চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কবি ও সম্পাদক বেলাল চৌধুরী

ড. মাহফুজ পারভেজ

৩ মে, ২০১৯ | ১:২৩ পূর্বাহ্ণ

২৪ এপ্রিল প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণে মনে পড়ে বেলাল চৌধুরীকে। কবি, লেখক, সম্পাদকের পরিচিতি ছাপিয়ে উষ্ণ, হৃদয়বান, মজলিসি বেলাল চৌধুরী আমাদের কাছে অনেক বেশি স্পষ্ট ও অনন্য হয়ে আছেন মৃত্যুর পরেও।
অদ্ভুত আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল তার। ব্যক্তিগতভাবে উভয় বাংলার প্রায়-সকল কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে ছিল তার নিবিড়তম সংযোগ-সম্পর্ক। মানুষকে আপন করে কাছে টেনে নেয়ার জাদুকরী গুণ ছিল তার আয়ত্তাধীন। সামান্য পরিচয়কে দীর্ঘ দিনের স্মৃতিপটে ধরে রাখতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। তিনি ছিলেন মানবমুখী চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
তখন তিনি ‘ভারত বিচিত্রা’ সম্পাদক, বসেন ধানমন্ডির ২নং সড়কে। আশির দশকের সেই দিনগুলোতে তিনি পেরিয়ে এসেছেন তার জীবনের পশ্চিমবঙ্গ পর্ব। সাপ্তাহিক সন্ধানী’র দিনগুলোও তখন অতীত। একটি দূতাবাসের অবাণিজ্যিক সাময়িকী নিয়ে তখন তার প্রাত্যহিক কাজ-কারবার। কিন্তু কে বলবে, তিনি একটি ডিপ্লোম্যাটিক ভবনের চৌহদ্দীতে? যতবার গিয়েছি, দেখেছি জমজমাট আড্ডা। বারোয়ারী মানুষের ভিড়। লেখা আর ভিসার তদবির চলছে পাশাপাশি। জনসংযোগের এমন ঈর্ষণীয় ক্ষমতা খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।
কত রকম মানুষের কতো রকম বিষয় যে বেলাল ভাই সামাল দিয়েছেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। এসব নানাবিধ কাজ করেও তিনি ‘ভারত বিচিত্রা’কে উচ্চাঙ্গের পত্রিকায় পরিণত করেন। বেলাল ভাই জানতেন, কার হাতে কোন লেখাটি ভালো হবে। কাকে কোন লেখার সুযোগ দিতে হবে। আমাকে দিয়ে চট্টগ্রামে প্রায়-অজ্ঞাতবাসে থাকা সুচরিত চৌধুরীর গল্প, স্মৃতি ইত্যাদি সংগ্রহ করেও ছাপিয়েছেন। এমনই তীক্ষè নজর দিয়ে তিনি দুর্লভ লেখা সংগ্রহ করিয়েছেন।
অফিস ছাড়াও পুরনো পল্টনে তার পুরনো বাড়িতে গিয়েছি, যেখানে তার ছোট ভাই সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী বসবাস করতেন। দুই ভাইয়েরই ছিল বিশাল জনসংযোগ সাম্রাজ্য। হাজার মানুষের শত রকমের তদবিরে চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন অক্লান্ত।
কখনো শাহবাগ, এলিফ্যান্ট রোডে কফি পানের জন্য বসেছি আমরা। সেসব দিন আজকের মতো ভীড়াক্রান্ত ছিল না, ছিল আয়েশী ও সহনীয়। ‘লাটিমী’ নামে একটি খাবার ঘরে আমরা নিয়মিত বসেছি। দোকানটি এখন আর নেই। কিন্তু তার আলাপের তরঙ্গ এখনো তাজা প্রবাহে আচ্ছন্ন করে আমাকে। কত মানুষের কত বিচিত্র তথ্য যে তিনি জানতেন!
পশ্চিমবঙ্গের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের সম্পর্কে বেলাল চৌধুরীর ছিল এনসাইক্লোপেডিক জ্ঞান। একটি উল্øেখযোগ্য সময় কলকাতায় বসবাসের সুবাদে সেখানকার সাহিত্য পরিম-লের যাবতীয় তথ্য ছিল তার নখাগ্রে। নিখুঁত ও নিটোল বিবরণে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিষয়কে তুলে ধরতে পারতেন। কবি বিষ্ণু দে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি রিখিয়া ও উশ্রী নদীর যে নান্দনিক চিত্র উপস্থাপন করেন, তা এখনো আমার স্বপ্নে কড়া নাড়ে।
বেলাল চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার সংগ্রহে ‘প্রাণের পত্রাবলি’ নামে তাকে লেখা দুই বাংলার কবি-লেখকদের পত্রগুচ্ছ সংগ্রহটি আবার হাতে নিয়ে স্মৃতির স্রোতে ভেসে গেলাম। আলাপে-আড্ডায় তিনি যত মানুষের গল্প করেছেন, তারচেয়েও বেশি মানুষের সঙ্গে ছিল তার সখ্য, সংযোগ, সংলাপ ও সম্পর্ক। বেলাল ভাইকে লেখা চিঠির হাত ধরে যেন খুলে গেছে এক-একজন চেনা মানুষের অজানা-অদেখা জগৎ।
বেলাল চৌধুরীর মৃত্যুতে একটি বর্ণময় কালের অবসানই শুধু হয় নি, বৃহত্তর বঙ্গ সাহিত্যের সংযোজক সেতুটিও ব্যথা জাগানিয়া পতন-ধ্বনির আর্তনাদে ভেঙে পড়েছে। তার মতো বর্ণিল মানুষের দেখা খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব হবে না। বহু বহু বছর পর পর বেলাল চৌধুরীর মতো অনন্য মানুষের দেখা পাওয়া যায়। তার প্রথম মৃৃত্যুবার্ষিকীতে বিন¤্র শ্রদ্ধা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট