চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

পবিত্র আখেরী চাহার শোম্বার তাৎপর্য

মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম

১৪ অক্টোবর, ২০২০ | ১:২৯ অপরাহ্ণ

আরবী-চান্দ্রবর্ষ গণনার দ্বিতীয় মাস হলো সফরের শেষ ‘বুধবার’ আখেরী চাহার শোম্বা’ নামে বিশেষভাবে পরিচিত যেমন মহররমের দশ তারিখ ‘আশুরা’ হিসেবে রবিউল আউয়ালের বার তারিখ ফাতিহায়ে দু আয্দহুম হিসাবে রবিউল আউয়াল এগার তারিখ ‘ফাতিহায়ে ইয়াজদাহুম হিসেবে পরিচিত এবং ঐ সব দিবস অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। সুবহানাল্লাহ।
৬৩২ খ্র্রী. ১৮ সফর প্রিয়নবী (সা) গভীররাতে মদিনা মনওয়ারার বিখ্যাত কবরস্থান জান্নাতুল বাকী জিয়ারত করে আপন হুজরা শরীফে ফেরার পথে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভীষণ জ্বর, মাথার যন্ত্রণা এবং পেটের ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে হুজরা শরীফে দ্রুত ফেরেন। প্রিয়নবী ছরকারে দো-আলম নূরে মুজাস্সম অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হবেন এটা কেউ মেনে নিতে পারছিলেন না। কারণ সবারই জানা তিনি মাতৃহেরেম মুবারকে থাকার সময়ই পিতৃহারা হন, তার বয়স যখন তিনবছর তখন মহামারী আকারে মক্কা মুকাররমা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় বসন্তের প্রাদুর্ভাব ঘটে ছয়বছর বয়সে মাতৃহারা হন। দারুন অর্থ সংকটের মধ্যে লালিত পালিত হন। কিন্তু তিনি কোন দিন অসুস্থ হননি। এমনকি মক্কার কুরাইশ কাফিররা তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনসহ তিনবছর অবরুদ্ধ অবস্থায় রাখে পানীয় ও খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। উহুদের যুদ্ধে তাকে নির্মমভাবে লাঞ্ছিত করে তার দান্দানমোবারক শহীদ হওয়ায় প্রচুর রক্তপাত হয়। তবুও তিনি অসুস্থ হননি। তায়েফে গিয়ে লোকজনকে আল্লাহপাকের পথে আহ্বান করায় তায়েফবাসীরা তার মোবারক দেহ পাথর মেরে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। তবুও তিনি অসুস্থ হননি কোন দিন। এমন কি ৬২৯ খ্রি. খায়বারে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র দমন করতে গেলে ‘জয়নব’ নামে এক ইয়াহুদী স্ত্রীলোক সুকৌশলে একটা আস্ত ছাগলের ভুনা গোস্তে বিষ মিশিয়ে তাকে খেতে দিলে তিনি এবং ‘বিশর’ নামে তার এক সাহাবী তা খান। ‘বিশর’ সাথে সাথে মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়েন। কিন্তু আল্লাহপাকের খাছ রহমতে তার মোবারক দেহে (অর্থাৎ হুজুর পূরনুর সা.) বিষ কিছুই করতে পারেনি। সুবহানাল্লাহ।
খায়বায়ে তিনি ইহুদীদেরকে শক্ত হাতে দমন করতে সমর্থ হন। খায়বারে ‘কামুসদুর্গ’ পতনে শেরে খোদা হযরত আলী (ক) বীরত্বের এক অনন্য নজীর স্থাপন করেন। এর পরের বছর তিনি বামাদান মাসে দশ হাজার ছাহাবায়ে কেরামসহ মক্কা, মুকাররমা প্রবেশ করে বিজয়পতাকা উড্ডীন করেন। তখন হতে ইসলামের বিজয়পতাকা সাধিত হলো। ঘোষিত হলো : সত্য সমাগত, মিথ্যা বিতাড়িত, নিশ্চয় মিথ্যা দূর হবার। সূরা বনী ইসরাইল আয়াত, ১৮১)। তাদের আচরণে তুমি দুঃখ পেয়ো না তাদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণœ হয়ো না। মন মরা হইও না দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি মুমিন হও। (পবিত্র আল কোরান)। মক্কা বিজয়ের পরের বছর ৬৩১ খ্রী. রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আক্রমণ প্রতিহত করতে মদিনা মুনওয়ারা হতে ৪২৫ মাইল দূরে অবস্থিত তাবুক অভিযানে গেলেন। এই বছরই হজ্বের বিধান নাজিল হলো। তিনি ওই বছর হজ্বে না গিয়ে হযরত আবু বক্কর ছিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে আমীর করে তাওহিদ ভিত্তিক হজ্বের প্রশিক্ষণ দিয়ে ৩০০ জন ছাহাবীকে হজ্ব করাতে পাঠালেন। তাদের রাওয়ানা করে দেয়ার পর পর সূরা তাওবার ৪০খানা আয়াতে শরীফা নাজিল হলো। প্রিয় নবী (সা) ঐ আয়াতে কারীমাগুলো তিলওয়াত করে শুনানোর জন্য হযরত আলী (কা) কে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে দিলেন। তিনি হযরত আবু বক্কর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর নেতৃত্বে পরিচালিত হজ্ব কাফেলার সহিত মিলিত হলেন।
জুল হুকায়কায় এসে মিলিত হয়ে ইহরাম বাঁধলেন। হজ¦দিবসে সবার সামনে সূরা তাওবার ঐ আয়াতগুলি তেলাওয়াত করে শুনালেন যাতে কাফির মুশরিকদের চার মাস সময় দিয়ে বলা হয়েছে। অতঃপর তোমরা এই জমিনে (মক্কায়) চারমাস কাল থাকতে পারবে। এবং জেনে রেখ তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবেনা। এবং নিশ্চয় আল্লাহপাক সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের লাঞ্ছিত করেন। মহান হজ্বের দিবসে আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা) পক্ষ হতে এটা এক ঘোষণা যে, নিশ্চয় মুশরিকদের সম্পর্কে আল্লাহ দায়মুক্ত এবং তার রাসুলও (সা)। তোমরা যদি তাওবা করো, তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবে না। এবং সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের মর্মন্তুদ সংবাদ দাও। (সূরা তাওরা আয়াত-২-৩)। ৬৩২ খ্রী. প্রিয়নবীর হযরত মুহাম্মদ (সা) এক লক্ষ চল্লিশ হাজার ছাহাবায়ে কিরাম নিয়ে হজ¦ পালন করলেন। এই হজ্ব ইতিহাসে ‘হুজজাতুল বিদা’ হুজ্জাতুল বালাগা, হুজ্জাতুল ইসলাম নামে সমধিক পরিচিত। সুবহানাল্লাহ। বিশেষভাবে এই ‘হুজ্জাতুল বিদা’ বা ‘বিদায় হজ্ব’ বলা হয়। প্রিয় নবী (সা) বিদায় হজ্বের ভাষণে যেসব কথা বলেন তা বিশ্বমানবসভ্যতাকে সত্যিকার মানবিক মূল্যবোধের দিশা দেয়। এই খুৎবা বা ভাষণে তিনি বলেন, ‘কোন জনারবের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন আরবের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন কালোর উপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন সাদার উপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সবাই আদম থেকে আদম মাটি থেকে। সুবহানাল্লাহ।
দীর্ঘ সে ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘তোমাদের সাথে হয়তো আমার আর সাক্ষাৎ হবে না। আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কিতাব ও তার রাসুলের (সা) সুন্নাহ। তোমরা যদি তা আঁকড়ে ধরে থাকো তাহলে তোমরা কোনদিন পথভ্রষ্ট হবে না।’ তিনি দীর্ঘ ভাষণ শেষে সবাইকে আলবিদা জানান আর তখনই নাজিল হলো ইসলামের পরিপূর্ণতা তথা পূর্ণাঙ্গতার ঘোষণা। আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু এরশাদ করেন। “আল-ইয়াউমা আকমালতা লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া আত্মামতু লাকুম নিমাতি ওয়ারা দিয়াতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনা। আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম। আর তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। এবং দ্বীন ইসলামকে সানন্দ অনুমোদন দান করলাম (সূরা মায়েদা, আয়াৎ-৩)। সবাই মনে করেছিলেন, হুজুর (সা) বোধ করি মক্কা মুকাররমা থেকে যাবেন। কিন্তু দেখা গেল তিনি মদিনা মুনাওয়ারা হজ্ব শেষে চলে গেলেন। মদিনা পৌঁছে প্রথম উহুদ প্রান্তরে গিয়ে হযরত আমীর হামজা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মাজার শরীফসহ সব শহীদানের মাজার শরীফ জিয়ারত করলেন। তারপর জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে সবার মাজার শরীফ জিয়ারত করে আপন হুজরা শরীফে প্রবেশপূর্বে মসজিদুন্নববীতে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করলেন। সুবহানাল্লাহ।
তারপর থেকে তিনি যে তার রাফীকুল আলার কাছে ফিরে যাবেন এমন একটি উজ্জ্বল আভা তার চেহারামোবারকে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো। মদীনায় ফিরে আসার দুই মাসের মাথায় ১৮ সফর তিনি গভীর রাতে জান্নাতুল বাকীতে মাজার শরীফ জিয়ারত করে গৃহে ফেরার পথে ভীষণ মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তিনি এই প্রথম শয্যাশায়ী হলেন। সবাই চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। বিষাদের কালো ছায়া নেমে এলো। যেন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়লো। এই রকম অবস্থা। এই সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি হঠাৎ সুস্থ হয়ে উঠলেন। ঈদের আনন্দ নেমে এলো মদিনা মুনাওয়ারায়। ঐ দিন ফজর হওয়ার পূর্বেই শরীর ঘেমে জ্বর ছুটে গেল। মাথা ব্যথা দূর হয়ে গেল। পেটের ব্যথা থাকলো না। তিনি কয়েক ঢোল পানি দিয়ে গোসল করলেন। নাতি হযরত হাসান (আ) ও হোসাইন (আ) কে কোলে তুলে নিয়ে আদর করলেন মাথায় হাত বুলালেন। চারিদিকে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। যেমন আনন্দধারা প্রবাহিত হয়েছিলো যেদিন তিনি দশ বছরপূর্বেই মক্কা মুকাররামা থেকে হিজরত করে এই নগরীতে তশরীফ এনেছিলেন।
এই নগরীতে সবাই তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেই বিখ্যাত কাসিদা সমস্বরে সুললিত কণ্ঠে উচ্চারণে আর তা হচ্ছে ‘তালাআল বাদরু আলাইনা, মিনছানিয়াতিল ফিদায়ী ওয়াজাব শাকরু আলাইনা, মাদা আল্ লিল্লাহহি দায়ী।” তাদের আনন্দ লহরীর লক্ষণীয় উচ্চারণ ছিলো। ইয়া হাব্বাজান মুহাম্মদান মিন জারি কি আনন্দ মুহাম্মদ আমাদের প্রতিবেশী। দশবছর পর ৬৩২ খ্রীঃ সফরের এই শেষ বুধবার যেন সেই আনন্দপ্রবাহ নতুন করে প্রবাহিত করলো। অনেক সাহাবী দান খয়রাত করলেন। প্রচুর পরিমাণে অনেকে শোকরানার সালাত আদায় করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই আনন্দ বেশীক্ষণ থাকলো না। সন্ধ্যা হতে না হতেই প্রিয়নবী (সা) ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এবং ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার দুপুর বেলায় তিনি সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন। তিনি হায়াতুন নবী। তিনি আছেন, উম্মতের জন্য বেকারার। তিনি উম্মতের সালাত সালামের জবাব দেন। সুবহানাল্লাহ। তাইতো মিলাদ মাহফিলের শেষপর্যায়ে তাকে স্মরণ করে সবাই কোরাস কণ্ঠে মিলিয়ে সুমধুর উচ্চারণে সালাত সালাম জানায়। সবাই বলে উঠে ‘ইয়ানবী সালামু আলাইকা, ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা, ইয়া হাবিব সালাম আলাইকা, সালাওয়াতুল্লাহ আলাইকা। আখেরী চাহার শোম্বা মূলত নবীপ্রেমে আপ্লুত হবার দিন। পরিশেষে মহান আল্লাহপাকের নিকট ফরিয়াদ জানাই যেন এই পবিত্রদিনের উছিলায় আমাদের সকলকে যেন ক্ষমা করে শারীরিক সুস্থতা দান করুক।
আমিন সুম্মা আমিন ওয়াচ্ছালাম।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট