চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কানিজ মাহমুদের মেঘমুদ্রার জবানবন্দি চিত্তক্ষোভের শিল্পসুষমা

শোয়েব নাঈম

৬ মার্চ, ২০২০ | ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ

অনিঃশেষ বিষাদ যেন কবি কানিজ মাহমুদের জন্মের অন্তর্লীন এক মাত্রা যাকে অতিক্রম করা বেশ অজেয় দূর, আবার সজ্ঞানে একে আগলে রাখতে চেয়েছেন সাহিত্যরুচির কখনও অনুরাগে কখনও প্রতিরাগে, কিন্তু কখনই বৈরাগ্যে নয়। প্রকারান্তরে তাঁর এসব বিষাদের অনুষঙ্গ কখনো গাণিতিক পরিমাপ সম্ভব নয়, কিন্তু এর তীব্রতা মাপা যায় তাঁর কবিতার টোন দিয়ে। কবির শব্দবন্ধ এবং মুহূর্ত নির্বাচন করেছেন জীবনের নানারকম প্রখর স্মৃতি, পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতার কোর মেমরি দিয়ে। যা চোখে, কানে এবং মগজে অর্থাৎ বোধের বিষয়কে কবি আবার কিভাবে পড়েছেন, কিভাবে আবার শুনেছেন এবং কিভাবে তীক্ষè অনুভব করেছেনÑএই তিন ভাবের ইন্টারপ্রিটিশনে এবং কম্বিনেশনে একটা এসথেটিক্যাল ভ্যালুতে তৈরি করেছেন ট্রমাধর্মী ‘মেঘমুদ্রার জবানবন্দি’ কাব্যগ্রন্থ । প্রতিটি কবিতার স্পিরিট হচ্ছে প্রতিটি কবিতার বয়ানে উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারেÑ ‘চা মুড়ির সকাল ছিল আমাদের…’ এভাবে বলে যাওয়া একটা কাব্যগল্প আছে এবং নৈতিকতা বোধের আবার এক একটা নান্দনিক কাব্য সমাপ্তিও আছেÑ ‘মা আমার শিক্ষক, আমার আলো।’
কষ্টের ঐশ্বর্য সমান এই ‘মেঘমুদ্রার জবানবন্দি’ মর্মযন্ত্রণার আর্তি আর নীরদ স্মৃতিকাতরতার পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার বিচ্ছুরণ আছে কাব্যগ্রন্থের নামকরণ বিশ্লেষণে। গ্রন্থের মলাটেই কবি প্রত্যয়ন করেছেন পুঞ্জীভূত মেঘ প্রতিরুপ জমাট কান্নার ইমেজ আর স্মৃতি এবং পরিবেশ আস্বাদনে জেগে ওঠা কবির চিত্তক্ষোভ। নামকরণের ভেতরটা ভেঙে একটা চাপা কান্নার জোয়ার আসতে চায়। পাশাপাশি শিল্পসর্বস্বতার ক্ষেত্র বিচারে প্রচ্ছদে প্রতিভাসিত হয়েছে গ্রন্থ নামকরণে শিল্পসুষমার এক সার্থক চরিতার্থতা।
আকুলতার উপাদানে কবির যে বিশাল জগৎটি গড়ে উঠেছে তা’ সূচীপত্রের পাতায় ৪০টি কবিতার শিরোনামগুলি পাঠ করলে সর্বদা উপলব্ধি করা যায় প্রতিটি শিরোনামের নতুন নতুন ব্যাখ্যায় ঘটনানির্ভর কাব্যভঙ্গির স্পন্দন, কবিতার তীব্রতাকে অক্ষুণœ রেখে নতুন কাব্য উদ্দীপনার এবং সূক্ষ্ম বিশিষ্টতার কারুকাজ।
ছোট ছোট ব্যক্তিক বৃত্তে কমন দুইটি অনুষঙ্গকে ধারণ করেই কাব্যের টেক্সটকে বিস্তৃত করেছেন, যেখানে কবির সমকাল ও ‘মা’ প্রভাবনির্ভর ব্যক্তিজীবন হচ্ছে তাঁর কবিতার পৃষ্ঠপোষক। এই অনুষঙ্গদ্বয়ের অনুভূতির চাপে শৈল্পিক ক্যাথার্সিস ঘটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণে জন্ম হয়েছে ‘মেঘমুদ্রার জবানবন্দি’ গ্রন্থের কাব্যগুলি। তাঁর কাব্য প্রকরণগুলিতে আছে যন্ত্রণার বহুবিচিত্র কাব্যিক রূপ, আর গভীর থেকে গভীরতর দগ্ধতার অনুভূতি। আর আছে বিষাদের মেঘমুদ্রা, আছে নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব বোধের অসাধারণত্ব।
সমকাল অনষঙ্গের কবিতা যেমন :
“লেগেছে দাবানল দূর আমাজানে/তারই কিছু আহ্লাদী হাওয়া/ আমাদের ডানপিঠে শহরে…”
( ভোর হয় তবু হয় না সকাল: পৃষ্ঠা ১৬) ।
‘মা’ প্রভাবনির্ভর ব্যক্তিজীবন অনুষঙ্গের কবিতা যেমন :
“চা মুড়ির সকাল ছিল আমাদের….
মাঝে মাঝে হাঁটুমুড়ে বসি ঈশ্বরের পায়ের কাছে।
নতজানু কান্নায় ভাসিয়ে দিই সবুজ জায়নামাজ।
মা আমার শিক্ষক, আমার আলো।”
( পুষ্প প্রসবার জলচোখ: পৃষ্ঠা ৯ ) ।
ভাবে, বিস্তারে আর জীবনের বিষাদ মন্থনে কবি কানিজ মাহমুদ কবিতার পরম্পরায় চারপাশের কদর্য মানুষের বৈরিতার অবাক উদ্ভাসকে মুখপত্র হিসেবে গ্রন্থিত করেছেন। মনস্তত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের যাপিত দিনের প্রতিটা ক্ষণকে দেখেন ‘প্রতিনিয়ত ঘুমায় কালসাপ’। প্রতিটি চেনাশোনা মানুষকে সরাসরি অবলোকন না করে সমান্তরালে চলা আরেকটি জীবনের কুটিলতা প্রচারের মাধ্যমে পরিচয়জনদের চিহ্নিত করার কৌশলের আভাস পাওয়া যায় তাঁর পঙ্ক্তিগুলিতে। এমন মনুষ্যসম্বন্ধীয় জীবনের খলতাকে প্রকাশিত করতে কবি তাঁর কাব্যসুলভ আবেগের পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন প্রতিতুলনার মেটাফোর। যেমনÑ
“[…] এসেছিল অনেকে। শুধু প্রজাপতির দল
ঘৃণা ছুঁড়ে বলেছিলো মানুষ হবো নারে,
তার চেয়ে পতঙ্গ হয়ে বাঁচি।”
(প্রজাপতি হয়ে বাঁচি: পৃষ্ঠা ২৬) ।
গ্রন্থিত একটি অংশে কাব্যগম্ভীরে কবি কৃষাণীমাঠ এবং আধুনিক শহরের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার সাঁকো তৈরির চেষ্টা করেছেন কিছুটা প্যাস্টোরাল ধাঁচের প্রকরণে। যে সুতা ছিঁড়ে গিয়েছে সেই সুতা কিংবা গ্রাম ও শহরের সংযোগ করতে চেয়েছেন এমন পঙ্ক্তি দিয়ে
“আকাশ ছোঁয়ার বাসনায় উড়ে পাখিমন। মেঘের বৃষ্টি নামায় অভিমানী বালক। সব তর্ক-বিতর্ক পেরিয়ে নীল আকাশের সাথে এখানে পড়েছি নুয়ে। যেখানে বনের গন্ধ মেখেছে মেঠো রাখাল।”
(সূর্যভাটা: পৃষ্ঠা ২৮)।
নারীর যে জীবন অপমানের ও বৈরিতার আজন্ম সংস্কারে মধ্যে নিমজ্জিত, তা থেকে কী করে ঘুরে দাঁড়াতে হয় এবং সেই জীবনকে কীভাবে পরাভূত করতে হয় এরই অবগতির কাব্যবীজ বপন করেছেন কবি তাঁর অনুরণিত এই ‘মেঘমুদ্রার জবানবন্দি’ কাব্যগ্রন্থে। নিচের কাব্যনমুনায় এই উচ্চমার্গীয় ভাবচেতনার তীব্রতা উপলদ্ধি করা যায় প্রগাঢ়ভাবে
“তোমার জন্মদিনে মহাকাশ নেমে আসেÑ
আমি ছায়াপথ ধরে হাঁটি/এর আগে পৃথিবীতে জন্মায়নি কোন মানুষ।/ শুধু পায়ের চিহ্ন রেখে গেছে দুপুরের বিবস্ত্র রোদ/ কাকে তুমি পুরুষ বলছো অথবা নারী/ বৈসাবী উৎসবে সূর্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে/ যে মেয়েটি নেচেছিল তার রক্তঘ্রাণে/ কান পেতে শুনো- নারী জন্ম পাপ হলে পুরুষ জন্মও বৃথা।/ তবুও পৃথিবীতে পুরুষ জন্মায়, জন্ম নেয় নারী/ জন্মায় না কোন মানুষ।”
(কড়িতে কেনা জন্মদিন: পৃষ্ঠা ৩১)।

শেয়ার করুন