলা, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, বউচি, এক্কাদোক্কা, এচিং বিচিং, এলাটিং বেলাটিং, কানামাছি, দাড়িয়াবান্ধা, মার্বেল খেলা, মাটিম খেলা, ষোল গুটি, কাবাডি, নুুুনতা খেলা, পুতুল খেলা, চড়ুইভাতি, ব্যাঙের বিয়ে, লাঠি খেলা, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়া দৌড়, নৌকা বাইচ, বলি খেলা প্রভৃতি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য। এইসব খেলা এক সময় অনেক বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় ছিল। এছাড়াও আরো অনেক গ্রামীণ লোকজ খেলা আছে। বর্তমানে এইসব খেলার চর্চা না থাকার কারণে অধিকাংশ খেলা এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম ঘরে বসে প্রযুক্তির আধুনিক খেলা খেলে ও কার্টুন দেখে বিনোদন করে। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলার সাথে তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। অধিকাংশ শহুরে বাচ্চারা এইসব খেলার নাম পর্যন্ত জানে না। গ্রামের বাচ্চারাও শহুরে বাচ্চাদের মতোই প্রযুক্তির আধুনিক খেলা নিয়ে ব্যস্ত। তারাও এখন লোকজ খেলা গুলো থেকে বহুদূরে সরে গেছে। যদি এভাবেই চলতে থাকে, অদূর ভবিষ্যতে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির কম্পিউটার বা মোবাইল গেমস ও দেশে প্রচলিত বিদেশি খেলাগুলো থেকেও অনেক বেশি মজার খেলা হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা। আমাদের গ্রামীণ লোকজ খেলাগুলোর অধিকাংশ খেলার মাঝে আছে অনেক মজার মজার ছড়া ও গান। এই খেলাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে সুন্দর ভাবে তুলে ধরতে পারলে, তারা খেলাগুলোতে আকৃষ্ট হয়ে সহজেই রপ্ত করে নিবে এবং প্রাণবন্ত বিনোদন পাবে। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা গুলো বাঁচিয়ে রাখতে এখনি সময় ভালো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা। নতুন প্রজন্মের প্রাইমারি বা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলার সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সেই জন্য সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষের এগিয়ে আসতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করে ছিলাম। আমি ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে কিছু পরামর্শ প্রদান করে ছিলাম। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার পরামর্শের প্রসংশা করলেও কেউ কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে নাই। অনেকটাই নিরাশ হয়ে শিশু একাডেমির একজন পরিচালকের কাছে গিয়ে বিস্তারিতভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করি। তিনি আমাকে আস্বস্ত করেছিলেন, এই বিষয়ে উনারা উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তারপর আমি উনার সাথে আরো দুই একবার এই বিষয়ে যোগাযোগ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ছিলাম।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে খুব সুন্দর ও আকর্ষণীয় ভাবে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো তুলে ধরতে পারে। এছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারে। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো যেন স্কুল পর্যায়ে চর্চা করা হয়, এই বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারে। প্রতিটি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো রাখতে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো এগিয়ে আসতে পারে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ লোকজ খেলাগুলো নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা মূলক ইভেন্ট আয়োজন করতে পারে। আমরা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে গানের, নাচের, অভিনয়ের সহ বিভিন্ন মেধা ভিত্তিক ইভেন্ট আয়োজন করতে দেখি। বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা গুলো নিয়ে এমনিভাবে কিছু ইভেন্ট আয়োজন করলে খেলা গুলো আবারো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম বিদেশি খেলার পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর দিকে ধাবিত হবে। এতে করে আবারো গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলোর সুদিন ফিরে আসবে। সর্বোপরি, এই দেশ আমাদের এবং দেশের লোকজ সংস্কৃতি আমাদের ঐতিহ্য। যদি দেশকে ভালোবাসি, তাহলে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থাকবেই। সেই ভালোবাসা থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট