চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

নোবেল সাহিত্য পুরস্কার সমাচার!

ড. মাহফুজ পারভেজ

১৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:২৪ পূর্বাহ্ণ

১.
নোবেল পুরস্কার যেন হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে। শান্তি আনতে পারে নি যারা, তারা পাচ্ছে শান্তি পদক। গণহত্যার দোসর ও নৈতিক সমর্থনকারী পাচ্ছে সাহিত্য পুরস্কার। বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার মোটামুটি মান বজায় রাখলেও শান্তি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে কলুষিত হচ্ছে। বিশেষ করে চলতি ২০১৯ সালে শতবর্ষের অধিক ঐতিহ্যের এই পদকের স্খলন হয়েছে মারাত্মকভাবে।

বিশ্বব্যাপী চরম প্রতিক্রিয়াও হয়েছে এ নিয়ে। জাপান এ সমালোচনাট দিক দিয়ে সবচেশে এগিয়ে। জাপানের পত্র-পত্রিকাগুলো সাহিত্যে নোবেল বিষয়ে অনেকগুলো বিচিত্র শিরোনাম করেছে। একটি শিরোনাম দারুণ বিতর্ক জন্ম দিয়েছে। শিরোনামটি ছিল দুইজন ‘বিদেশি’ সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন।
‘বিদেশি’? প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক। উত্তরও রয়েছে জাপানিদের কাছে। কারণ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ব্যাপারে জাপানিরা খুবই রেগেছে। ‘বিদেশি’ শব্দটি লিখে খোঁচা দিয়ে দুনিয়াকে বুঝিয়েছে যে তারা নাখোশ। কারণ, জাপানের সাহিত্য জগত প্রস্তুত হয়ে ছিল হারুকি মুরাকামির নোবেল উদ্যাপনের জন্য। মুরাকামি নোবেল পেলেন না। তাই এই ক্ষুব্ধতা!
কানাডার মার্গারেট অ্যাটউড এই বছর নোবেল পাচ্ছেন ধারণাটিও সমান সমান পোক্ত ছিল। সেইজন্য কানাডার সাহিত্যমহলও উদযাপনের জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। পাবলিক লাইব্রেরিসহ ম্যাকনালি, চ্যাপ্টার, ইন্ডিগো ইত্যাদি গ্রন্থকেন্দ্রের সাহিত্য আখড়াগুলোর বেশির ভাগেরই অগ্রিম বুকিং হয়ে গিয়েছিল এই সপ্তাহে।

অ্যাটউডের নোবেল না পাওয়ায় ঘটনা হতাশা ও বিরক্ত কানাডিয় পত্রপত্রিকাকে না রাগিয়ে বরং অনুসন্ধিৎসু করেছে। ছোট শহরের পত্রিকাগুলোও চমৎকার ইতিবাচক সব শিরোনাম করছে। বুঝার চেষ্টা করেছে এবং পাঠকদের জানানোর চেষ্টা করেছে দুইজন ইউরোপিয় সাহিত্যিকের নোবেল অর্জনের যৌক্তিক দিকগুলো আদৌ কী কী?
গণমাধ্যমগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধরে ধরে দেখাচ্ছে যে এবারের পুরস্কারের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুসংবাদ রয়েছে। সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ চিন্তার দুইজন লেখক একই বছরে নোবেল পুরস্কার পেলেন। এটি তো খুবই ভাল কাজ হয়েছে! পিটার হ্যাঙ্কির রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং ওলগা তোকার্কজুকের উদারনৈতিক ভাবনার সাহিত্যকর্মকে পাশাপাশি রেখে পাঠ করলে ইউরোপের সমসাময়িক যুগসন্ধিক্ষণ-যন্ত্রণার তুলনামূলক চিত্রটি পাঠকের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। উইনিপেগের মত ছোট শহরের গণমাধ্যমও ইতিবাচক ও অর্থবোধক শিরোনাম করেছে ‘ঞড়ি ঘড়নবষ ষরঃবৎধঃঁৎব ঢ়ৎরুব রিহহবৎং বীঢ়ড়ংব ঊঁৎড়ঢ়ব’ং ভধঁষঃ ষরহবং’
অথচ জাপানি পত্রিকাগুলোর বেশ কয়েকটিই সমালোচনা করে লিখেছে দুই বিপ্রতীপ চিন্তার লেখক কীভাবে একই পুরস্কার পায়? যৌক্তিকতা কী? এসব নোবেল কমিটির ফালতু সিদ্ধান্ত! ইত্যাদি।
গণস্টাইলের সমালোচনার সংগে জাপানি সমালোচনার আশ্চর্য মিল। জাপানি প্রতিক্রিয়ার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে ‘এসিয়ান মাইন্ডসেট’ বলে কিছু একটা থাকলেও থাকতে পারে! আরো মনে হচ্ছে কানাডিয়রা আসলেই কানাডিয়, অন্যদের চাইতে ভিন্ন। প্রতিবেশি মার্কিন মুল্লুকের চেয়েও ভিন্ন। বেশ কিছু মার্কিন পত্রিকায়ও জাপানি পত্রিকার মত ‘কীভাবে সম্ভব, কেমনে সম্ভব?’ ধরনের সমালোচনা ছেপেছে।

আসলেই দেশের চরিত্র বড় নিয়ামক। মানুষের জাতীয় চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক ভাবনার জন্য ইতিবাচক দেশ লাগে। সমালোচনাও যে যৌক্তিক ও ইতিবাচক হতে পারে, এ কথাটিও শেখার দরকার আছে। তবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার যে নিজেই নানা ধরনের ব্যঙ্গ, বিদ্রƒপ ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, এটাই সার সত্য।

২.
সমালোচনার উদ্ভব হয়েছে নোবেল কমিটির কার্যকলাপের কারণে। কেননা, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ১১৮ বছরের ইতিহাসে প্রথম ঘটল ব্যাপারটা। একই সাথে দুই বছরের নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের নাম ঘোষণা করা হলো। পুরস্কৃত হয়েছেন অস্ট্রিয়ান ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার পিটার হ্যান্ডকি এবং পোলিশ লেখিকা ওলগা তোকারচুক। যেখানে ২০১৮ সালেরটা পেয়েছেন ওলগা এবং ২০১৯-এর নোবেল বরাদ্দ হয়েছে পিটারের নামে।
এই ব্যতিক্রমী ছন্দপতনের পেছনে অবশ্য ভয়াবহ কারণ আছে। গত বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। তারও আগে ২০১৭ সালের যৌন হয়রানির অভিযোগ এবং গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের পদত্যাগের ঘটনা সুইডিশ একাডেমিকে বেশ ঝাঁকি দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে এ বছর সাহিত্যে নোবেল পাওয়া দুই সাহিত্যিক মোটেও জনপ্রিয় নন। তাদের নিয়েই রয়েছে তীব্র সমালোচনা। বিশেষত, একজন তো একেবারেই নিন্দিত পর্যায়ের।

৩.
তবে অপেক্ষাকৃত অবিতর্কিত তোকারচুককে ২০১৮ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সঙ্গে দেওয়া হয়েছে একটি কৈফিয়ত। যাতে বলা হয়েছে, “একটি বর্ণনামূলক কল্পনা জন্য, যা সর্বব্যাপী আবেগের সাথে বাধা অতিক্রমকে জীবনের ছাঁচ হিসাবে উপস্থাপন করেছে, তা এ লেখকের কৃতিত্ব।” সদ্য নোবেল পুরস্কারের জন্য আলোচ্য তোকারচুকের জন্ম ১৯৬২ সালে পোল্যান্ডের সোলেহও-তে। বর্তমানে তিনি ভ্রোকলভ-এ বসবাস করছেন। খুব তরুণ বয়স থেকেই সাহিত্যে তার পদচারণা। তার পিতামাতা উভয়েই ছিলেন শিক্ষক। তদুপরি তার বাবা বাড়তি দায়িত্ব স্বরূপ ছিলেন স্কুলের লাইব্রেরিয়ান।
ফলে বইপড়ার সুবিধা পেয়েছেন তোকারচুক। হাতের কাছে পাওয়া সম্ভাব্য সব বই-ই তিনি অবাধে পড়েছেন। তার কৃতিত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে নোবেল একাডেমিই সেকথাও দাবি করেছে।
তার মাইলফলক হয়ে থাকা লেখা হিসাবে মূলত গণ্য করা হয় তার তৃতীয় উপন্যাস ‘চৎরসবাধষ ধহফ ঙঃযবৎ ঞরসব’। বইটি কোনো এক পৌরাণিক স্থানে একটি পরিবারের আখ্যান। নোবেল একাডেমি তার মাস্টারপিস বলে বর্ণনা করতে এনেছেন অন্য একটা নাম ‘দ্য বুক অব জ্যাকব’। অষ্টাদশ শতকের এক নেতা, যাকে তার অনুসারীরা নতুন মেসিয়াহ বলে মনে করে। গ্রন্থটি নাইকি পুরস্কার লাভ করে। বলে রাখা ভালো, এই পুরস্কার পোল্যান্ডের সম্মানজনক সাহিত্য স্বীকৃতি; যাকে পোলিশ বুকার বলেও আখ্যা দেওয়া হয়।
খুব বেশি অনূদিত হয় নি এবং আন্তর্জাতিক পাঠক বিশেষ জানেন না, এমন একজনই তিনি, যিনি নোবেল কমিটির ভাষায় “বর্ণনারভঙ্গির ব্যঞ্জনাপূর্ণ, সাবলীল এবং কবিত্বময়তার” জন্য পুরস্কৃত হলেন। বোদ্ধা সমালোচকরা জানেন, এমন মানের লেখক পৃথিবীতে অন্তত শত শত আছেন। তবু তিনিই পেলেন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার।

৪.
এ কথা অনেকের পক্ষে বিশ্বাস করা কষ্টকর যে, ২০১৯ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী পিটার হ্যান্ডকে। কেন এই ক্ষোভ ও ঘৃণা, তা তার জীবন ও কর্ম থেকে বিলক্ষণ টের পাওয়া যায়।
তাকে পুরস্কৃত করার কারণ হিসাবে নোবেল কমিটি বলেন, “তার ভাষাগত অকপটতার জন্য, যা তুলে এনেছে মানুষের অভিজ্ঞতার পরিধি এবং নির্দিষ্টতা।” তার উল্লেখযোগ্য কাজ বলে নোবেল কমিটির দাবি ডধষশ ধনড়ঁঃ ঃযব ঠরষষধমব নামে টক এবং জবঢ়বঃরঃরড়হ উপন্যাস। তার লেখাগুলোতে অস্তিত্বের উৎস খোঁজার এক বিরামহীন অভিযাত্রা ফুটে উঠেছে। অ ংড়ৎৎড়ি ইবুড়হফ উৎবধসং তার ছোট এবং সূক্ষ্ম বই হলেও খুব শক্তিমান সৃষ্টি বলে স্বীকৃত। একজন মায়ের আত্মহত্যা নিয়ে আখ্যান এগিয়ে গেছে।
এসব বয়ানে সঙ্গে তার জীবনী মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। হ্যান্ডকের বর্তমান বয়স ৭৬। ১৯৪২ সালে দক্ষিণ অস্ট্রিয়ার গ্রিফেন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মা ছিলেন স্লোভানিয়ান সংখ্যালঘু গোত্রের মেয়ে আর বাবা জার্মান যোদ্ধা। পিতার সাথে তার যোগাযোগ হয় পরিণত বয়সে। শৈশব কাটে মা এবং সৎ পিতার সাথে। গ্রিফেনে আসার আগে পর্যন্ত প্রথম জীবন কেটেছে যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া বার্লিনে।

হ্যান্ডকি পড়াশোনা করেন অস্ট্রিয়ার গ্র্যাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সমাপ্ত করতে পারলেন না। পড়ালেখায় আর মনোযোগ ছিল না বলাই বোধ হয অধিক যৌক্তিক হবে। কয়েক বছরের মাথায়ই লেখেন তার প্রথম উপন্যাস উরব ঐড়ৎহরংংবহ, যা প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। ১৯৯০ সালের পর থেকে জীবনযাপন শুরু করেন দক্ষিণ-পশ্চিম প্যারিসের এক শহরে।
তার কাজগুলো সাহিত্যের কোনো নির্দিষ্ট শাখায় সীমাবদ্ধ নয়। উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রনাট্যসহ অন্যান্য অনেক শাখায় কাজ করেছেন। রাজনীতিতে জড়িয়ে থেকেছেন। ১৯৯০-তে ন্যাটো কসোভো যুদ্ধের সময় সার্বিয়ায় আকাশপথে যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে হামলা চালালে তিনি তার বিরোধিতা করেছেন। সার্বিয়ান নেতা ও গণহত্যাকারী স্লোবোডান মিলোসেভিকের মৃত্যুতে তার দেওয়া বাণীও বেশ আলোচিত। যুদ্ধের সময় গণহন্তারক সার্বদের পক্ষ হয়ে কথা বলার জন্যেও তার সমালোচনা করা হয়। ফলে তার পুরস্কারপ্রাপ্তি মানবতাবাদী শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তার বিরুদ্ধে বসনিয়া ও কসোভোতে বিক্ষোভ মিছিলও হয়েছে। অতএব তার সম্পর্কে যত কম বলা যাবে, ততই মঙ্গল।

বরং এ কথা বলে শেষ করা যেতে পারে যে, নোবেল সাহিত্য পুরস্কার এমনই অবক্ষয়, স্খলন ও সমালোচনামুখর পতনের মুখোমুখি যে, ভাবীকালে এই পুরস্কার পাওয়া সম্মানের বদলে অসম্মান ও দালালির প্রকাশ্য প্রতীকে পরিণত হতে পারে। কে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, তা জানার বদলে মানুষ জানতে চাইবে কে কে এই পুরস্কার পান নি, বা পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাদের নাম। এবং এদের প্রতিই মানুষ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট