চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রবীন্দ্রচিন্তায় মৃত্যুর নান্দনিকতা

বীরেন মুখার্জী

৯ আগস্ট, ২০১৯ | ১:২০ পূর্বাহ্ণ

‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।/ মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,/রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট/ তাপবিমোচন করুণ কোর তব/মৃত্যু অমৃত করে দান’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রথম প্রভাতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলেই আহ্বান করেছিলেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে ‘মরণ’ কবিতায়। আবার, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’ (পূজা-২৪৮)-গানটির আলোকে সহজে অনুমান করা যায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তায় নান্দনিকতার সফল উপস্থিতি আছে। অসীম প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে যেমন বিশ্বস্বীকৃতি এনে দিয়েছেন, তেমনি তার চিন্তার স্তরে স্তরে যে মানবকল্যাণের বিচিত্র দিক প্রতিফলিত, রবীন্দ্র-গবেষণায় এসব দিকও উঠে এসেছে। তবে সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে রবীন্দ্রনাথকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ধারণ-লালন করতে হয়েছে। বালক বয়সে মায়ের মৃত্যু এবং পরবর্তীতে সন্তান ও স্ত্রীর অকাল মৃত্যু এর মধ্যে অন্যতম। মৃত্যুর মতো বেদনাবহ ঘটনা যেখানে সমগ্র মানব সত্তাকে উলোট-পালট করে দিতে সক্ষম, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একান্ত স্বজন হারিয়েও নিজেকে স্থির রেখেছিলেন। তবে কাব্য-সাহিত্যে কবির ‘মৃত্যু-দর্শন’ নানা অনুষঙ্গে বিকশিত ও সমন্বিত হওয়া থেকে উপলব্ধ হয়, তারও অন্তঃস্থলে প্রচুর ভাঙচুর চলেছে। যতই তিনি বেদনাবহ ঘটনাগুলো সসম্মানে আত্মস্থ করে উপেক্ষা করুন না কেন। নিজের জন্মদিনের আড়ম্বর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লিখেন- ‘খ্যাতির কলবরমুখর প্রাঙ্গণে আমার জন্মদিনের যে আসন পাতা রয়েছে, সেখানে স্থান নিতে আমার মন যায় না। আজ আমার প্রয়োজন স্তব্ধতায় শান্তিতে।’ আবার, নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে ‘মৃত্যু’ কবিতায় বলেন-
‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর/আজি তার তরে/ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে/এত ভালোবাসি/বলে হয়েছে প্রত্যয়/মৃত্যুরে আমি ভালো/বাসিব নিশ্চয়’
অস্বীকারের সুযোগ নেই, ‘মৃত্যু’ এমনই এক বাস্তব সত্য যে, মৃত্যু সম্পর্কে বিশ্বাসের কোন প্রয়োজন পড়ে না। যদিও মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা উঁকি দিয়ে কিংবা যন্ত্র দিয়েও অনুভবযোগ্য নয়, বিধায় বিষয়টি নিয়ে নানা কথা-চিন্তন উঠে আসাও স্বাভাবিক। মানুষ সবচাইতে বেশি ভয় করে মৃত্যুকে। তাই সব সময় মৃত্যুকে এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াতে চায়। তবুও মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করে কোনও উপায় নেই মানুষের।
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু নিয়ে অনেক ভেবেছেন। ‘অল্প বয়স থেকেই মৃত্যুবিরহ কাতর হৃদয়ের একটি আর্তনাদ, এই দুঃখস্বর প্রশ্নরূপে উত্থিত হয়েছে বার বার কিন্তু পরিণত বয়সে বিশেষ করে বিদায়ের কয়েক বছর পূর্ব থেকে মৃত্যু সম্বন্ধে বহু কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ-সেগুলি কেবল প্রশ্ন নয়, মানুষের চির-নিরুত্তর কিছু প্রশ্নের উত্তরও তার মধ্যে রয়েছে।’ একবার কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভের পর একখানা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘মৃত্যুর ভিতর দিয়ে ফিরে আসা সকলের ভাগ্যে ঘটে না। যদি ঘটে, তবে অন্তত তখনকার মত অহমিকা শিথিল হয়ে আসে কতখানি স্থায়ী হয় বলতে পারিনে। প্রিয়জনের মৃত্যুর পর বৈরাগ্য আসে নিজের মৃত্যুর সময় দেখি যে সব জিনিস অত্যুক্তি করেছে। মৃত্যুর ব্যথা দেখে তাকে যেন অশ্রদ্ধা না করি।’ মৃত্যু বেদনা মানুষকে ক্ষণিকের জন্য হলেও পৃথিবীর প্রতি অনাসক্ত করে তোলে- এ বাস্তবতা ফুটে উঠেছে কবির কথায়। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হওয়া উচিত নয় বলে তিনি উপদেশ দিয়েছেন। সুতরাং রবীন্দ্রমানসে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার এই প্রত্যয় এবং ব্যঞ্জনা মূলত মৃত্যুচেতনায় সৌন্দর্য অবলোকনের নন্দিত প্রয়াস বলা যেতে পারে।
কবির অধিকাংশ কবিতা এবং গানে পরমাত্মায় নিবিষ্ট হওয়ার গভীর আকুতি প্রতিভাত। পরমপুরুষের সান্নিধ্য লাভের মধ্য দিয়েই কবি যে পরম সুখের সন্ধান করেছেন তা অনন্ত জীবনেরই ইঙ্গিতবাহী। ‘রবীন্দ্রনাথ বিশ্বতানকে জীবন গানে মেলাবার চেষ্টা করেছেন। তিনি রচনা করেছেন দুঃখের গান যা শুনে মানুষের মন অনন্তর পানে ধেয়ে যায়।’ এই অনাবিল অনন্তের ধারা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থায় পর্যবসিত। তিনি বলেন-
‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।/সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।/কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার/হৃদয়প্রান্তে, হে জীবন নাথ, শান্ত চরণে এসো।
জীবনকে আটকে রাখা যাবে না, এই পরম সত্যকে বার বার উপলব্ধিতে এনে রবীন্দ্রনাথ তার রচনায় যে মৃত্যুদর্শন এঁকেছেন, তা কালক্রমে হয়ে উঠেছে নান্দনিক এক জীবনদর্শন। তিনি লিখেছেন, ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।’ তিনি স্বাভাবিকভাবে ঝরে যাওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন লেখায়। এ সব সত্য কবি জীবন দিয়ে বুঝেছেন। তাই তিনি মৃত্যু সম্পর্কে সানাই-এর ‘ক্ষণিক’ কবিতায় লিখেছেন- ‘এ চিকন তব লাবণ্য যবে দেখি/মনে মনে ভাবি একি/
ক্ষণিকের পরে অসীমের বরদান/আড়ালে আবার ফিরে নেয় তারে/দিন হলে অবসান।’
‘রবীন্দ্রনাথের বিশাল প্রতিভার পরিব্যাপ্তি সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্র-গবেষকরা বলেছেন, বিশ্বকবির রচনায় পাশ্চাত্যের রবার্ট ব্রাউনিং-এর শিল্পময় দার্শনিক উপস্থাপনা, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ এবং লর্ড বাইরনের জীবনমুখীন বাস্তবতা, তরুণ কবি জন কীটসের অনিঃশেষ সৌন্দর্যচেতনা, উইলিয়ম ওয়ার্ডসোয়ার্থের পরিশুদ্ধ প্রকৃতির প্রতি অনাবিল আস্থা ও প্রেম এবং পার্সি বিশি শেলীর অতীন্দ্রিয় সত্তার গূঢ় রহস্যময়তা মিলেমিশে এক স্পর্শকাতর অনুভূতিতে অপূর্ব সমন্বয়তা লাভ করেছে।’ সুতরাং কেবল বাংলাসাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বসাহিত্যেও তাকে যোগ্য সম্মান দেয়া হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, কবি যতই পরিণতের দিকে ধাবমান হয়েছেন ততই তার চিন্তার ব্যাপ্তি ও গভীরতাও বেড়েছে। মৃত্যু সম্পর্কে ধারণারও পরিবর্তন ঘটছে। গীতিমাল্যের কবিতায় ইন্দ্রিয় জগত ও ইন্দ্রিয়াতীত জগতের জিজ্ঞাসা ও প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। কবির জিজ্ঞাসা-‘ওগো পথিক, দিনের শেষে/যাত্রা তোমার কোন্ সে দেশে,/এ পথ গেছে কোন খানে?’
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে জীবনের অপর নাম আখ্যা দিয়েছেন। ইন্দ্রিয়াতীত বিভিন্ন জিজ্ঞাসার আলোকেও তা স্পষ্ট। মৃত্যুকে তিনি অনন্ত জীবনের যাত্রাপথে পরমাত্মীয়ের মতো নতুন নতুন জীবনপথের অনুসন্ধানদাতা হিসেবে উপলব্ধি করেছেন। কখনো দেখেছেন মহাকালের মহামিলনদূত হিসেবে। কবির মানসসরোবরে উপলব্ধির বর্ণচ্ছটায় যার নিগূঢ় সত্তা রহস্যময়তার আবরণ পরে, চাক্ষুষ বাস্তবতা অতিক্রম করে, বিশেষকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে নির্বিশেষ। আবার পরক্ষণেই নির্বিশেষ থেকে বিশেষের স্তরে নেমে এসেছে ব্যক্তিসত্তা হয়ে, ঠিক যেন প্রণয়িনী রাধিকার শ্যামরূপী অমৃতের উৎস। বৈশ্বিক দর্শন আত্মস্থ করার মধ্যদিয়েই কবির চেতনায় ও পৃথক দর্শনে একান্ত অন্তরঙ্গতা লাভ করেছে চিরায়ত এই মৃত্যু। জীবন ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে নিজস্ব উপলব্ধির নিরবচ্ছিন্ন উৎসারণ থেকেও তার মৃত্যুচিন্তার নান্দনিকতা স্পষ্ট।
উপনিষদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা মনে করেন, ‘এই জগৎ সেই মৃত্যুহীন শাশ্বত সত্তার আনন্দ সম্মিলনের মহাপ্রকাশ। বিশ্বসৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষহীন বলে যা কিছু বিরাজিত আছে, তাদের সবই সেই চিরসুন্দর, চিরশুদ্ধ অমরনাথের আনন্দময় অভিব্যক্তি। বিশ্বের সব সৌন্দর্য, পার্থিব জগতের সঞ্চিত সমস্ত সুধা তার থেকে সৃষ্ট বলেই অবিনাশী। অনাদিকাল ধরে নানা রূপে বিকশিত। জীবনপ্রবাহ তাই মৃত্যুহীন। হে অমৃতের অমর সন্তান, এই পরম সত্য জ্ঞাত হয়ে অমৃততত্ত্ব লাভ করো’। রবীন্দ্রনাথ জীবন এবং বিশ্বসৃষ্টির সুগভীর এসব তাত্ত্বিক দর্শন পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করেছেন। আর অনন্যসাধারণ শিল্পময়তায়, অতীন্দ্রিয় সত্তার প্রগাঢ় রহস্যময়তায় চিত্রায়িত করেছেন। মৃত্যুচিন্তার ভেতর থেকেও মৃত্যুর নান্দনিক দিকটির উন্মোচন ঘটিয়েছেন।
“কিশোর বয়সে বন্ধুপ্রতিম বৌদি কাদম্বরী দেবীর অকালমৃত্যু ও আরো পরে স্ত্রীর মৃত্যু এবং একে একে প্রিয়জনদের মৃত্যুর নীরব সাক্ষী ও মৃত্যু শোক রবীন্দ্রনাথের এক অনন্য অভিজ্ঞতা লাভে সহায়ক হয়েছিল। কবি জীবনস্মৃতিতে ‘মৃত্যু শোক’ পর্যায়ে অকপটে লেখেন, ‘জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার ওপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড়ো মনোহর।” ফলে মরণের শতধারায় ধৌত হয়েই জীবনের সংকীর্ণতা, অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্তি ঘটে, অন্তরের আনন্দরস মৃত্যুর বিচ্ছেদবেদনা থেকে উৎসারিত হয় বলে মানুষ তাতেই উপভোগ করে শাশ্বত অমৃতের পরশলাভ- কবির এই বিশ্বাস অমূলক নয়।
অকাট্য সত্য যে, এই দেহ মানবজীবনের সর্বাপেক্ষা মহার্ঘ্য ও রহস্যঘেরা আধার; এর সাথে যোগ হয়েছে প্রকৃতি এবং মন। এই যে দেহ, প্রকৃতি ও মন; এই দেহ যখন মৃত তখন তা জড় আর যখন জীবিত তখন তা অজড়; যে অলীক বস্তুর অনুপস্থিতিতে দেহ জড় পদার্থে পর্যবসিত হয় সেই অলীক বস্তুর ধারণা থেকে ‘আত্মা’ বিষয়ের সূচনা এবং তা এক সময় সর্বপ্রাণবাদের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে। ‘মৃত্যু কিংবা নিদ্রা হইতেই প্রাগৈতিহাসিক মানুষ আত্মা নামক এক অতিপ্রাকৃত বস্তুর অস্তিত্বের সন্ধান পাইয়াছিল। জীবিত ও মৃতের মধ্যে পার্থক্য কী? একজনের মধ্যে কিসের অভাব তাহাকে জড়ের মতো নিশ্চল করিল, আর একজনের মধ্যে কিসের অস্তিত্ব তাহার ব্যতিক্রম করিল? গুহাবাসী মানুষ একদিন এ কথাই ভাবিতে গিয়া এক অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করিল। এই অদৃশ্য শক্তিই আত্মা।’ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনেও প্রেক্ষণবিন্দুতে আছে একটি বোধ; তা হলো- মৃত্যু তার শোক ও দুঃখের মাধ্যমে জীবনের- সত্যের, মুক্তির ও শক্তির ত্রয়ীরূপকেই ফুটিয়ে তোলে। সুতরাং সুখের মতো দুঃখকেও স্বাগত জানাও, স্বাগত জানাও জীবনের মতো মৃত্যুকেও। এই চেতন-প্রক্রিয়া মৃত্যুর মাঝেও নান্দনিক অনুভবের ইঙ্গিতবাহী। রবীন্দ্রনাথ যাপনের অতলস্পর্শী হৃদয়মুখরতার গাম্ভীর্য থেকে খুঁজে এনেছেন মহিমান্বিত নান্দনিকতা। আবার সেই নান্দনিকতার কোলেই তিনি বস্তুত একা হয়েছেন, প্রাণময়ী উষ্ণতায় মেলে ধরেছেন জীবনের সহস্ররঙ। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দর্শন’ এর মতো তার ‘মৃত্যু-দর্শন’ও গুরুত্বপূর্ণ। বোধ করি, জীবনের প্রতিটি মাধুর্যম-িত মুহূর্তেই তিনি পরম মমতায় মৃত্যুর অনিবার্য শূন্যতাকে উপলব্ধি করেছিলেন; তাই ছিন্নপত্রাবলীতে তিনি লিখেছেন- ‘ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞানভারে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই।’
রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি মানবকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন বলেই হয়তো স্বজন বিয়োগ বেদনা বা মৃত্যুবেদনা থেকে উত্থিত জীবনবিমুখতা তার কাছে হয়তো স্বার্থমগ্নতারই অন্য এক রূপ। তিনি বলেন- ‘মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ, তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই’, কিংবা, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই- কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই’। ‘প্রিয়জনদের নানারকম দুঃখ-সওয়া এবং দুঃখ-দেওয়া অকালমৃত্যুগুলি প্রত্যেকটিই একটিমাত্র প্রশ্ন করে বসে আছে রবীন্দ্রনাথের মনে- মানুষের জীবনে দুঃখের ভূমিকা কি?’ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তিনি দুঃখকে বুঝতে সক্ষম হন। যে কারণে কবির ভাবনায় মৃত্যু কখনো প্রণয়ী, বাউল, কখনো বা বালিকা বধূর বর বেশে, সখা সেজে বন্ধুরূপে, অন্ধকারের ধ্যাননিমগ্ন ভাষার মতো অবগুণ্ঠনের আবরণ পরে, অরুণবহ্নির রুদ্র সাজে, জীবন রথের সারথি হয়ে, ললিত লোভন মোহন রূপে কিংবা জ্যোতির্ময়ের পরশমণি হয়ে ধরা দিয়েছে। মৃত্যুর সৌন্দর্য আস্বাদন করে তিনি সেই পরম উপলব্ধির অমিয়ধারা ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতা ও গানে, সাহিত্যের নানা শাখায়।
প্রশ্ন জাগে, মৃত্যু যদি সবার জীবনে বিনাশসাধনই ঘটাবে, তাহলে জীবন থেকে জীবনান্তরে এই যে অশেষভাবে পথ চলার সহস্র স্মৃতির আনাগোনা, সেটা কেমন করে সম্ভব? তাই বিনাশসাধন নয়, নিরন্তর চলার জন্যই মৃত্যুর স্পর্শলাভে দেহের খোলস বদলে যায় বারংবার। কারণ এমন বদলেই সম্ভব হয়, নানা রূপ পরিগ্রহের ভেতর দিয়ে বিবিধ বৈচিত্র্যের আস্বাদন- রবীন্দ্রনাথে যার সার্থক উপস্থিতি। মানুষের ভালবাসার অকৃপণ উৎস কবিকে ভালোবাসার অপরাজেয় শক্তি যুগিয়েছে। বিদায় তাকে নিতেই হবে এ সত্য জেনেও তিনি ভালোবাসার কাছে দাঁড়িয়ে লিখেছেন-‘এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি।/এ ভালবাসাই সত্য এ জন্মের দান।/বিদায় নেবার কালে/এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।’
কবির ভাবনা- ‘জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার পরিচয় পেতে হবে। যে মানুষ ভয় পেয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে জীবনকে আঁকড়ে রয়েছে, জীবনের পরে তার যথার্থ শ্রদ্ধা নেই বলে জীবনকে সে পায়নি। যে লোক নিজে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বন্দী করতে ছুটেছে, সে দেখতে পায়, যাকে সে ধরেছে সে মৃত্যুই নয়, সে জীবন’, (ফাল্গুনী, ১৩২২)। রবীন্দ্রনাথ মূলত জীবন অনুসন্ধানের দিকেই গুরুত্বারোপ করেছেন। আর তাই জীবন-মৃত্যুর নিঃশব্দ প্রণয়খেলা কবির কাছে নবজীবন, নবযৌবন লাভের আহ্বান নিয়ে এসেছে। এসেছে নান্দনিক বোধের উৎস হয়ে।
তথ্য সহায়তা: ১. মনসুর আহমদ, প্রবন্ধ: ‘রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দর্শন’,২. ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ: বাংলার লোকশ্রুতি, ৩. ড. আনন্দ দাশগুপ্ত, প্রবন্ধ: ‘মৃত্যুর রূপ’ জীবনে, সৃষ্টিতে’ ও ৪. মধুছন্দা মিত্র ঘোষ, প্রবন্ধ: রবির বৈশাখ, কবির শ্রাবণ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ আগস্ট ২০১৫।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট