চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বইপত্র

আহমেদ মনসুরের ঝরাপাতার শেকড় গল্পগ্রন্থের পাঠোত্তর ভাবনা

শাহরুজ হাসান

১৩ মার্চ, ২০২০ | ২:৫৩ পূর্বাহ্ণ

এ শতাব্দীর গল্পকার আহমেদ মনসুর। ২০১৩ ও ২০১৬ সালে বলাকা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘নিরাশার গল্প’ এবং ‘ভানুমতীর খেলা’ গল্পগ্রন্থ। ২০২০ সালে একুশে বইমেলায় খড়িমাটি থেকে সর্বমোট ১১টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘ঝরাপাতার শেকড়’। গল্পগুলো হচ্ছেÑ ‘আলোটা আলেয়ার নয়’, ‘অভয়ারণ্য’, ‘একজন পরাজিত যোদ্ধা’, ‘তাসের দান’, ‘দুচাকার ঘোড়া গাড়ি’, ‘যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়’, ‘অনাহূত’, ‘মুলতবি’ ‘অন্য পৃথিবীর পথে’, ‘বিভ্রম’ ও ‘ঝরাপাতার শেকড়’।
সমাজ সচেতন গল্পকার আহমেদ মনসুর ‘ঝরাপাতার শেকড়’ গল্পগ্রন্থে নিজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। একজন লেখক যদি এসব বিষয়ে দোদুল্যমানতায় ভুগে সে ক্ষেত্রে তার লেখা স্পষ্ট হয় না বরং ধাঁধার সৃষ্টি করে। এ ধরনের প্রবণতা আহমেদ মনসুরের গল্পে দেখা যায় না। তিনি মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার গল্পকার।
‘ঝরাপাতার শেকড়’Ñএর গল্পের ভাষা ধোঁয়াশে বা জটিল নয়। ছোট ও মাঝারি দৈর্ঘ্যরে বাক্যের মাধ্যমে ঝরঝরে ভাষায় তার বলার ভঙ্গি। ‘আলোটা আলেয়ার নয়’ গ্রন্থের প্রথম গল্পের ভাষার রূপটি এবার দেখা যাকÑ “লোকালয় থেকে অনেক ক্রোশ দূরে, পাহাড়ি দুর্গম পথ, জায়গাটা নির্জন নিরিবিলি। পাহাড়ের গা ঘেঁষে জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় জরাজীর্ণ এক দালান।”
এ গল্পে সহজ ও সরল ভঙ্গিতে পরিবেশের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ‘এক দালান’Ñএর মাধ্যমে গল্পকার ইংগিত করেছেন পরবর্তীতে কী ধরনের পরিণতি হতে পারে। গল্পকার এক্ষেত্রে বর্ণনায় যাননি, ইচ্ছা করলে যেতে পারতেন, যদি যেতেন পাঠকের গল্প পড়ার আবেগ ও আকাক্সক্ষা শেষ হয়ে যেতো।
‘একজন পরাজিত যোদ্ধা’ গল্পের নামটি ইংগিতধর্মী। তিনি ‘রাজাকার’ বা ‘যুদ্ধাপরাধী’ নাম দিতে পারতেন, দিলে কোন ভুল হতো না। এ ধরনের নামকরণে অনেক গল্প রচিত হয়েছে। গল্পকার উক্ত গল্পের নামকরণে প্রথাগত পথে হাঁটেননি। এ গল্পের নামকরণে গল্পকারের মনন ও সৃজনের পরিমিতি বোধ স্পষ্ট।
আহমেদ মনসুর স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের গল্পকার। তিনি কখনো পরাধীন এবং প্রাদেশিক অঞ্চলের গল্পকার নন। পরাধীন ও প্রাদেশিক চিন্তন প্রক্রিয়া তার গল্পে নেই। তার অগ্রজ ও সমসাময়িক বাংলাদেশের জনপ্রিয় ধারার গল্পকারের গল্পে পশ্চিমবঙ্গের গল্পের ছায়া স্পষ্ট। এমনিও দেখা গেছে বাংলাদেশের সুপ্রতিষ্ঠিত কতিপয় গল্পকার ও ঔপন্যাসিক মার্কেজ ও বোর্হেজের প্রভাব থেকে আজ পর্যন্ত বের হতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে গল্পকার আহমেদ মনসুর সচেতনভাবে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে সুবিধাবাদী চক্রের কারণে পরাজিতদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুদৃঢ় অবস্থানকে চিহ্নিত করেছেন এভাবেÑ “একজন স্বাধীনতাবিরোধীর নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের দায়িত্ব নিলেন তাঁরই হাতে নির্যাতিত একজন মুক্তিযোদ্ধা।” স্বাধীন বাংলাদেশে এ ধরনের কর্মকা- হরহামেশা দেখা যায় এবং পত্রিকায় এসব খবর প্রকাশিত হয় প্রতিনিয়ত। গল্পকার গল্পের ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন। এখানে তিনি রিপোর্টারের রিপোর্টিং ভাষার আশ্রয় নেননি।
‘ঝরাপাতার শেকড়’ গল্পে সাম্প্রতিক কালে রোহিঙ্গারা সমূলে উদ্বাস্তু হবার ঘটনার করুন অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে একজন নারীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে তা দেখিয়েছেন গল্পকার। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে ইটালির ঔপন্যাসিক আল বার্তো মোরাভিয়ার ‘টু ওম্যান’ উপন্যাসে নারীদের অবস্থা। বিশ^যুদ্ধের সময়ে দু’জন নারীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ধরা চেষ্টা করেছেন ‘টু ওম্যান’ উপন্যাসে।
গল্পকার আহমেদ মনসুর আজকের সময়ের প্রেক্ষাপটে এবং নিজস্ব চিন্তায় পাঠকের কাছে আলোচ্য গ্রন্থের গল্পগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। ‘ঝরাপাতার শেকড়’ গল্পগ্রন্থে সমকালের প্রেক্ষাপটে বিষয়-আশয় ও চরিত্রের বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। একজন গল্পকার অন্যতম কাজ হচ্ছে তার কালকে তুলে আনা। সমকালের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনে অতীত প্রাসঙ্গিক অথবা অনুষঙ্গ হয়ে আসে আহমেদ মনসুরের গল্পে।
এ গল্পগ্রন্থ পাঠ শেষে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা নি¤œরূপÑ ১. সমাজের বাস্তব চিত্র, ২. সময়ের চরিত্র বিন্যাস এবং ৩. রাজনৈতিক অশুভ শক্তি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান।
গল্পকার আহমেদ মনসুর তার গল্পের জন্য নিজে একটি গল্পের ভাষা তৈরি করেছেন। তাঁর সমকালের অনেক গল্পকার কায়েস আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখের গল্পভাষা ধার করে গল্প রচনায় ব্যস্ত।
আশা করি ‘ঝরাপাতার শেকড়’ গ্রন্থটির একটি গল্পও যদি ভালো লাগে তা হলে গল্পকারের শ্রম সার্থক হবে। এ বইটির ভূমিকা লিখেছেন কবি মুয়িন পারভেজ, প্রচ্ছদ মনিরুল মনির, দাম ১৫০ টাকা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট