চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুখের বৃষ্টি

সাঈদুল আরেফীন

৩ মে, ২০১৯ | ১:২৩ পূর্বাহ্ণ

দুরের আকাশ বিশাল আকাশ দেখে আর অশ্রুভেজা চোখে দিনের সময়গুলো পার হয়ে যায় কীভাবে জানে না সোবহান মিয়া। সকালের ¯িœগ্ধ প্রকৃতির সাথে মিতালী করে যাত্রা শুরু যার জীবনের প্রতিটি দিন মাস বছর পেরিয়ে যায়। শ্যামল প্রকৃতি আর আধো আলো ছায়াময় নগরের কোলাহলময় পরিবেশ নিজেকে সঁপে দিয়ে একরাশ স্বপ্ন জিইয়ে রেখেই তার পথচলা। জীবনের নানা অংক কষে নগরীর একটা টিনশেড ঘরই হলো সোবহান মিয়ার দুঃখ-সুখের ভেলা। সেমি পাকা এই ঘরে অনেকটা বছর কাটিয়ে দিলো সোবহান মিয়ার পরিবার। বস্তির পর্যায়ে না পড়লেও অনেকটা সেরকমই। দুই কক্ষের ঘর। দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে শহরের জীবনটা আজ অনেক বছর ধরে কোনমতেই কাটিয়ে দিচ্ছে সোবহান মিয়া। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ যোগাড় করা আর অন্ন সংস্থান করাটাও কঠিন হয়ে যায়। স্বপ্নের আকাশ পাড়ি দিতে গিয়ে অদ্ভুত সব জীবনের সাথে তার হিসেব মেলাতে হয়। ভাগ্যিস বড় ছেলেটা পড়াশুনার পাশাপাশি কষ্ট করে টিউশনিটা চালিয়ে যাচ্ছে বলেই কোনমতে কুলিয়ে নিচ্ছে সংসারটা। আজও ভ্যানগাড়িতে শাকসব্জি ও তরিতরকারি বেচাকেনা করে সন্ধ্যে বেলায় ঘরে ফিরে সোবহান মিয়া। ঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই মনটা জুড়িয়ে যায় সোবহান মিয়ার। একমাত্র কন্যা সায়মার রেজাল্ট বেরিয়েছে আজ। খুব ভালোভাবেই পাশ দিয়েছে মেয়েটা। এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। সায়মা বাবাকে সালাম করতেই সোবহান মিয়া মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কান্না জুড়ে দেয়। বাপ মেয়ের কান্না আর আনন্দাশ্রু কোনমতে থামতে চায় না। একটু পর সোবহান মিয়ার স্ত্রী রাহেলা এসে এক ফোঁটা শীতল বৃষ্টির পরশ বুলিয়ে দেয় বাপ মেয়ের মুখে।
-হয়েছে তো রে মা, এবার থাম! তুমিই কেমন বাপ বলো তো, কোথায় না মেয়ের জন্য মিষ্টি নিয়ে আসবে, তা না উল্টো কান্না করছো ? এটা কী কোন কথা হলো ? দেখো, এবার আমাদের সুখের দিন শুরু হবে। বিজয়ের মাষ্টার্সটা শেষ হলে চাকরী-বাকরি কিছু একটা জুটিয়ে নেবে। রাহেলার কথা শেষ না হতেই ঘরে এসে যোগ দেয় বড় ছেলে বিজয় আর সবার কনিষ্ট সুমন।
মায়ের কথায় বিজয় আবেগতাড়িত হয়ে বলতে থাকে, মা, বাবার কষ্টটা চোখে আর সহ্য করার মতো নয়। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি। অল্পশিক্ষিত হলেও সৎভাবে কোন না কিছু করে আয় রোজগার করে আমাদের সংসারটা টেনে নিয়ে গেছে। তিন তিনটা ভাইবোনকে মানুষ করছে যোগ্যতার সাথে। দেখো মা, সায়মার যে মেধার প্রখরতা সে অবশ্যই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিছু একটা হবেই। আর আমার মাস্টার্সটা কমপ্লিট হতে দাও, দেখবে আমি মিডিয়াতে কোন একটা কাজে লেগে যাবো। মা সত্যিই দেখবে, আমাদেন কোন কষ্ট থাকবে না।
মা ছেলের কথায় বাবা সোবহান মিয়া যেনো আশার আলো দেখতে পায়। সোবহান মিয়া ভাবতে থাকে-সেই কবে গ্রাম থেকে বাবার সাথে রাগ করে এই চট্টগ্রাম শহরে এসে পাড়ি দেয়। অনেক কষ্টের বিনিময়ে যেনো একটু সুখের পরশ গায়ে লাগতে শুরু করেছে। কতো কষ্ট করে সামান্য কেরাগিরি করে, টিউশনি করে নানা ভাবে আয় রোজগার করে সবশেষে ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রি করে সংসার চালিয়ে নিচ্ছে। সোবহান মিয়া মনকে সান্ত¡না দেয় এই ভেবে যে, শত দুঃখ কষ্টের মধ্যে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পারছে। মনে মনে স্ত্রী রাহেলাকেও ধন্যবাদ দিতে কুন্ঠিত হয় না সোবহান মিয়া। সোবহান মিয়ার ভাবনার জানালায় আরো উঁকি দেয়, সেই একাত্তরের দিনগুলির কথা। একাত্তরের কথা ভাবতেই অন্য রকম গা শিউরে ওঠে সোবহান মিয়ার। কী না করেছে পাক হায়েনার দল। রসুলপুর গ্রামের প্রতিটি নারী পুরুষ বলতে কিছুই অস্তিত্ব রাখেনি ওরা। সেই সঙ্গে ওদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছিলে নিজেদেরই চেনা জানা আলবদর রাজাকার সেজে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এখনো কানে বাজছে সোবহান মিয়ার। সেই সাথে মনে পড়ছে গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদরদের দল কতো পরিবারকে নিঃস্ব করেছে। ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দিয়েছে। অনেক বেলা খেয়ে না খেয়ে লুকিয়ে কাটাতে হয়েছে। নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে হয়েছে। গ্রামের
অনেক তরুণ চোখের সামনে অস্ত্র কাঁধে তুলে যুদ্ধে যায়। কেবলই স্বপ্ন ছিলো, পাক হানাদারদের অত্যাচার থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করা। বাঙালির মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন প্রতিষ্ঠা করা। রক্তের নদী বইয়ে দিয়ে বাংলার সূর্য সন্তানরা দেশকে এনে দিয়েছিলো বলেই আজ বুকফুলিয়ে মাথা উঁচিয়ে কিছু তো করে খেতে পারছি। নিজের দেশে সন্তানদের মানুষ তো করতে পারছি। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সোবহান মিয়া অদ্ভুত খেয়ালের জগতে চলে যায়। মাঝে মাঝেই তার এমনটা হয়ে যায়।
কী রে বিজয়ের বাবা? তুমি অমন উদাস হয়ে বসে আছো কেন? খাওয়া দাওয়া করবে না বুঝি? আনমনা সোবহান মিয়াকে আলতোভাবে গায়ে হাত দিয়ে রাহেলা প্রশ্ন করে।
না অনেক কিছু ভাবছি। অনেক কষ্টে গড়া আমাদের এই দেশ। যদিও নিজ দেশে কষ্ট করছি, ছেলেমেয়ে মানুষ হচ্ছে। বিরাট সান্ত¡না তো এই নিজ দেশে আপন মনে মুক্তো হাওয়ায় ঘুরছি শত কষ্টেও। পাক হানাদারদের অত্যাচারের মাত্রা সহজে ভোলার নয়।
-এবার চলোতো খেয়ে নিই।
জীবনের অংক তো শেষ হতে চায় না। ধীরে অতি ধীরে এগোয় স্বপ্ন আর অংকের হিসেব মেলাবার পালা। নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের সেই চেনা ছবিই যেন ধরা দেয় সোবহান মিয়ার পরিবারে। নীতি নৈতিকতার বেড়াজালে টিকিয়ে রাখে জীবনের জটিল অংকের হিসেব। অতি সামান্য রোজগারের মধ্য দিয়ে সুন্দর জীবনের আঙিনায় পা রাখার এক দীর্ঘ সংগ্রামে গা ভাসিয়েছে সোবহান মিয়া। বিন্দু বিন্দু করে সংসারের দুুঃখ যন্ত্রণাগুলো মুছে দিতে চায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে সত্যিকার মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়েই সন্তানরা বেড়ে উঠুক এই আশা নিরাশার দোলাচলে এগিয়ে যায়। একটা সময় এসে সময়ের চাকা কিছুটা হলেও আলোর পথ দেখায়।
দিন গড়িয়ে যায়। একে একে সোবহান মিয়ার দুঃখ কষ্টের পালে সুখের হাওয়া লাগতে শুরু করে। ছেলেমেয়েরা স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। সেই কষ্টকর জীবন জয়ের সংগ্রাম ও শেষ হয়ে আসে। কষ্টের নাওয়া খাওয়ার মধ্যেও যে সুখ আসে সোবহান মিয়ার স্ত্রী রাহেলা সেটা প্রমাণ করে। চাকচিক্য আর আতিশয্যের বাইরেও পারিবারিক নৈতিক শিক্ষার আবরণে ছেলেমেয়েরা একদিন শিক্ষার আদর্শে সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠে। সোবহান মিয়ার পরিবারে সুখের আনন্দাশ্রু ঝরতে থাকে। সায়মা বুয়েটের ট্রিপল ই ডিপার্টমেন্টে চান্স পায়। বিজয় বিসিএসে ভালোভাসে পাস দিয়েছে। সোবহান মিয়ার পরিবারে এভাবেই জীবনের চাকা সুবর্ণ পথেই মোড় ঘুরিয়ে দেয়। যেনো অনেক দিনের প্রখর রোদ পেরিয়ে সুখের এক পশলা বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দেয় ধূসর প্রকৃতিটাকে।

শেয়ার করুন