চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুখের সন্ধানে

আহমেদ মনসুর

৬ মার্চ, ২০২০ | ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ

অফিস টাইম ওভার, তড়িঘড়ি করে বের হতে যাচ্ছেন রিদুয়ান সাহেব। এমন সময় প্রাচীর হয়ে সামনে এসে দাঁড়ান আরিফ।
‘বস্; কাল আমার ছুটি লাগবে। ওয়াইফকে নিয়ে বান্দরবান যাব বেড়াতে।’
রিদুয়ান সাহেব হালকা উঁচু লয়ে বলেনÑ ‘গেল মাসেই না কক্সবাজার বেড়িয়ে এলেন?’
‘আমার ওয়াইফের বেড়ানোয় খুব শখ স্যার।’ মাথার পিছনে ডান হাত রেখে কাচুমাচু স্বরে বলেন আরিফ।
রিদুয়ান সাহেবের দয়ার শরীর, স্ত্রীকে জড়িয়ে ছুটির কথা বললেই ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে!’
‘আপনার কাজগুলো তাহলে রিয়াদ সাহেবকে বুঝিয়ে দিয়ে যান আর ছুটির দরখাস্তটা আমার টেবিলে রেখে যান, এখন বেরুচ্ছি, কাল এসে এপ্রুভ করে দিবো।’ বলেই অ্যান্ড্রয়েট ফোনটা হাতে নিয়ে ‘তুমি রেডি হয়ে নাও, আমি এখনই আসছি’ ক্ষুদে বার্তাটি লিখে ফারহানার নম্বরে পাঠিয়ে দেন। দেখেন আরিফ তখনো সামনের চেয়ারে গাঁট হয়ে বসা। রিদুয়ান সাহেব বলেনÑ ‘বুঝলেন আরিফ সাহেব, আপনার ভাবীরও বেড়ানোর শখ, দেখতেই তো পাচ্ছেন- অফিসে কাজের কত চাপ, ওকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না, তাই অফিস শেষে দুজন মিলে শহরের মধ্যেই নানাখানে ঘুরতে বের হই।’
রিদুয়ান সাহেব বাসায় ফিরে দেখেন ফারহানা তখনো ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। ওদের একমাত্র মেয়ে প্রীতি পাশের রুমে উদোম গায়ে বসে টিভিতে টম অ্যান্ড জেরি দেখছে আর কুটকুট করে হাসছে। তা দেখে রিদুয়ান সাহেব ক্ষেপে গিয়ে বলেনÑ ‘প্রীতিকে এখনো জামা পরানো হলো না কেন?’ ফারহানা ড্রেসিং টেবিলের আয়না হতে মুখ না ফিরিয়ে জবাব দেনÑ ‘ধমক দিয়ে কথা বললে মনে হয়; আমি তোমার চাকরানী নাকি যে হুকুম জারি করছ? তুমি রেডি করে দিতে পারছ না? আমার আরো সময় লাগবে।’
প্রীতির বয়স কম হলেও আত্মসম্মানবোধটা একটু বেশি। বাবা-মায়ের কথোপকোথন শুনে বলেÑ ‘আমি নিজে নিজে রেডি হতে পারবো আব্বু, তুমি একটু রেস্ট নাও। আম্মু কোন জামাটা পরবো বলে দাও।’ ওর একটা জামা বিছানাতেই পড়ে ছিল, রিদুয়ান সেটা নিয়ে ওর কাছে গিয়ে বলেন- ‘এই নাও মা-মণি, এটা পরে নাও।’
ফারহানার জন্য আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো ওদের। রিদুয়ান কিছু বলে না, সে জানে এ মুহূর্তে কিছু বলা মানে বারুদের মুখে আগুন দেয়া। আখেরে দেখা যাবে অনুষ্ঠানে তো যাওয়াই হবে না তার উপর রাতটাও হবে মাটি। তারচেয়ে মুখ বুজে সহ্য করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আপন খালাতো বোনের বিয়ে। আত্মীয়-পরিজন সবাই আসবে। ওরা না গেলে সবাই ভাববে কী; এ ভেবেই স্ত্রীর কথা গায়ে মাখেন না রিদুয়ান সাহেব।
জোর করে মুখে হাসি ধরে রেখে অনুষ্ঠানে যোগ দেন রিদুয়ান দম্পতি। ঘুরে ঘুরে সবার সাথে কথা বলেন ওঁরা। এমন আচরন করছেন, দেখে সবাই মনে করবেনÑ আহা! কত সুখী দম্পতি দেখ! নিজেদের মধ্যে যাই চলুক, বাইরে সুখের অভিনয়টা ওরা রপ্ত করে নিয়েছে ভালই।
বাসায় ফিরে যে যার রুমে চলে যায়। বিয়ের প্রথম বছরটা শুধু কেটেছিল এক রুমে। সময়ের সাথে ওদের দূরত্ব বাড়ে জ্যামিতিক হারে। রিদুয়ান বেড়ে উঠেছে যৌথ পরিবারে। বাবা-মা, ভাই-বোনরা মিলে গদালি-মদালি করে কাটতো সময়। ফারহানা বউ হয়ে এঘরে আসার পর ঐতিহ্যের সব স্থাপনা তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ফারহানার এক কথা- এ জঙ্গলে ও থাকতে পারবে না। ওকে নিয়ে আলাদা বাসা নিতেই হবে, নয় সংসার করা ওর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না। রিদুয়ান পড়ে যায় মাইনকার চিপায়। পরিবার নাহলে ওর পক্ষে পড়াশোনা কিংবা এ পর্যন্ত উঠে আসা কিছুতেই সম্ভব হতো না। স্বপ্ন দেখতেনÑ রোজগার আরম্ভ হলে পুরো পরিবার নিয়ে সুখে থাকবে। সমস্ত স্বপ্ন বানের জলে খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। অশান্তির শুরু এখানেই। প্রথমে মন কষাকষি, এরপর ঝগড়া-জাটি, আঠার মতো লেগে থাকল সবসময়। প্রকৃত গৃহযুদ্ধ একেই বলে।
ফারহানা পড়াশোনা করা মেয়ে, চায় চাকরি করতে। রিদুয়ানের মা সম্মতি দেয় না। হৈমন্তি গল্পের অপুর মতো চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া রিদুয়ানের আর কিছু করার থাকে না। ফারহানা প্রায় ভাবে ডিভোর্স দিবে ওকে। অনেক ভেবেও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। ততদিনে প্রীতিও চলে আসে দুনিয়ায়। তাছাড়া তাদের যে সামাজিক অবস্থান ডিভোর্স হয়ে গেলে এর পারদ হুট করে তলানীতে গিয়ে ঠেকতে পারে। অগত্যা তাই মানিয়ে চলার ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু সম্পর্কে অনাস্থার চিড় যে ধরে গেছে, শীতলতা বসেছে জেঁকে, তা আর উষ্ণতার মুখ দেখে না ।
এটা ওটা নিয়ে নৈমত্তিক ভজঘট দেখে রিদুয়ানের বাবাই একদিন ওকে ডেকে বলে দেন যেন স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাসা নিয়ে চলে যায়। কথাটি বলার সময় ওর বাবার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। বাবার এতটা বিমর্ষ, মলিন চেহারা রিদুয়ান আর কোনদিন দেখেননি।
নতুন বাসাটা অফিসের কাছে। কেউ জিগ্যেস করলে বলে আগের বাসা থেকে অফিসে যেতে আসতে কষ্ট হচ্ছে বলে অফিসের কাছে বাসা নেওয়া। রিদুয়ান সাহেব বাবা-মার সাথে যোগাযোগ বন্ধ না করলেও ফারহানা ওসবে কেয়ার করার পাত্রী নয়। মাঝে-মধ্যে যাওয়া আসা করে এজন্য যে লোকে যেন না ভাবে সম্পর্ক টুকরো হয়েছে। রিদুয়ানও শ^শুর পক্ষের আচারানুষ্ঠানে অংশ নেয় সৌজন্যের খাতিরে।
বান্ধবীদের কাছে স্বামীর প্রশংসা যখন করা হয় আপনার ভ্রম হতে পারে এরা শিরী-ফরহাদ নয় তো! রিদুয়ানও বন্ধুমহলে বউয়ের শুধু গুণগান গেয়েই বেড়ান। মেয়েকে বুয়ার কাছে ফেলে রেখে ফেসবুকে পরিচয় হওয়া কলেজ পড়–য়া এক ছেলের সাথে দিব্যি ঘুরে বেড়ায় ফারহানা। অফিস শেষ করে রিদুয়ানও এখন যথাসময়ে বাসায় ফেরে না। বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা মেরে, জীবনে সিগারেট না খাওয়া মানুষটি মদের গ্লাসে গলা ভিজিয়ে রাত-বিরাতে ঘরে ফেরে। শেষ কবে ওরা একসাথে খেয়েছে ওদের মনে নেই।
প্রীতির ছোট্ট মনে রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করে। আনমনে কত কি ভাবে। হে আল্লাহ; কি করলে আমার আব্বু-আম্মুর মধ্যে সব ঝগড়া বন্ধ হয়ে যাবে? একদিন ওর মাথায় আসে একটি দারুণ প্ল্যান। চিঠি। একই চিঠি দুটো লিখে আম্মুর রুমে একটি আর একটি রাখবে আব্বুর রুমে।
প্রিয় আব্বু ও প্রিয় আম্মু,
আমার বইয়ে লেখা আছে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। আমার মনে হয় কথাটা আসলে ঠিক। স্কুলে যখন যাই, দেখি চারদিকে অনেক মানুষ, সুন্দর সুন্দর মানুষ, রাস্তায় সুন্দর সুন্দর সব গাড়ি, রাস্তার পাশে সারি সারি সব সুন্দর বাড়ি। ছবিতে গ্রাম দেখি। সুন্দর গ্রাম। সবুজ গাছ-পালা, পাখি। আমার মনটা ভরে যায়। কিন্তু যখন আমি তোমাদের দেখি মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আমার বন্ধুদের বাবা-মাকে যখন দেখি কত ভালো লাগে, ওরা একে অপরকে এত ভালোবাসে, একসাথে কক্সবাজার, বান্দরবান বেড়াতে যায়, কত মজা করে। ওদের এত এত মজা দেখে আমার বুকটা ঈর্ষায় ফেটে যায়। আমার বন্ধু প্রিয়াকে তো তোমরা চেন, ওর মা নেই, ওর বাবা ওকে কত ভালোবাসে, তবু ওর মন খারাপ থাকে সবসময়। সবাই ওকে সান্ত¡না দেয়, আমি দিতে পারি না। আমার তো বাবা-মা থেকেও নেই। আমারও তো মন খারাপ থাকে সবসময়। আমি কি সান্ত¡না দিব ওকে! আমি শুনেছি আল্লাহর কাছে চাইলে নাকি সবকিছু পাওয়া যায়, আমি তো আল্লাহকে এককোটি বারের চেয়েও বেশি বলেছিÑ হে আল্লাহ তুমি আমার আব্বু-আম্মুকে মিলিয়ে দাও। আব্বু-আম্মুর সাথে আমি অনেক মজা করবো, এক সাথে কক্সবাজার বেড়াতে যাবো, গল্প করবো। আল্লাহ তো আমার কথা শুনে না। জানোÑ আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিভাবে মরে যেতে হয় আমি জানি না। তোমরা কি আমাকে শিখিয়ে দেবে কিভাবে মরে যেতে হয়?
দুজন দুরুমে বসে চিঠিটা পড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। দুজনই পাগলের মতো ছুটে যায় বসার রুমে। প্রীতি তখন টম অ্যান্ড জেরি দেখেও মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে। আব্বু-আম্মুকে একসাথে দেখে প্রীতি খুশি হয়ে উঠে দাঁড়ায়। রুমে ঢুকে ওরা দুজন সামান্য দূরত্বে দাঁড়ালে প্রীতি আব্বু আম্মু বলে ওদের দিকে ছুটে যায়। ওরাও কালবিলম্ব না করে একসাথে ওর দিকে এগিয়ে আসে। সবাই জড়িয়ে ধরে এক অপরকে। এ-দেখে প্রীতি খুব প্রীত হয়।

শেয়ার করুন